৫৮ বর্ষ ১৪শ সংখ্যা / ২০ নভেম্বর ২০২০ / ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসান
বাংলার বুদ্ধিদীপ্ত সংস্কৃতি জগতে মহীরুহ পতন
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দীর্ঘ লড়াই শেষে অভিযান থেমে গেল কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। টানা ৪১দিন নানা জটিল রোগের সাথে লড়াইয়ের পর ১৫ নভেম্বর দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট নাগাদ তাঁর জীবনদীপ নিভে যায়। চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয়, কবিতা রচনা, আবৃত্তি ও ছবি আঁকা প্রভৃতি সৃষ্টির নানা অঙ্গনে অনায়াস বিচরণ করেছেন তিনি। একইসঙ্গে সামাজিক চেতনায় উজ্জ্বল জীবনবোধের পরিচয় রেখে ৮৫ বছর বয়সে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়, কন্যা পৌলমী ও পুত্র সৌগতকে। এদিন সন্ধ্যায় গান স্যালুট শেষে কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
৫ অক্টোবর করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি বেলভিউ নার্সিংহোমে ভরতি হয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত তিনি অভিনয় করে গেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। সপ্তাহখানেকের চিকিৎসায় তিনি করোনা মুক্ত হলেও, অন্যান্য নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি হয় তাঁর। শেষ কয়েক সপ্তাহ ধরে শারীরিক প্রবল টানাপোড়েন চলে এবং চিকিৎসকরা তাঁকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিতে বাধ্য হন। এভাবে কখনো ভালো, কখনো মন্দের প্রহর শেষে চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
বিশিষ্ট অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বামপন্থী নেতৃবৃন্দ শোকজ্ঞাপন করেছেন। শোকপ্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এছাড়াও শোকপ্রকাশ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতি জগৎ সহ নানা অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
১৫ নভেম্বর দুপুরে বেলভিউ নার্সিংহোম থেকে প্রয়াত শিল্পীর মরদেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর গল্ফগ্রিনের বাসভবনে। সেখান থেকে মরদেহ আনা হয় টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। তারপর মরদেহ নিয়ে এসে শায়িত রাখা হয় রবীন্দ্রসদনে। সর্বত্রই অগণিত মানুষ, শিল্পী, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ফুল-মালায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রবীন্দ্রসদনে প্রয়াত শিল্পীর মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী, আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য সহ রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ এবং শিল্প-সংস্কৃতি জগতের মানুষেরা। এছাড়াও এখানে এসে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শিল্পীর অগণিত গুণমুগ্ধ।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রবীন্দ্রসদন থেকে কেওড়াতলা শ্মশান অভিমুখে শুরু হয় শোকমিছিল। করোনা মহামারী সংক্রমণের ভয়াবহ আবহে এদিনের এই শোকমিছিল ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধিকে যথাসম্ভব মেনে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে অগণিত মানুষ পা মেলান শোকমিছিলে। এই শোকমিছিলে অংশ নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, সুজন চক্রবর্তী, মনোজ ভট্টাচার্যের পাশাপাশি রাজ্যের মন্ত্রী, চলচ্চিত্র, নাটক, সাহিত্য-সংস্কৃতি সহ সমাজের নানা ক্ষেত্রের বিপুল অংশের মানুষ।
প্রিয় অভিনেতার প্রতিকৃতি নিয়ে পথ হাঁটেন তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ এবং তরুণ-তরুণীরা। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ শোকমিছিল পৌঁছায় কেওড়াতলা শ্মশানে। সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট জানানো হয় প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেতাকে। তারপর কন্যা, পুত্র ও অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনের উপস্থিতিতে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। এর মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি হয় বাংলা সংস্কৃতিজগতের অনন্য ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল অভিযাত্রা।