৬০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ / ৫ মাঘ, ১৪২৯
কোভিড আতঙ্ক
ডাঃ ফুয়াদ হালিম
কোভিড ভাইরাস করোনা পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা যুগ যুগ ধরে মানুষের দেহের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের প্রজনন সম্পন্ন করে আসছে এবং এখনও করছে। ১৯১৯ সালে পৃথিবীব্যাপী স্প্যানিস ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ঘটেছিল করোনা পরিবারের এক ভ্যারিয়েন্ট ‘কোভিড’-এর কারণে।
অতিমারী বা মহামারীর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো - ন্যূনতম পাঁচ লক্ষ জনসংখ্যা - যাঁদের মধ্যে নিবিড় সামাজিক সংস্পর্শ থাকার সম্ভাবনা থাকে তাঁদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। যেমন শহরের জনপদগুলিতে দেখা যায়। ইদানিংকালে এই জনসংখ্যার বহুগুণ বেশি মানুষ নিজেদের মধ্যে দৈনন্দিন সংস্পর্শে আসে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যানবাহনের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মানুষের আসা যাওয়া বেড়েছে। বিভিন্ন পণ্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আমদানি বা রপ্তানি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেও বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। বিভিন্ন ভাইরাসঘটিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি একটা জায়গায় ঐতিহাসিকভাবে সীমাবদ্ধ থাকার পরও দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীব্যাপী।
সাম্প্রতিককালে যে অতিমারী সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করেছিল সেটা হলো - কোভিড-১৯। এই প্যানডেমিককালে আমরা কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপলব্ধি করলাম -
আমরা লক্ষ্য করলাম যে, কলকারখানা ইত্যাদি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও, উৎপাদন প্রক্রিয়া সাংঘাতিকভাবে শিথিল হওয়া সত্ত্বেও বৃহৎ পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির, লুটের কোনো খামতি থাকেনি। বিশেষ কারণে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যবসায় ব্যাপক বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে।
‘কোভিড’কে পরাস্ত করার জন্য বা চিকিৎসা করার জন্য কোনো ওষুধ নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার পরামর্শে বহু ওষুধ বাজারে এসেছে, আবার বিফলতার কারণে প্রত্যাহৃত হয়েছে।
কোভিড ও করোনা পরিবারের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের কারণে সৃষ্ট সংক্রমণকে অনুধাবন করে আমরা বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ যা পেয়েছি তা হলো - সময়ের সাথে সাথে এই ভাইরাসের বিবর্তন ঘটে এবং মারণ ক্ষমতা কমে আসে।
‘কোভিড’ মানবদেহের ‘প্রদাহে’র (Inflammation) প্রক্রিয়াকে আরম্ভ করে বা বাড়িয়ে তোলে। যে সমস্ত মানুষ অনিয়ন্ত্রিত মধুমেহ (Blood sugar) উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension), ফুসফুস ও বৃক্কের (Kidney) রোগ, রোহিনী (Cancer) রোগ অথবা ইমিউনো কম্প্রোমাইজড রোগে ভোগেন তাদের রোগ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, এবং মৃত্যুর কারণ ঘটায়।
এই কোভিড আতঙ্কের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে অন্যান্য করোনা ভাইরাসের মতোই কোভিড- ১৯ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যাবে এবং বিবর্তনের মাধ্যমে তার নতুন কম ক্ষমতাসম্পন্ন অপত্যের (strain) উদ্ভব ঘটবে। ১৯১৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জার অতিমারীর বংশধরেরা এই মুহূর্তে সাধারণ সর্দি কাশির ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের স্ট্রেনে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং তাদের মারণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কমেছে।
সাধারণভাবে কোভিড ভাইরাসের পরিণতিও এই অনুসারেই হবে এবং মারণ ক্ষমতা কমবে। বাস্তব তথ্য ও প্রমাণ তারই ইঙ্গিত বহন করছে।
সাম্প্রতিককালে কোভিড জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা ও ইয়োরোপের কয়েকটি দেশে মাথা চাড়া দিয়েছে। তার কারণ - বিএফ-৭ (BF-7, sub virus of omicron) যেটা ওমিক্রনের সাব-ভাইরাস BA.5 sub varient থেকে জন্ম নিয়েছে।
চীনে এর সামান্য প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল এবং তা দ্রুততার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং বর্তমানে রোগের সমস্ত সূচক নিম্নমুখী। এই খবর পৃথিবীব্যাপী ছড়ানোর পর লক্ষ করা যাচ্ছে, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। প্রচুর ওষুধ কিনে রাখছে। কোভিড টেস্টিং কিট, সাধারণ খাবারদাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
ভারতে লাক্সারি চারচাকা যানের বিক্রি ৩৫ শতাংশ বেড়েছে অথচ গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের প্রয়োজনীয় সাইকেল, মোটরসাইকেল, ছোটো গাড়ির বিক্রি কমেছে সাংঘাতিকভাবে। তুলনামূলকভাবে ধনী ব্যক্তিদের ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতা বেড়েছে।
কোভিড আতঙ্কে কৃত্রিম চাহিদা তৈরির চেষ্টা করছে বহুজাতিক সংস্থা পরিচলিত বাজার ব্যবস্থা।
কিন্তু কোভিড-১৯ ভাইরাস গৃহপালিতরূপে রূপান্তরিত হবে। সাধারণ জ্বর সর্দি সৃষ্টিকারী করোনা পরিবারের অন্যান্য ভাইরাসের মতোই।
কোভিড মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো - পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং কোভিডকে ভয়ানক করে তোলার রোগগুলির নিয়ন্ত্রণ। মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে যা গুরুত্বপূর্ণ।
এই কাজ ধারাবাহিকভাবে এবং নিয়মিত চালানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কোভিড আতঙ্ক, বিজ্ঞানবর্হিভূত এবং তার ফলে বাজার শক্তি ‘প্যানিক বাইং’ (Panic Buying) বাড়াবার ষড়যন্ত্রে যতই চেষ্টা করুক কোভিডের মূল চরিত্রকে বদলাতে পারবে না।