৫৮ বর্ষ ১৪শ সংখ্যা / ২০ নভেম্বর ২০২০ / ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের স্বার্থে ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান অতীব গুরুত্বপূর্ণ
শংকর মুখার্জি
আগামী ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট। আটটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ আহ্বানে এই ধর্মঘট। এই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি হলোঃ আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, সিআইটিইউ, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, এআইসিসিটিইউ এবং ইউটিইউসি। সাতদফা দাবি সংবলিত ধর্মঘটের দাবিসনদ। দেশের সরকারের কাছেই তাদের এই দাবি।
কৃষক-খেতমজুরদের সংগঠনগুলি, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী-শিক্ষকদের জাতীয় ফেডারেশনগুলি এবং বামপন্থী ছাত্র-যুব-মহিলাদের গণসংগঠনগুলিও এই ধর্মঘটে শামিল হচ্ছে। ধর্মঘটের দাবিসনদকে সমর্থন করেই এই অসংখ্য গণসংগঠন তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের দাবিগুলিকে তুলে ধরছে। ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানানো শুধু কৃষক-খেতমজুর সংগঠনের সংখ্যাই শতাধিক। দেশব্যাপী ধর্মঘটের প্রতি এই ব্যাপক সমর্থন সত্ত্বেও সঙ্ঘ পরিবারের ট্রেড ইউনিয়ন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এই ধর্মঘটে নেই। বরঞ্চ তারা ধর্মঘটের সক্রিয় বিরোধিতার পথেই হাঁটছে। যেমন ধর্মঘট-বিরোধী অবস্থান নিয়েছে তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়নও।
অতিমারীজনিত কারণে গত আট-নয় মাস এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে দেশের মানুষ। সরকারিভাবে লকডাউন প্রত্যাহৃত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছেঃ বর্তমানে ভারতে নাকি কোভিড সংক্রমণ পড়তির দিকে। তবুও দেশে সংক্রমিতের সংখ্যা ৯০ লক্ষ ছুঁয়ে ১ কোটির দিকে ধাবমান। ইতিমধ্যে মৃত্যুও ১ লক্ষ ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
দেশজুড়ে রেল-সড়ক পরিবহণ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক কাজকর্মও। কিন্তু দেশের মানুষের জীবনে ছন্দ ফেরেনি। অপরিকল্পিত লকডাউন দেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে। এমনিতেই ২০১৮ থেকেই আর্থিক বিকাশের হারে অবনমন চলছে। অতিমারীর আগে ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ - এই দুই আর্থিক বছরের আটটি ত্রৈমাসিকে ধারাবাহিকভাবে আর্থিক বিকাশের হার কমেছে। বাস্তবিক অর্থে মোদী জমানায় দেশের অর্থনীতিতে গত পাঁচ বছর ধরেই বিকাশের হারে অবনমন প্রত্যক্ষ হচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশে বেকারত্বের হার গত অর্ধশতাব্দীতে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। এই গভীর হতে চলা আর্থিক সঙ্কটকে সর্বব্যাপী করেছে লকডাউন।
চলতি আর্থিক বছরের (২০২০-২১) প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) দেশের জিডিপি সঙ্কুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। এর অর্থ, আগে যদি দেশে উৎপাদন ১০০ টাকা হতো, তাহলে সেই উৎপাদন কমে হয়েছে ৭৬ টাকার মতো। আর এই হিসেবে অসংগঠিত ক্ষেত্র নাকি ধরা ছিল না; যে ক্ষেত্রটা আমাদের দেশে বিশাল এবং ক্রমবর্ধনশীল। তা’হলে আর্থিক বিকাশের হারের অবনমনের চিত্র আরও শোচনীয় হতো। এমনকি চলতি আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেও বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব হলো সমগ্র ২০২০-২১-এ এদেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হবে ৯.৫ শতাংশ। আইএমএফ যেটা বলেছে ১০.৩ শতাংশ। এইসব তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি সঙ্কট থেকে মন্দা’য় প্রবেশ করেছে।
আর্থিক বিকাশের হার ঋণাত্মক হওয়ার অর্থই হলো দেশের সামগ্রিক উৎপাদন কম হওয়া। চলতি আর্থিক বছরে এপর্যন্ত উৎপাদন, পরিষেবা, নির্মাণ, পরিবহণ, বাণিজ্য, খনিতে বৃদ্ধি ঋণাত্মক। অর্থাৎ এরফলে এইসব ক্ষেত্রে নিয়োগও কম হয়েছে; শ্রমিক-কর্মচারীদের আয়ও হ্রাস পেয়েছে। ফলস্বরূপ হ্রাস পেয়েছে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও। একটা তথ্যে দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছেন। দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষুধা-অপুষ্টি বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান এখন ১০৪টি দেশের মধ্যে ৯৪’তে। ক্ষুধা-অপুষ্টি-ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস-বেকারত্ব সরাসরি প্রভাব ফেলেছে বাজারের উপর। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসই কেনার মতো পয়সা দেশের সিংহভাগ লোকের হাতে নেই। গোদের উপর বিষফোঁড়ার ন্যায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেট্রোল-ডিজেল সহ খাদ্যশস্য-সবজির আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। এসবই অবধারিতভাবে শিল্প উৎপাদন ও চাহিদাকে কমিয়েই চলবে। দেশের এই আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতি নজর নেই কেন্দ্রীয় সরকারের। তারা অতিমারী, লকডউনের সুযোগ নিয়ে শ্রমআইন, কৃষিআইন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইন সংশোধন করে দেশের মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে, তাদের একেবারে খাদের কিনারায় এনে ফেলেছে। বর্তমান সময়ে দেশের এই বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিই ধর্মঘটের দাবিসনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
●●●●
মন্দা থেকে দেশের অর্থনীতিকে বার করে আনতে হলে সর্বাগ্রে যেটা প্রয়োজন তা হলো চাহিদা বৃদ্ধি করা। একমাত্র সাধারণ মানুষের হাতে কেনাকাটা করার মতো টাকা এলেই এই চাহিদা বৃদ্ধি সম্ভব। যা শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে। কর্মচ্যুত হওয়া মানুষদের পুনর্নিয়োগ ঘটাবে। এই কারণেই খুব সঙ্গতভাবেই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি দাবি জানিয়েছেঃ ‘‘আয়কর দেয় না এরকম প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৭৫০০ টাকা করে দিতে হবে।’’ এর সাথে যদি বিনামূল্যে রেশন দেওয়া যেতে পারে, তাহলে নগদ পাওয়া পুরো অর্থই শিল্পপণ্য ক্রয়ে ব্যবহার করতে পারবে ওই পরিবারগুলি। তাই দাবিসনদে রয়েছেঃ ‘‘প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রতি মাসে বিনামূল্যে ১০ কেজি রেশন দিতে হবে।’’ প্রসঙ্গত, এই দুটি দাবিই বামপন্থী দলগুলি লকডাউনের সময় থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানিয়ে এসেছে। এখন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিও ধর্মঘটের দাবিসনদে এই দুটি দাবি অন্তর্ভুক্ত করল।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই দুটি দাবি পূরণের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এটা সত্য যে, প্রচুর অর্থের দরকার। কিন্তু এই অর্থের ব্যবস্থা করাটা কোনো শক্ত নয়। কেন না, প্রতি বছর বৃহৎ ব্যবসায়ী সংস্থা, কর্পোরেট ও ধনীদের বিভিন্নভাবে যে করছাড় দেওয়া হয় তা বন্ধ করলেই এই টাকার ব্যবস্থা করা অনায়াসে সম্ভব। আর কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনে টাকা ছাপাতে পারে; তাতে আমাদের দেশে খুব একটা মুদ্রাস্ফীতিও ঘটবে না, পরন্তু চাহিদা বৃদ্ধির ফলে আখেরে দেশের অর্থনীতিরই লাভ হবে। সবচেয়ে ইতিবাচক যেটা তা হলো, দেশের অর্থনীতি মন্দা থেকে বেরনোর একটা পথ খুঁজে পাবে। আসলে চোরে না শোনে ধর্মের কথা - কেন্দ্রীয় সরকার এই পরামর্শে কানই দিচ্ছে না। তারা সেই অতীতের মতোই হাজার হাজার কোটি টাকার তথাকথিত বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজের মাধ্যমে বৃহৎ ব্যবসায়ী সংস্থা ও কর্পোরেটদের মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতেই ব্যস্ত। কিন্তু এই পথে আর্থিক মন্দার কানাগলি থেকে বেরনোর পথ খুঁজে পাওয়া কখনই সম্ভব নয়।
আর রেশনের বিষয়টাও কেন্দ্রীয় সরকার খুব সহজেই কার্যকর করতে পারে, যদি তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। সরকারের নিজস্ব মজুতেই রয়েছে কয়েক কোটি টন খাদ্যশস্য। প্রায় বলতে গেলে এই খাদ্যশস্য গুদামে পচছে। বেশিদিন থাকার পর এই খাদ্যশস্য যখন মানুষের খাওয়ার অবস্থায় থাকবে না তখন পশুখাদ্যের জন্য এই সবই বিদেশে রপ্তানি করা হবে। ভালো অবস্থাতেও বিদেশি মুদ্রা অর্জনে এই খাদ্যশস্য পশুখাদ্যের জন্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। এ ঘটনাও অতীতে হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রায়শই বলতে শোনা যায়, তারা বিনামূল্যে দেশের মানুষকে রেশন দিচ্ছে। কিন্তু রেশনের জন্য খাদ্যশস্য ব্যবহারের যে তথ্য কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে তাতেই পরিষ্কার যে, দেশের সিংহভাগ মানুষই এই রেশনের আওতায় আসেনি। আর কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিনামূল্যে রেশনের সময়সীমাও কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হতে চলেছে।
বর্তমান সময়ে কাজের সবচেয়ে বেশি আকাল গ্রামাঞ্চলে। লকডাউন প্রত্যাহৃত হলেও বহু পরিযায়ী শ্রমিক এখনো পর্যন্ত কাজে ফিরতে পারেন নি। আসলে বহু শিল্প, বহু প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে, যেখানে এই পরিযায়ী শ্রমিকরা নিযুক্ত ছিলেন। দেশে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যার হিসাব কেন্দ্রের সরকারের কাছে নেই। তাই জানাও সম্ভব নয়, ঠিক কত পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়ে মূলত গ্রামে রয়ে গেছেন। গ্রামের কর্মহীন মানুষের সাথে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো এমজিএন রেগা প্রকল্পের সম্প্রসারণ। মোদী সরকার গত ছ’বছরে ধারাবাহিকভাবে এই প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে চলেছে। যার পরিণতিতে শ্রমদিবস এবং কাজ পাওয়া মানুষের সংখ্যা - দুই-ই হ্রাস পেয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবি হলোঃ ‘‘এই প্রকল্পের পরিসর বৃদ্ধি করে গ্রামীণ এলাকায় বছরে ২০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। শহর অঞ্চলেও প্রকল্পকে সম্প্রসারিত করতে হবে।’’
●●●●
আগেই বলা হয়েছে, এই অতিমারী এবং লকডাউনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক শ্রমিক বিরোধী, কৃষকবিরোধী আইন সংসদে পাশ করিয়েছে। এর পিছনে রয়েছে দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী, কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্ন। ২৩ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় তিনটি শ্রমকোড পাশ হয়। এগুলি হলো - পেশাগত নিরাপত্ত, স্বাস্থ্য ও শ্রমঅবস্থা সম্পর্কিত কোড; সামাজিক সুরক্ষা কোড এবং শিল্প সম্পর্কসমূহের কোড। এর মধ্য দিয়ে প্রায় সমস্ত শ্রমআইনকে সংশোধন করে তিনটি শ্রমকোডের মধ্যে নিয়ে আসা হলো। এই শ্রমকোডগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার কোনো ব্যবস্থাই আর অবশিষ্ট রইল না। এই শ্রমকোডগুলির মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের শোষণ করার অবাধ ছাড়পত্র দেওয়া হলো মালিকশ্রেণিকে। মোদী সরকার বলছে, এই শ্রমসংস্কারের ফলে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু অভিজ্ঞতা অন্য কথাই বলে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে কয়েক বছর আগেই বিজেপি শাসনে এ ধরনের শ্রম সংস্কার করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত কোনো আশাপ্রদ বিনিয়োগ সেখানে ঘটেনি। আসলে এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, এই শ্রম সংস্কারের মধ্য দিয়ে মালিকশ্রেণির মুনাফাকে বৃদ্ধি করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার।
দেশে উদার অর্থনীতি প্রয়োগে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটেছে কৃষিক্ষেত্রে। কৃষিকাজ করতে গিয়ে ঋণের বোঝায় সব খুইয়ে তিন লক্ষেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। মোদী জমানায় কৃষক আত্মহত্যার আর রেকর্ডও রাখা হয় না। কৃষি খরচ বৃদ্ধি, অভাবী বিক্রি, সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, ফসলের লাভজনক দাম না মেলা প্রভৃতি কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। দেশের কৃষি সঙ্কট মেটাতে গেলে এইসব দিকে নজর দেওয়ার দরকার ছিল। তার পরিবর্তে মোদী সরকার একাধিক এমন কৃষিআইন প্রণয়ন করল যাতে দেশের কৃষককুল বৃহৎ ব্যবসায়ী-কর্পোরেটদের কাছে তাদের উৎপাদন, তাদের জমি নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। এক কথায় দেশের মুমূর্ষু কৃষিব্যবস্থা আরও গভীর সঙ্কটে পড়বে। তাই ধর্মঘটের অন্যতম প্রধান দাবিই হলো ‘‘কৃষক বিরোধী আইনসমূহ এবং শ্রমকোডসমূহ বাতিল করতে হবে।’’
●●●●
দেশে উদার অর্থনীতির জমানা শুরু হওয়ার সময় থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ-বেসরকারিকরণ শুরু হয়েছে। মোদী সরকার একে আরও আগ্রাসীভাবে রূপায়ণ করছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের যে পরিমাণ সম্পদের বিলগ্নিকরণ হয়েছে তার ৬০ শতাংশই হয়েছে প্রথম মোদী সরকারের সময়ে। এই সরকার সিদ্ধান্তই নিয়েছে, কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র আর দেশে থাকবে না। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন সংস্থা, রেল, বন্দর, ব্যাঙ্ক-বিমার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করা হবে। এখন তারা নবরত্ন সংস্থা বিপিসিএল’র বেসরকারিকরণকে পাখির চোখ করেছে। সরকারের হাতে থাকা বিপিসিএল’র ৫২.৯৮ শতাংশ শেয়ার বেচার দরপত্র আহ্বান করেছে কেন্দ্র। এই বিলগ্নিকরণের মধ্য দিয়ে তাদের লক্ষ্য ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা তোলা। যে সংস্থা প্রতি বছর ৭-৮ হাজার কোটি টাকা করে লাভ করে, যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১.৪০ লক্ষ কোটি টাকা, তাকে এত কম টাকায় সম্পূর্ণ বিক্রি করে দেওয়া হবে। আসলে রাষ্ট্রের সম্পদ বেচার দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মোদী সরকার। এই আর্থিক বছরে তারা বিলগ্নিকরণের লক্ষ্য স্থির করেছে ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা।
বাম দলগুলি এবং বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি প্রথম থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের তীব্র বিরোধী। তারা মাঠে-ময়দানে নেমে এর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে যখন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ মঞ্চ গড়ে উঠল, সেই মঞ্চেরও অন্যতম প্রধান দাবি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ বন্ধ করতে হবে। সেই দাবি থেকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এখনো এক চুল সরেনি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট এই প্রতিরোধ আন্দোলনকে আরও শক্তি জোগাবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের পরিকল্পনার সাথেই এই সংস্থাগুলিতে যারা কাজ করছেন তাদের অবসর নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর জন্য দানবীয় আইনও আনা হয়েছে। এই দানবীয় আইন বাতিল এবং সকলের জন্য পেনশনের দাবিও রয়েছে ধর্মঘটের দাবিসনদে।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি যে সাত দফা দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে সেগুলি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এর সাথে দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষের স্বার্থ জড়িত। দেশের মানুষের রুটি-রুজির স্বার্থে এই আন্দোলনের চেয়ে বড়ো দেশপ্রেমিক কাজ আর কী হতে পারে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রুটি-রুজির স্বার্থ তখনই সুরক্ষিত হবে যখন মোদী সরকারকে আঘাত করা যাবে, তাদের নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করা যাবে। কোটি কোটি শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী-মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণে ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট সেই নীতি পরিবর্তনের লড়াইকেই আরেক ধাপ এগিয়ে দেবে।