E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৪শ সংখ্যা / ২০ নভেম্বর ২০২০ / ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের জীবনাবসান


বিশিষ্ট কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত চিরবিদায় নিলেন। থাকতেন জার্মানির হাইডেলবার্গে। সেখানেই ১৭ নভেম্বর ভারতীয় সময় গভীর রাতে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। বয়স হয়েছিল ৮৭।

প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন বিশ্ব নাগরিক। জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৩ সালে। কৈশোরে শান্তিনিকেতনে পড়ার সময়ে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, ইন্দিরা দেবীচৌধুরানির সংস্পর্শে এসেছিলেন। বিশ্ববোধের ভাবনা তখন থেকেই সম্পৃক্ত হয়ে যায়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরে ১৯৫৭ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। বাংলা ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়াতেন। ১৯৭২-এ হুমবোল্ট ফেলোশিপ নিয়ে তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। সেখানেই একটানা পড়িয়েছেন তিনি।

প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ‘যৌবন বাউল’ বাংলা কবিতার পাঠকের নজর টেনে নেয়। ভাষার বৈচিত্র্য, কারুকাজ, ছন্দের নকশায় অলোকরঞ্জন এক জগৎ তুলে ধরতে থাকেন পাঠকের সামনে। সেই জগতে আছে বাংলার গ্রাম, প্যালেস্তাইনের শরণার্থী শিবির, সান্তা মারিয়া হাসপাতাল, ছৌ থেকে কাবুকি। কলম কৃপণ করেননি কখনও, এমনকি দুর্বোধ্যতার সমালোচনা সত্ত্বেও। ‘যৌবন বাউল’-এর বিভাব কবিতায় লিখেছিলেনঃ ‘একটি মাত্র রাখাল যাক, / এ মাঠ একলা পড়ে থাক / নীরবে, আমি এ মাঠ ছাড়বো না’। ছাড়েননি। তবে কবিতার শরীরে চকিতে পারাপার করেছেন ব্যাপ্ত সংসারের খণ্ডচিত্র থেকে মূহূর্তে বিশ্বভরা নিঃশ্বাসে। বহুমাত্রিকতা ছিল তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যুদ্ধ ও সংঘাতে বিপর্যস্ত পৃথিবীকে মায়াময়তায় ঘিরে দেখতে চাইতেন তিনি।

অলোকরঞ্জন অবশ্য অসুন্দরকে আঘাত করেছেন। অলোকরঞ্জন বিশ্বাস করতেন মৌলবাদ আমাদের গ্রহের মূল ব্যাধি। সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতা ও ধনলোভের দিকেও তাঁর অব্যর্থ তর্জনী। তিনি দেখেছিলেন জর্জ বুশের উদ্যোগে সাদ্দাম হত্যার অভিযানকালে কত গুণী কবি লেখক তাঁদের লেখা থামিয়ে দিয়েছেন। অথবা কত ভাবুক ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দেশ। গিলোটিনে আলপনায় তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘দেশ না শরীর নাকি সত্তা কেউ জানে না, তার / পার্শ্বচর বিদূষকের হাতে রক্ত, রক্ত এত, এত রক্ত কেন?’ সে প্রশ্নটা যে নিয়ত বেজেই চলেছে অহরহ অগণন। সমাজতন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয়ের সময়ে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, মার্কসকে বাদ দিয়ে এই শতাব্দী ভাবতেই পারি না।

তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ কোজাগরী, প্রতিদিন সূর্যের পার্বণ, রক্তাক্ত ঝরোখা, ছৌ কাবুকির মুখোশ, লঘুসংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে, মরমি করাত, গিলোটিনে আলপনা, নদী ও রাত্রি বণ্টন হয়ে গেলে, আয়না যখন নিঃশ্বাস নেয়, এক-একটি উপভাষায় বৃষ্টি পড়ে, রক্তমেঘের স্কন্দপুরান। সোফোক্লেসের আন্তিগোনে, হ্যেল্ডারলিন, হাইনে, রিলকে, ব্রেখটের কবিতার পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন সুরদাস। বাংলা থেকে জার্মানে অনুবাদ করেছেন অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, গান। পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি, রবীন্দ্র পুরস্কার, জার্মানির গ্যেটে পুরস্কার। তাঁর স্ত্রী টুডবার্টা দাশগুপ্ত আগেই প্রয়াত হয়েছেন।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের জীবনাবসানে শোক জ্ঞাপন করে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, বাংলা ভাষার অন্যতম অগ্রণী কবি, অনুবাদক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের জীবনাবসানে আমি গভীর শোকাহত। তাঁর কবিতার জগতে একদিকে দেশের মানুষের জীবনযাপনের স্পর্শ ছিল, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভাবনায় ভরপুর ছিল। বারবার ফিরে এসেছে ঘরহারা মানুষের কথা, দুনিয়াজুড়ে শরণার্থীদের কথা, মানবতার কথা। জার্মান ভাষাতেও তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বহু অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যের বড়ো ক্ষতি।