৫৯ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২০ মে, ২০২২ / ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
বিপ্লবী কমরেড হো চি মিন স্মরণে
শংকর মুখার্জি
“মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সংগ্রাম আরও কিছুকাল চলবে। আরও জীবন ও সম্পত্তি বিসর্জন দিতে হবে আমাদের জনগণকে। তবে যাই হোক না কেন মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ণ বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত দৃঢ়তার সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
যে প্রতিবন্ধকতা, কষ্টই আসুক না কেন আমাদের জনগণ নিশ্চিত যে তারা পূর্ণ বিজয় লাভ করবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিদায় নিতে হবে। দক্ষিণ আর উত্তর ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হবে।”
১৯৬৯ সালের ১০ মে ‘শেষ ইচ্ছাপত্র’-তে কথাগুলি লিখেছিলেন কমরেড হো চি মিন। এর কয়েকমাস পর ওই বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর হো চি মিন ঊনআশি বছর বয়সে মারা যান।
দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তি তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, ভিয়েতনামের জনগণ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে একদিন দেশছাড়া করবেই। উত্তর ও দক্ষিণের আবার একীকরণ ঘটবে। হো চি মিনের মৃত্যুর প্রায় ৬ বছর পর ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল সেই মুহূর্ত এসেছিল। প্রতিরোধের যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামের মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ভিয়েতনাম সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়। ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম গড়ে ওঠে।
শৈশবকাল থেকেই বিদেশিদের সম্পূর্ণ কবলমুক্ত ভিয়েতনামের স্বপ্ন দেখতেন হো চি মিন। দেশপ্রেমের বীজ সেসময়েই তাঁর মনে অঙ্কুরিত হয়। তিনি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন দেশপ্রেমিক নেতাদের। এমনকী যখন তিনি প্রথম অক্টোবর বিপ্লবের কথা শুনলেন, তখন তিনি লেনিনকে একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবেই দেখেছিলেন, যিনি স্বদেশবাসীকে শোষণের জোয়াল থেকে মুক্ত করেছেন। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই হো চি মিন ইংল্যান্ড থেকে প্যারিসে আসেন। এই দেশে দেশে ঘোরাও দেশপ্রেমের তাড়নাতেই, দেশকে সাম্রাজ্যবাদের শাসন-অত্যাচার থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
কৈশোরেই হো চি মিনের এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছিল যে, দেশের জনগণকেই লড়াই করে নিজেদের মুক্তি আদায় করে নিতে হবে। বিদেশিদের সাহায্যে দেশের মানুষের দুঃখদুর্দশা দূর করা যায় না।
ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগেই ভিয়েতনামে সামন্ত শাসনের অবসান ঘটে। এই সময়ে, ১৮৫৮ সালে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা ভিয়েতনাম আক্রমণ করে। ভিয়েতনামের শাসনক্ষমতায় থাকা নগুয়েন রাজবংশ স্বদেশের সাথে বিশ্বাশঘাতকতা করে। ফরাসিদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের পথে তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা। এরই পরিণামে ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয় ভিয়েতনাম। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনে ভিয়েতনামের সমগ্র অংশের মানুষ একপ্রকার দাসে পরিণত হয়েছিল। একমাত্র কায়ক্লেশে প্রাণধারণের অধিকারটুকু ছাড়া অন্যান্য সমস্ত মানবিক অধিকার ঔপনিবেশিক শাসনের নিপীড়নে পদদলিত হয়েছিল। ফরাসিদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্যই জ্ঞান আরোহণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষভাবে অর্জন করতে হো চি মিন ১৯১১ সালে বিদেশে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর।
● ● ●
হো চি মিনের জন্ম ১৮৯০ সালের ১৯ মে হোয়াং টু গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে। মা-বাবা তাঁর নাম রাখেন নগুয়েন টাট থান। বাবা ছিলেন ডক্টরেট উপাধিপ্রাপ্ত প্রতিভাধর মানুষ। বিদূষী ছিলেন মা-ও। ১৯০৮ সালে ভিয়েতনামে ফরাসি বিরোধী আন্দোলন কিছুটা দানা বাধে। সেই আন্দোলনের আবহেই হো চি মিনের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু। ওই কৈশোর বয়সেই তাঁর বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্বসূরীদের অনুসৃত পথের কোনোটাই দেশের মুক্তি অর্জনে তেমন কার্যকরী নয়। সেই পথের সন্ধানেই তাঁর বিদেশ যাত্রার সিদ্ধান্ত। একটি জাহাজের পাচকের সহকারী হয়ে তিনি বিদেশের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন। তাঁর গন্তব্য প্যারিস। এরপরে স্পেন, পর্তুগাল, আলজেরিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ, আমেরিকা, ব্রিটেন ঘুরে ফের ১৯১৭ সালে ফরাসি দেশে আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ভিয়েতনামিজ প্যাট্রিয়ট। সম্পূর্ণভাবে তিনি নিজেকে রাজনৈতিক কাজে নিয়োজিত করেন। এই সময়েই রাশিয়ায় ঘটে অক্টোবর বিপ্লব। এই বিপ্লব তাঁর ভাবনার জগতে বিশাল পরিবর্তন এনে দেয়।
অক্টোবর বিপ্লবের কিছুদিন পরেই শেষ হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৯ সালে ভার্সাইতে বসে শান্তি বৈঠক। অ্যাসোসিয়েশন অব ভিয়েতনামিজ প্যাট্রিয়টের পক্ষ থেকে সেই বৈঠকে হো চি মিন একটা দাবিপত্র পেশ করেন। যাতে আটটি দাবি করা হয়েছিল। ওই দাবিপত্রে হো চি মিন নগুয়েন আই কুয়োক নামে সই করেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এই দাবিপত্রকে গুরুত্বই দিলো না। হো চি মিন আবার উপলব্ধি করলেন, ভিয়েতনামবাসীদের নিজের শক্তিতেই নিজেদের মুক্ত করতে হবে।
এদিকে অক্টোবর বিপ্লব দেশে দেশে মুক্তি আন্দোলনে, শ্রমিক আন্দোলনে নতুন প্রাণসঞ্চার করল। ১৯১৯ সালে লেনিনের নেতৃত্বে তৈরি হলো কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত হলো লেনিনের ‘থিসিস অন দ্য ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোশ্চেন’। এই দলিল পড়ে হো চি মিন অভিভূত হলেন। যে পথের সন্ধানে তিনি এতোদিন দেশবিদেশে ঘুরেছেন, তার হদিস পেলেন। ‘The Path Which Led Me to Leninism’ প্রবন্ধে হো চি মিন লিখছেনঃ “এক কমরেড আমাকে লেনিনের ল্যুম্যানিতি প্রকাশিত ‘থিসিস অন দ্য ন্যশনাল অ্যন্ড কলোনিয়াল কোশ্চেন’ পড়তে দিলেন। ওই দলিলের রাজনৈতিক পরিভাষাগুলি বোঝা কঠিন ছিল। কিন্তু বারবার পড়ার ফলে শেষ পর্যন্ত এই দলিলের মর্মবস্তু গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। এই দলিল আমার মধ্যে আবেগ, উদ্দীপনা, স্বচ্ছ দৃষ্টি এবং আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করেছিল। আমি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। কোনো বিশাল সমাবেশকে সম্বোধন করার মতো করে আমার ঘরে আমি চেঁচিয়ে বলেছিলামঃ ‘প্রিয় স্বদেশবাসী! আমাদের যা প্রয়োজন এটা হলো সেই, এই হলো আমাদের মুক্তির পথ প্রদর্শক’!’’
● ● ●
সেই সময়ে ফরাসি শ্রমিকশ্রেণির পার্টি ছিল ফরাসি সোস্যালিস্ট পার্টি। ১৯২০ সালে তার ‘টুর’ কংগ্রেসে হো চি মিন অংশ নেন। কংগ্রেসে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। উপনিবেশগুলোর মুক্তি সংগ্রামকে সাহায্য করার আহ্বান জানান। সোস্যালিস্ট পার্টির এই কংগ্রেস থেকেই ফরাসি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়। প্রথমদিন থেকেই তিনি এই পার্টির সদস্য। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সাহায্যে সেদেশে বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে আসা দেশপ্রেমিকদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ইউনিয়ন অব কলোনিয়ান পিপল’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘লাপ্যারিয়া’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই সংবাদপত্রের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের নিষ্ঠুর নির্মম চরিত্রকে তুলে ধরেন। ভিয়েতনামে গোপনে এই সংবাদপত্রের প্রচার হতো। দ্রুতই এই সংবাদপত্র ভিয়েতনামের মানুষের মন জয় করে নিল। এই সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক, ম্যানেজার এবং সংগঠক সবই ছিলেন হো চি মিন নিজেই। এরপরের চার বছর তিনি গভীরভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অধ্যয়ন করেন। বুঝতে পারেন, “একমাত্র শ্রমিকশ্রেণিকে মুক্ত করেই জাতীয় মুক্তি সম্ভব এবং উভয়বিধ মুক্তি হলো কমিউনিজম ও বিশ্ববিপ্লবের কাজ।”
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যশনালের পঞ্চম অধিবেশনে যোগ দিতে ১৯২৪ সালের জুন মাসে মস্কোয় আসেন হো চি মিন। এর কিছুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে লেনিনের। লেনিনের মৃত্যুর পর প্রাভদায় ১৯২৪ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘লেনিন ও উপনিবেশের জনগণ’ শীর্ষক একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লেখেন হো চি মিন। তাতে তিনি লেখেনঃ ‘‘আমরা একথা বিশ্বাস করি যে, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যশনাল ও তার শাখাগুলি - যার মধ্যে ঔপনিবেশিক দেশগুলির শাখাও রয়েছে - আমাদের মহান নেতা আমাদের জন্য যে শিক্ষা ও উপদেশ রেখে গেছেন তা কাজে পরিণত করতে সক্ষম হবো। তিনি যে উপদেশ দিয়ে গেছেন সেই মতো কাজ করে যাওটাই কী তাঁর প্রতি আমাদের প্রীতি জানানোর সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নয়?
তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন আমাদের পিতা, শিক্ষক, কমরেড ও উপদেষ্টা। আর আজ তিনি আমাদের নিকট সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথপ্রদর্শক ধ্রুবতারা।”
আন্তর্জাতিকের পঞ্চম অধিবেশনে যোগ দিয়ে কিছুদিন থাকার পর হো চি মিন চীনের ক্যান্টন বন্দরে আসেন। এখানে তিনি ‘লে থুয়ে’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। ক্যান্টনে তিনি ইন্দোচীন থেকে আসা কয়েকজন দেশপ্রেমিক যুবককে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। তাদের দেশে পাঠালেন প্রচারকার্য চালানোর জন্য। গড়ে উঠল ভিয়েতনাম বিপ্লবী যুব সমিতি। ১৯২৫-২৭ সালে এই যুব সমিতির কাজের বিরাট ব্যাপ্তি ঘটে। এই যুব সমিতি ভেঙে দু’টি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। সেসময় ভিয়েতনামে আরও একটি কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব ছিল। ১৯৩০ সালে কৌলুন (হঙকঙ)-এ এই তিন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন ডাকেন হো চি মিন। এই সম্মেলন থেকেই ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়। প্রসঙ্গত, হো চি মিন সারা জীবনে মোট কতগুলি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন তা এখনও জানা যায়নি। তাঁর ১৬৯টি ছদ্মনামের হদিশ পাওয়া গেছে। আরও ১৭টি নাম তারই ছিল বলে মনে করা হয়।
● ● ●
ভিয়েতনাম ভয়াবহ বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ১৯২৯-৩৩ সালে। এই সময় বিপ্লবী আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৩০-৩১ সালের বিপ্লবী অভ্যুত্থান ও ‘সি তিন’ সোভিয়েত ভিয়েতনামের বিপ্লবী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হঙকঙে থাকার সময়ে ১৯৩২ সালে ব্রিটিশরা হো চি মিন-কে গ্রেপ্তার করে। ১৯৩৩ সালের বসন্তকালে হো চি মিন মুক্ত হন। ১৯৩৬ সালে ফরাসি দেশে পপুলার ফ্রন্ট সরকার তৈরি হয়।এই সরকারের প্রধান শক্তি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। ফলে ভিয়েতনামে বিপ্লবী আন্দোলন জোরদার হলো। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হলো বিশ্বযুদ্ধ। ভিয়েতনামে ফরাসিরা কঠোর হাতে দমন করতে লাগল জনগণের আন্দোলনকে।
ফ্যাসিস্ত জার্মানি ১৯৪০ সালের জুন মাসে ফরাসি দেশ দখল করে। জার্মানির সহযোগী জাপান এই সুযোগে ভিয়েতনাম দখল করে নিল। কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করলঃ ফরাসি উপনিবেশবাদ এবং ফ্যাসিস্ত জাপান উভয়ই আমাদের শত্রু। এই উভয় শত্রুর বিরুদ্ধে একযোগে আমাদের লড়াই করতে হবে। পার্টি আহ্বান জানালোঃ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণকে সংগঠিত ও শিক্ষিত করতে হবে, আর তাতে নেতৃত্ব দিতে হবে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টিকে। ১৯৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরলেন হো চি মিন। নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন বিপ্লবী আন্দোলনের। তারপর প্রায় সাড়ে তিন দশক তিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করেছে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি।
ভিয়েতনামে গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী আন্দোলন খুব জোরদার হয়ে ওঠে। পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হো চি মিনের নির্দেশে জেনারেল গিয়াপের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম মুক্তি বাহিনীর প্রচার স্কোয়াড গঠিত হয়।এদিকে ১৯৪৫ সালের প্রথমদিক থেকে বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্তির দিকেই এগোচ্ছিল। জার্মানি, ইতালি আত্মসমর্পণ করল। ১৯ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণ করল রাশিয়ার কাছে। ওই দিনই ভিয়েতনামের গণকংগ্রেসে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত হয়। হ্যানয় সফল অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আগস্ট বিপ্লব জয়যুক্ত হলো। ২ সেপ্টেম্বর রাজধানী হ্যানয়ে অস্থায়ী সরকারের পক্ষে হো চি মিন স্বাধীনতা সনদ পাঠ করেন। ১৯৪৬ সালের ৬ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২ মার্চ নবনির্বাচিত আইনসভার পূর্ণ অধিবেশনে হো চি মিন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
● ● ●
কিন্তু ফরাসিরা ফের ভিয়েতনামের ওপর অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করল। আবার শুরু হলো দীর্ঘ প্রতিরোধ সংগ্রাম। গেরিলা যুদ্ধের সাথে ছোটো বড়ো লড়াইও চলতে থাকল। শেষে ১৯৫৪ সালের ৭ মে টানা ৫৫ দিনের লড়াইয়ে দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধে ফরাসিরা পরাজিত হলো। যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের পর ১৯৫৪ সালের ২০ জুলাই জেনেভা সম্মেলনে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা ও শান্তি সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১৯৫৪ সাল থেকেই ভিয়েতনামের দক্ষিণাঞ্চলে ফরাসিদের ছেড়ে আসা স্থান মার্কিনীরা দখল করতে শুরু করে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের জনগণ ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর লিবারেশন তৈরি করে মার্কিনী দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে পুতুল সরকারের সঙ্গে মার্কিনীরা আতাঁত গড়ে তোলে। এ সরকারকে বকলমে তারাই তৈরি করেছিল। মার্কিনীরা দক্ষিণে সীমাবদ্ধ যুদ্ধ এবং উত্তরে বিধ্বংসী যুদ্ধের সূচনা করে। এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৬৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কমরেড হো চি মিন মারা যান।
সারা বিশ্বের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষ হো চি মিনের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন। ১২১ টা দেশ থেকে ২২ হাজারেরও বেশি টেলিগ্রাম ও চিঠিতে শোকবার্তা এসেছিল।
● ● ●
হো চি মিন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে পার্টি সম্পর্কেও মূল্যবান মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তিনি বলেছেনঃ “ঐক্য আমাদের পার্টি ও জনগণের একটি সর্বাধিক মূল্যবান ঐতিহ্য।কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে নিচের সেল পর্যন্ত সমস্ত পার্টি কমরেডকে পার্টির অভ্যন্তরে এই ঐক্য এবং চিন্তার অভিন্নতাকে চোখের মণির মতো অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
সংহতি ও ঐক্য বিকশিত করার সর্বোত্তম উপায় হলো পার্টির অভ্যন্তরে প্রশস্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং নিয়মিতভাবে ও গুরুত্ব সহকারে আত্মসমালোচনা ও সমালোচনার অনুশীলন। কমরেডসুলভ প্রীতি পার্টির মধ্যে বিরাজ করা উচিত।”
এই শিক্ষা শুধু ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির কাছেই নয়, পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সমানভাবে মূল্যবান।
কমরেড হো চি মিনের ১৩২তম জন্মদিবসে এই মহান বিপ্লবীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রেণিশত্রুদের সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম লৌহদৃঢ় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই।