৫৯ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২০ মে, ২০২২ / ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
নিজের ছ-পায়ের ধুলো নিজেরই মস্তকে দেওন ইত্যাদি বিষয়ক একটি গবেষণার খসড়া
গবেষকঃ ঘন্টুরাম শর্মা
এই গবেষণার বিষয়বস্তুঃ ‘আত্মসম্মান বনাম আত্মকে সম্মান - ইতিহাস, সাহিত্য ও মনস্তত্ত্বের একটি প্যান্তাখ্যাচাং অন্বেষণ।’
মুখবন্ধ
সকলেই সম্মান পাইতে ভালোবাসে। কেহ-কেহ আমার ভয়ে, ভক্তিতে ‘পোলোভনে’ কিংবা বিভ্রান্তিতে যে সম্মান অন্যরা প্রদান করে তাহাতে খুশি না হইয়া নিজেই নিজেকে সম্মানবহ কিছু ‘পোদান’ করিয়া, বা নিজের সম্পর্কে সম্মানবাচক উক্তি করিয়া, কি আচরণ করিয়া বিপুল আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। এমন উদাহরণ ‘পোচুর’ রহিয়াছে, একটু ভাবিলেই স্যাটাস্যাট্ পাওয়া যাইবে। অত্র গবেষণায় সেই বিষয়ে কিছু তথ্য ‘পোদান’ করা হইল।
।। অধ্যায় এক ।।
তথ্য-১: গীতায় ‘শী কিষ্ণ’ বলিয়াছেন যে সর্বধর্ম পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার কাছে শরণ লইতে। ইহা ছিল দ্বাপর যুগের উক্তি। অধুনা এই কলি যুগে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ‘পোহার’, ধর্ষণ, হত্যা-ইত্যাদি ‘মহৎ’ ধর্মকৃত্য করিয়া মহম্মদপন্থী, ইশাপন্থী ভারতবাসীদের মহান সনাতন ধর্মে ঠাঁই লইতে বলা হইতেছে। তাহাতে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ‘পোতিষ্ঠা’ করা সহজসাধ্য হইবে। গীতার নির্দেশ এইভাবেই ভাগবৎপন্থীরা মোহনভোগ খাইতে-খাইতে পালন করিতেছেন। (পাঠকগণ কী কহেন এই সম্পর্কে?)
তথ্য-২: ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই ঘোষণা করিয়াছিলেন, ‘আমি এবং রাষ্ট্র সমার্থক। আমার পরে লয়’ অনিবার্য।’ ইহাতে অবশ্য ফরাসি জনগণ ক্ষুধা ও ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া বিপ্লব করে ও তাঁহার রাজকীয় মুণ্ডটি গিলোটিন নামক একটি যন্ত্রে কুচ করিয়া কাটিয়া প্যারি মহানগরীর নর্দমায় ফেলিয়া দেয়। (এই ধরনের ঘটনা কী আরও ঘটিতে পারে?)
তথ্য-৩: অনুরূপ আত্মশ্লাঘার বশে বহু উক্তি করিয়াছিলেন আর একজন - অ্যাড্লফ হিটলার। পরিণামে তাঁহাকে বাঙ্কারের গভীরে আত্মহত্যা করিয়া রুশি সৈনিকদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া হইতে রেহাই পাইতে হয়। (স্বঘোষিত কিংবা অঘোষিত মিনি-হিটলারদের সম্পর্কেও কি মহাকাল অনুরূপ ব্যবস্থা করিতে পারে? পাঠকগণ কী বলেন?)
।। অধ্যায় দুই ।।
তথ্য-৪: মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র নামে একটি অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বোকাসো-নামা এক উপজাতি-নেতা ভোটে জিতিবার পর ‘পেসিডেন্’ হইয়াই নিজেকে ‘সম্রাট’ বলিয়া ঘোষণা করেন বিংশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের এক সময়ে। ‘রিপাব্লিক’ নামাঙ্কিত হয় ‘এম্পায়ার’ বলিয়া; বোকাসো হন ‘এম্পারার দ্য গ্রেট’। কিছু কাল পরেই এই সম্রাট ‘পোবরের’ মট্মটানিতে অতিষ্ঠ হইয়া দেশের লোক মার্কিনি মদতে তাঁহাকে গদিচ্যুত, শৃঙ্খলিত ও নিহত করে। (ইহা কী ইতিহাসের সঙ্কেত? পাঠকগণ?)
তথ্য-৫: ‘পোতিবেশী’ পাকিস্তানে ওই গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই জেনারেল আয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাইয়া ক্ষমতা দখল করেন এবং একই সঙ্গে নিজেকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ (সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ), ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ (ওদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান) ইত্যাদি পদবীতে ভূষিত করেন ও ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ নামক একটি সোনার পাথরবাটি- তুল্য শাসনতন্ত্র ‘পোতিষ্ঠা’ করিয়া দেশের ‘পেসিডেন্’ হন। (পরবর্তীকালে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে তিনি নিক্ষিপ্ত হইয়াছেন। এ বিষয়েও পাঠকদের বক্তব্য জানিতে ব্যাকুল রহিলাম।)
তথ্য-৬: ‘বিটিশের’ কাছে ৬বার ক্ষমা চাহিয়া এবং স্বদেশি আন্দোলনকে পিঠে ছুরি বসাইবার ‘পোতিশ্শুতি’ দিয়া মুচলেকা দিবার পর মুক্তি পাইয়া এক সময়ে নিজেই নামের অগ্রে ‘বীর’ অভিধাটি স্থাপন করিয়া দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করিয়াছিলেন সাভারকর। অদ্যাপিও তাঁহার নাতি-শিষ্যরা দেশকে একইভাবে তাঁহার সম্বন্ধে গুলতাপ্পি মারিয়া ‘পোতারিত’ করিতেছে। (তাঁহার স্থান ভবিষ্যতে ইতিহাসের কোথায় হইতে পারে, ইহা পাঠকগণ বিচার করিবেন।)
।। অধ্যায় তিন ।।
ইতিহাসের তথ্য অনেক ‘পোদান’ করা হইল, অতঃপর ‘সংস্কিতি’ লইয়া কিছু নিবেদন করা যাউকঃ
তথ্য-৭: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি দেশপ্রেমের ‘পোড়াকাষ্ঠ’ বলিয়া বিজেপি- কর্তৃক সদাবন্দিত (ভাইস চ্যান্সেলর থাকার সময়ে ইউনিয়ন জ্যাককে স্যালুট করিতে না-চাওয়ায় যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে বেত মারিবার হুকুম দিয়া খ্যাতকীর্তি হন) - তিনি উপাচার্য হিসেবে নিজেকেই নিজে ডক্টরেট উপাধি দান করেন। (এ বিষয়েও পাঠকগণের বক্তব্য ‘শবণ’ করিতে আগ্রহী রহিলাম।)
তথ্য-৮: পাড়াতুতো এক আড়খ্যাপা ‘রিটায়াড্ পোফেসর’ জ্যেঠুর মুখে শুনিয়াছি যে, বহুকাল পূর্বে (উনি তখন পঞ্চবিংশতি বর্ষীয়) ‘রোমানফ অ্যান্ড জুলিয়েট’ নামে একটি ‘পোবল’ হাসির ফিলিম এদেশে হলিউড হইতে আসিয়াছিল। উহার ঘটনাস্থল ছিল কন্করডিয়া নামক অতলান্তিক মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (৮ বর্গ কিঃমিঃ) কল্পিত দ্বীপরাষ্ট্র, যাহার জনসংখ্যা হাজার দুই হইলেও তাহা একটি ‘গণোতান্তিক’ভাবে নির্বাচিত সরকার-শাসিত দেশ ছিল। ওই দেশের ‘পেসিডেন্’ (বিখ্যাত অভিনেতা পিটার উস্তিনভ এই ভূমিকায় অভিনয় করেন) একবার রাষ্ট্রসংঘ হইতে দেশে ফিরিলে যে অনবদ্য হাস্যরসের সৃষ্টি হয়, তাহা এইখানে ‘পাসঙ্গিক’ বিধায় উল্লেখ করিতেছি। সারাদেশে একটিই এরোপ্লেন, একজনই পাইলট (তিনি আবার স্বয়ং ‘পেসিডেন্’ই), কোনও সৈন্যবাহিনী নাই, কিন্তু ‘পোধান’ সেনাপতি একজন আছেন (বলাই বাহুল্য যে, তাহাও স্বয়ং ‘পেসিডেন্’ সাহেবই)। রাষ্ট্রসংঘের সভা হইতে দেশে ফিরিলেন ‘পেসিডেন্’; নিজেই প্লেন চালাইয়া। তাহার পরে গট্গটাইয়া টারম্যাকের পাশে খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া স্যালুট দিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর, নিজেই বিশ-পঁচিশ হাত হাঁটিয়া ছোটো একটি কামানে পট্কা-জাতীয় কিছু একটা ভরিয়া সেটি বার দশেক ফাটাইলেন। তাহার পরে নিজে গার্ড অব অনার লইবার পোজ দিয়া হাঁটিতে-হাঁটিতে বিমানবন্দর হইতে নির্গত হইয়া স্বয়ং একটি পুরানো মোটরগাড়িকে ঠেলিয়া দিলেন; এবং ‘এস্টাট’ হইবার পর তাহাতে লাফাইয়া উঠিয়া বিকট বেসুরো এক হর্ন বাজাইয়া চলিয়া গেলেন। অর্থাৎ, ‘পেসিডেন্’ ‘পোধান’ সেনাপতি- সৈন্য-পাইলট- ‘ডাইভার’- সোয়ারি - একাই সব তিনি। নিজেই প্লেন চালাইলেন, নিজের উদ্দেশে স্যালুট দিয়া গার্ড অব অনারও দিলেন এবং লইলেন, নিজেকেই গানস্যালুট দিলেন এবং একই সঙ্গে ‘পেসিডেন্’ ও ‘ডাইভার’ হইয়া এয়ারপোর্ট হইতে বহির্গত হইলেন! (সুধী পাঠকবৃন্দ! নিজেকে নিজেই ‘পোবল’ভাবে সম্মানিত করিবার এমন জম্পেশ কল্পনা আর কোনও ‘শিল্পসিষ্টির’ মধ্যে দেখিয়াছেন কি-না, জানাইবেন!)
।। অধ্যায়- চার ।।
তথ্য-৯: বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী গিরীন্দ্রশেখর বসু তাঁর প্রখ্যাত একটি গ্রন্থ ‘লালকালো’ (যাহা পিপীলিকাদের রূপকে মানবীয় বিচিত্র নষ্টামি ও মূর্খতার বিবরণাত্মক একটি কাহিনি) গ্রন্থে একস্থলে লিখিয়াছেন, বিয়াল্লিশকর্মা নামক জনৈক পিপীলিকা-ইঞ্জিনিয়ার নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কে ‘পোবল’ হামবড়াই করিয়া নিজেরই ছ-ছটি পায়ের ধুলো স্বীয় মস্তকে দিলেন। (পাঠকগণ, মনুষ্য সমাজেও কী অনুরূপ ভাবাপন্ন কিছু কার্যকলাপ দেখিয়াছেন কি-না, জানাইবেন; অধীনের প্রস্তাবিত গবেষণায় কাজে লাগিবে)।
তথ্য-১০: সুপরিচিত কথাসাহিত্যিক ডাঃ বিমল গুড়িয়া সদ্য-সদ্য একখানি ‘পরমাণু গল্প’ লিখিয়া গণমাধ্যমে দাখিল করিয়াছেন। সেটি ‘পোয়োজনীয়’ মনে হওয়ায় পুরোপুরিই ‘উদ্ধিত’ করিলামঃ ‘বিক্রমাদিত্য বলিলেন, কালিদাস, আজ থেকে আমিও তোমার মতো মহাকবি।’ (পাঠকবৃন্দ, অনুগ্রহ করিয়া এখানে ‘বিক্কমাদিত্য’কে কোনও পুরুষবেশী মহিলা বলিয়া ভাবিবেন না!)
তথ্য-১১: খুব সম্প্রতি গণমাধ্যমে দু-একটি অনবদ্য স্কেচও দেখিয়াছি, যাহা এই সঙ্গে প্রদত্ত হইল। (আমি ইহার অর্থোদ্ধার করিতে পারি নাই। অনুগ্রহ পূর্বক কোনও সহৃদয় পাঠক কি অধীনকে বুঝাইয়া দিবেন?)
।। উপসংহার ।।
মদীয় গবেষণাটি সমাপ্ত হইলে মনে হয়, আত্মকে সম্মান দেখাইবার ‘পোবণতা’ যাহাদের আছে - আসলে তাহাদের আত্মসম্মান বলিয়া কোনও ‘পদাথ্থো’ নাই। হীনমন্যতায় ভোগেন বলিয়াই তাঁহারা নিজেকে ওইরূপ গরিমাভূষিত করিতে চাহেন। আশা করি, এই মনোবিজ্ঞান-সম্মত সিদ্ধান্তটি যুগান্তকারী হইবে। (এই রে! এই আমিও কি উহাদেরই দলভুক্ত হইয়া গেলাম? পাঠকগণ ‘অনুগ্গোহ’ করিয়া জানাইবেন। ‘পোকাশ’ থাকে যে, এই গবেষণা খসড়ায় গবেষণা- ‘বত্তমানে’ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির ‘অনুপ্পেরণা’ - ‘পাপ্তো’ বানানবিধি ‘ব্যবহিত’ হইয়াছে।)