E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২০ মে, ২০২২ / ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি

ত্রিপুরায় অস্তিত্বের সংকটে বিজেপি জোট সরকার

মুখ্যমন্ত্রী বদল করে প্রসাধনী প্রলেপ!

হারাধন দেবনাথ


ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনের ১০ মাস আগে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার থেকে বিপ্লব কুমার দেবকে সরিয়ে ডাঃ মানিক সাহাকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করা হয়েছে। ডাঃ মানিক সাহা সম্প্রতি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে ‘ভিশন ডকুমেন্ট’-এ মনোলোভা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার গড়েছিল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব সকল প্রতিশ্রুতি মানুষকে বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবের মুখ দেখেনি। কোনো নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। কাজ-খাদ্য সংকট, নিরাপত্তাহীনতা, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপের ফলে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত। চুরি-ডাকাতি, নারী নির্যাতনের নৃশংসতা বেড়েছে। অপরাধ জগৎ, নেশার কারবার বাড়বাড়ন্ত। এরকম একটি দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে মানুষের ক্ষোভ যাতে লড়াইয়ের ময়দানে সংহত না হতে পারে তার জন্য বিভাজনের রাজনীতির সঙ্গে গণতন্ত্র নিধন যজ্ঞ চলছে। ফ্যাসিস্তসুলভ রাজত্বে জনগণের ক্ষোভ, ক্রোধ, দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেই মুখ্যমন্ত্রী বদল করা হয়েছে। মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় বিজেপি দলের। কৌশলী চালে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে না।

রাজ্যের মানুষ শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ে নামছেন। ১০ জন লোককে প্রশ্ন করলে প্রকাশ্যে অন্তত সাতজন বলছেন - বিজেপি সরকার চাই না। শাসকদলের অভ্যন্তরেও কোন্দল প্রকাশ্যে আসছে। গোষ্ঠী কোন্দলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। বিজেপি বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রী সুদীপ রায় বর্মন, বিধায়ক আশিস সাহা সহ তিনজন বিজেপি ছেড়েছেন। শাসক দলের শরিক আইপিএফটি’র এক বিধায়ক পদত্যাগ করলেও তার সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বিপ্লব দেবের মন্ত্রীসভায় থাকা আইপিএফটি’র এক বিধায়ককে নতুন মন্ত্রীসভায় নেওয়া হয়নি। তাকে বহিষ্কার করা হবে বলে দলের সুপ্রিমো এন সি দেববর্মা জানিয়েছেন।

ব্যর্থ সরকার

সরকারের মেয়াদ শেষ হবার মাত্র কয়েক মাস আগে ত্রিপুরায় বিজেপি’র মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আসলে এক স্পষ্ট স্বীকারোক্তি যে, সেখানে বিজেপি’র রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এক বিবৃতিতে একথা বলেছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।

পলিট ব্যুরো বলেছে, প্রশাসন মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করা হয়নি। সরকারের তীব্র জন‍‌বিরোধী নীতির ফলে জনগণের ওপর বেনজির অর্থনৈতিক বোঝা চেপে বসেছে। বিজেপি সরকার যে সন্ত্রাস এবং হিংসার রাজনীতিতে নেমেছে তার ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, নির্বাচনগুলো প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের মুখে ধ্বংস হয়েছে সাংবিধানিক অধিকার ও আইনের শাসন।

পলিট ব্যুরো বলেছে, এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তনের মতো গিমিক দিয়ে সরকারের চরম ব্যর্থতাকে মুছে ফেলা যাবে না। ত্রিপুরার জনগণ বিজেপি’কে শিক্ষা দেবেন।

আস্থা ও বিশ্বাস নেই

বিজেপি জোট সরকারের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণা বাড়ছে। তৈরি হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার সংকট। মুখ পালটে কী হবে? নীতির পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। বলেছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বদল নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি।

সরকারের মেয়াদ শেষ হবার প্রায় ১০ মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী বদল সরকার ও শাসকদলের পক্ষে চরম দুর্বলতার নিদর্শন। এ নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। গত ৫০ মাসে একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও কার্যকর করেনি তারা। বরং এগুলি নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয়েছে উলটো পালটা কথা বলার চেষ্টা হয়েছে। কোনো প্রতিশ্রুতির ধারে কাছে যায়নি। একেবারে উলটো কথাবার্তা বলার চেষ্টা হয়েছে। বিষয়গুলি তুলে ধরে মানিক সরকার বলেছেন - বাজেট, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে এই সময় পর্যন্ত এই সরকার যা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সবক’টিই জনস্বার্থের সাথে সম্পর্কহীন। তাদের নেওয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলি চূড়ান্তভাবে জনবিরোধী। গ্রাম-শহরের গরিব ও শ্রমজীবী অংশের মানুষের জীবনে চরম অর্থনৈতিক সংকট নামিয়ে এনেছে। এতে কোনো হেলদোল নেই। জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার তিলে তিলে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল কোভিডের সময় তা ভেঙে চৌচির করে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি ও সরকার সমার্থক হয়ে গেছে। রেগার হিসাব দিতে পারছে না রাজ্য সরকার। কেন্দ্রের সরকারই বলছে এ কথা। পরোক্ষে তাদের উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে - রেগায় পুকুর চুরি নয়, নদীর মতো চুরি হয়েছে। এই সরকারের পারফরম্যান্স শূন্য।

তিনি বলেন, বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন দুপুরের পর থেকে অভাবনীয় সন্ত্রাস শুরু করে বিজেপি। সেই সন্ত্রাস পর্যায়ক্রমে ফ্যাসিস্তসুলভ সার্বিক সন্ত্রাসের চেহারা নিয়েছে। সংবিধান কাজ করছে না ত্রিপুরায়। তার জ্বলন্ত নিদর্শন হচ্ছে বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যে ভোট হলো কোথায়? তথাকথিত জয়ের নাম করে উৎসব করছে এরা। সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত হয়েছে প্রতিটি নির্বাচন। মানুষ স্বাধীনভাবে, নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করার অপপ্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। নাগরিক স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই। বেঁচে থাকার অধিকারই নেই এখানে। বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিরোধী দলের তরফ থেকে, বিধায়কদের তরফ থেকে বারবার যাওয়া হয়েছে। চিঠিপত্র দেওয়া হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য, নিন্দা, দুঃখপ্রকাশ করতে শোনা যায়নি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। সংবাদমাধ্যম নানাস্তরে আক্রান্ত হচ্ছে। শারীরিকভাবে কম করে ৪০ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। কোনো দুঃখপ্রকাশ আছে? খুন, অপরাধজনিত ঘটনায় পুলিশ কাঠপুতুল। আইনের শাসন কোথায়? জঙ্গলের শাসন চলছে। রাজপথে প্রতিদিন বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ১-২জন করে মহিলার মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাদকের ভাণ্ডার হয়ে গেছে ত্রিপুরা। ফেন্সিডিল থেকে গাঁজা চাষ কারা করছে? কে জানে না এগুলি!

বিরোধী দলনেতা বলেন, সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। ক্ষোভ বাড়ছে। ঘৃণা বাড়ছে। এরকম জায়গায় বিজেপি বুঝতে পারছে মাটি প্রচণ্ড গরম হয়ে গেছে। মানুষ সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। এই জায়গায় অস্তিত্ব রক্ষার সংকট তৈরি হয়েছে। মুখ বদল করে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আবার বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছে। এই পথে তারা যা করতে চাইছেন তা করতে পারবেন যদি মনে করেন তাহলে ভুল ভাবছেন বিজেপি নেতৃত্ব। ত্রিপুরার মানুষ এত বোকা নন। মুখ পালটে কী হবে? নীতি পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ চায় শান্তি, গণতন্ত্র। চায় সংবিধান ঠিকমতো লাগু হোক। ভোটাধিকার চায়। নাগরিক অধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, কাজ-খাদ্য ও রোজগারের গ্যারান্টি চায়। জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ চায়। দুর্নীতি, লুণ্ঠন বন্ধ হোক চায়। এগুলি না করে মুখ পালটে কী হবে?

মানিক সাহাকে মুখ্যমন্ত্রী করা নিয়ে বিরোধী দলনেতা বলেন, যাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে তিনিই তো বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি ছিলেন। তিনিই সরকার চালানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ সমস্ত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে তাকেও তো দেখা যায়নি সভাপতি থাকাকালীন কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে। যে কারণে তাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে এটা করে পার পাবে না। মানুষ এতে সন্তুষ্ট নয়। তারা বলতে শুরু করেছেন এই কৌশল করে নিজেদের ব্যর্থতা, দুর্বলতা, জনবিরোধী ভূমিকা এবং লুণ্ঠনরাজ যেভাবে চালাচ্ছেন, রাজ্যকে শ্মশানে পরিণত করেছেন এর থেকে বাঁচবেন যদি মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। মানুষ নজর রাখছেন। সামনের দিনে মানুষই সিদ্ধান্ত নেবেন। সরকার ও শাসকদলকে তারাই শিক্ষা দেবেন। এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

মুখ্যমন্ত্রীর শপথ বয়কট করা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বিরোধী দলনেতা বলেন, আমরা কী করে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাবো? রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ পার্টি অফিস এখনও বন্ধ। কয়েকশ’ কর্মী যেতে পারছেন না এলাকায়। বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু আমাদের কথা বলছি না। সব বিরোধী রাজনৈতিক দল আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের জন্য কথা বলতে চাইলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করছে। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা আছে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাস, স্বৈরাচার, একদলীয় শাসন চলছে। আরেকদিকে চলছে অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাভিচার ও জনবিরোধী ভূমিকা। চলছে জুলুমবাজি, লুঠতরাজ। এই পরিস্থিতিতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গেলে আমাদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কী বার্তা যেত? কী করে যাব আমরা? এই কারণগুলিতেই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ জানিয়ে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের দূরে রেখেছি আমরা। বয়কট করেছি। এটা ব্যক্তিগত বিরোধিতা নয়, নীতিগত অবস্থানের প্রশ্ন।

বয়কট

নতুন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করল সিপিআই(এম)। পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এ সম্পর্কে বলেছে, ত্রিপুরা রাজ্যের বুকে চলতে থাকা ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাস, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার অপপ্রয়াস, গণতন্ত্র হরণ, নাগরিক স্বাধীনতা হরণ, ভোট দেবার অধিকার হরণ, সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আক্রমণ, একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম, সাধারণ মানুষের কাজ- রোজগার-খাদ্যের অভাবনীয় সমস্যা, মুখ থুবড়ে পড়া উন্নয়নের কাজ, পানীয় জল-বিদ্যুৎ-সেচ-বিপর্যস্ত সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে চরম অব্যবস্থা, নিত্য বৃদ্ধি হয়ে চলা ভোগ্যপণ্য সামগ্রীর মূল্য, চলতে থাকা বে-আব্রু দুর্নীতি ইত্যাদির প্রতিবাদে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী নতুন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

ডাবল ইঞ্জিন সরকারের চার বছরে ত্রিপুরায় রেগা প্রকল্পের তহবিলের প্রারম্ভিক জেরে ৪৩৯ কোটি ৭১ লক্ষ ১৯ হাজার টাকার গরমিল বেরিয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এম আই এস পোর্টালের মাধ্যমেই এই তথ্য জনসমক্ষে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর রেগার তহবিলে ওপেনিং ব্যালেন্স-এর পরিমাণ কম করে দেখানো হয়েছে। কেন এই গরমিল? এ কী শুধুই হিসাবের গরমিল নাকি প্রকল্পের শয়ে শয়ে কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে? উঠছে এই গুরুতর প্রশ্ন।

২০১৮-১৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ অর্থ বছর পর্যন্ত রেগার বাৎসরিক ‘ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট’-এ নজর রাখলে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবার জোগাড়। আগের অর্থ বছরের তহবিলে আসা মোট অর্থ থেকে ব্যয় বাদ দিলে যেটুকু বাকি থাকে সেটা পরের বছরের প্রারম্ভিক জের অথবা ‘ওপেনিং ব্যালেন্স’ হিসাবে আর্থিক খতিয়ানে ওঠার কথা। হিসাবশাস্ত্রে অন্তত সাধারণভাবে এই নিয়মই অনুসরণ হয়ে আসছে। কিন্তু ত্রিপুরার বেলায় এই নিয়ম যেন অকেজো! ২০১৯-২০ সাল থেকে প্রতি বছর ওপেনিং ব্যালেন্সে কয়েকশো কোটি টাকা কম করে দর্শানো আছে এম আই এস-এ।

তার একটা নমুনা দেখতে হলে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বার্ষিক আর্থিক বিবরণ কিংবা ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টে নজর দিতে হবে। ওপেনিং ব্যালেন্স-এর সাথে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ যোগ করার পর তা থেকে বার্ষিক ব্যয় বাদ দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা পরের বছর ওপেনিং ব্যালেন্স হবার কথা ছিল। কিন্তু আদতে তা হয়নি। ২০১৮-১৯ সালের এম আই এস অনুসারে সে বছর ওপেনিং ব্যালেন্স ছিল ৬৪৬ কোটি ৫০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার ওই বছর বরাদ্দ করেছে ৪৪২ কোটি ৫৪ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। ওই বছরে ৫৫৬ কোটি ৬৫ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকা ব্যয় করতে পেরেছে রাজ্য সরকার। সে হিসাবে ২০১৮-১৯ বছরের ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট অনুসারে বছরের শেষের জের বা ক্লোজিং ব্যালেন্স ছিল ৫৩২ কোটি ৩৮ লক্ষ ৬৮ হাজার টাকা। এই টাকাটা ২০১৯-২০ অর্থ বছরের ওপেনিং ব্যালেন্স হবার কথা ছিল। কিন্তু সে বছর ওপেনিং ব্যালেন্স হিসাবে দেখানো হয়েছে মাত্র ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ কম দেখানো হয়েছে ৫২৭ কোটি ৭৯ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা। জনসমক্ষে তথ্য প্রকাশের সময় কেন এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কমিয়ে দেখানো হয়েছে? কোথায় গেছে সেই টাকা? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য গভীর ও নিবিড় তদন্তের প্রয়োজন বলে মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল।

হিসাবে গরমিল শুধু একটি অর্থ বছরেই আটকে থাকেনি। একইরকমভাবে ২০১৯-২০ সালের এম আই এস অনুসারে বৎসরান্তের জের কিংবা ক্লোজিং ব্যালেন্স ছিল ৪১০ কোটি ৩৭ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। স্বভাবিক নিয়মে এই অঙ্কটাই পরের বছরের শুরুতে হিসাবের ওপেনিং ব্যালেন্স অথবা প্রারম্ভিক জের হিসাবে আসার কথা। কিন্তু ২০২০-২১ সালের ওপেনিং ব্যালেন্স হিসেবে ২৬ কোটি ১৫ লক্ষ ০৪ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ হিসাবে কম দেখিয়েছে ৩৮৪ কোটি ২২ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা।

তেমনি ২০২০-২১ সালে বছর শেষের জের ৫২০ কোটি ১০ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা থাকার কথা। ২০২১-২২ আর্থিক বছরের ওপেনিং ব্যালেন্স হিসাবে তা হিসাবে আসার কথা। কিন্তু ২০২১-২২ আর্থিক বছরে রেগার ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টে রাজ্যে ওপেনিং ব্যালেন্স দেখিয়েছে ৬৮ কোটি ৫৫ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৪৫১ কোটি ৫৫ লক্ষ ১৯ হাজার টাকা কম দেখানো হয়েছে। একইরকমভাবে ২০২১-২২ আর্থিক বছরে বছর শেষের জের যা ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ওপেনিং ব্যালেন্স হবার কথা, সেখানেও কম দেখানো হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের প্রারম্ভিক জের ১১ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা দেখানো হয়েছে। যা আগের বছরের বছর শেষের জেরের চেয়ে ৪৩৯ কোটি ৭১ লক্ষ ১৯ হাজার টাকা কম।

এই বিপুল পরিমাণ টাকা গেলো কোথায়? এই গরমিলের পেছনে কোনো অভিসন্ধি কী লুকিয়ে আছে? চার বছর ধরে এই গরমিল সরকারের নজরে এলো না! বিস্ময় ও প্রশ্ন জাগছে। রেগায় হিসাবে এতো বিশাল পরিমাণ অর্থের অসঙ্গতির বিষয়টি বিগত চার বছরে গ্রামোন্নয়ন তথা অর্থ দপ্তরের মন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মনের নজরে কী এসেছিল? তিনি কী কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? জবাব চায় জনগণ।

রেগা সমেত কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলোর রূপায়ণ নিরীক্ষার জন্য সোশ্যাল অডিটের ব্যবস্থা আছে। এত বিশাল পরিমাণ অর্থের অসঙ্গতি সোশ্যাল অডিটের নজর এড়াল কীভাবে? নাকি জেনে শুনেই রেগার এই বিশাল পরিমাণ আর্থিক অসঙ্গতি ধামাচাপা দিতেই কী নিয়ম ভেঙে অবসরপ্রাপ্ত আমলা সুনীল দেববর্মাকে সোশ্যাল অডিট ইউনিটের অধিকর্তা পদে আসীন করা হয়েছে? সরকার যেমন প্রশ্নের ঘেরাটোপে তেমনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও এর বাইরে থাকতে পারেন না। তিনি কী রেগার এই শত শত কোটি টাকা নয়ছয়ের ঘটনা জানেন? এই বিষয়গুলি কী মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে রয়েছে? সোশ্যাল অডিট অধিকর্তা সুনীল দেববর্মার অবৈধ নিয়োগ এবং তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী করেছেন?

রেগার এই শত শত কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও গরমিলের তদন্তের প্রয়োজন বলে মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল।