৫৮ বর্ষ ১৪শ সংখ্যা / ২০ নভেম্বর ২০২০ / ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
শিক্ষকসমাজ ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী ধর্মঘট কেন সমর্থন করছে?
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়
জনবিরোধী দেশবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হচ্ছে। এই ধর্মঘটের আহ্বান করেছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনসমূহ। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কৃষক-খেতমজুর সংগঠনগুলি। তারা ওইদিন গ্রাম ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে দেশের কৃষিব্যবস্থা তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে। এই বন্ধ সমর্থন করেছে কর্মচারী ও শিক্ষক সংগঠনগুলির যুক্ত কমিটি ১২ই জুলাই কমিটি। এই আহ্বানকে বাস্তবায়িত করতে সংগঠক ও প্রচারকের ভূমিকা নিয়েছে বাম ও গণতান্ত্রিক ছাত্র-যুব ও মহিলা সংগঠনের সর্বস্তরের সংগঠক কর্মীবৃন্দ। এক ঐতিহাসিক কর্মসূচি - যার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণি।
কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক সর্বনাশা জনবিরোধী পদক্ষেপসমূহ, শ্রমআইন, কৃষিআইন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সংশোধন আইন এবং নজিরবিহীন বেকারত্বের বিরুদ্ধে সারাদেশে শ্রমজীবী মানুষের ২৬ নভেম্বর রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তকে শিক্ষকসমাজ শুধু সমর্থনই করছে না, পথে নেমে সক্রিয়ভাবে ধর্মঘটকে সফল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ধর্মঘটের সর্বাত্মক সফলতার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আগামী প্রজন্মের শিক্ষার অধিকার এবং শিক্ষক সমাজের পেশাগত অধিকারের গ্যারান্টি।
শিক্ষকসমাজ মনে করে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাবিরোধী ও জনবিরোধী এবং তা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সাধারণের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার ব্লুপ্রিন্ট এই শিক্ষানীতি। সরকারি ব্যয় থেকে সরকার নিজেদের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। সবটা চাপিয়ে দিয়েছে বেসরকারি ক্ষেত্র এবং কর্পোরেটদের উপর। শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার এবং দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে না দেখে এবং মানবসম্পদ তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষানীতি রচনা না করে এই শিক্ষানীতি শিক্ষাকে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে তুলে ধরেছে। শিক্ষাকে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করতে চায় মোদী সরকার। সর্বজনীন শিক্ষা তুলে দিতে চায় এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজার ব্যবস্থায় রূপান্তর করে প্রচুর মুনাফা লাভের জন্য এরা পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এই শিক্ষানীতি চালু করার মধ্য দিয়ে বেসরকারি ও কর্পোরেট মৃগয়াক্ষেত্র তৈরি হবে - কিছুতেই আমরা সেটা মেনে নিতে পারি না। এই শিক্ষানীতি বাতিল করতেই হবে। পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষানীতির সুপারিশ দেশকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দিকে ঠেলে দেবে। দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে একজাতি, একদেশ, একভাষা প্রচলন করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে, তা তো আমরা মেনে নিতে পারি না। পাশাপাশি বিজ্ঞান, যুক্তি ও ইতিহাসের বদলে ধর্মীয় ও অবৈজ্ঞানিক পাঠ্যক্রম ও পাঠসূচি প্রণয়ন করা এবং যুক্তি ও মননশীলতার বদলে পুরাণ ও মিথ শিশুমনে গেঁথে দেওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তক লেখা হয়েছে।
নতুন ব্যবস্থার নাম করে প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষায় অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করা হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। শিক্ষাকে জনসেবা বলে আখ্যায়িত করে ধর্মীয় সংস্থা ও ট্রাস্টগুলিকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষায় এতদিনকার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বিপন্ন হবে বলে আমরা মনে করি।
উচ্চশিক্ষায় মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ব্যবস্থার সুপারিশ অর্থাৎ সাহিত্যের সঙ্গে দর্শন বা বিজ্ঞান এবং নৃত্য - ইচ্ছেমতো চৌষট্টি কলার যেকোনো একটি নিয়ে শিক্ষার্থী পড়তে পারবে এখন।এর ফলে ডিগ্রি পেতে হলে কোনো বিষয়ের গভীরে শিক্ষার্থীকে না গেলেও চলবে। ফলে বিশেষজ্ঞ পেশায় নিযুক্ত করার দায় আর রাষ্ট্রের থাকছে না। সাধারণ শ্রমজীবী পেশায় স্বল্পমূল্যের শ্রমিক ছাড়া উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীর আর কোনো কাজ পাওয়ার সুযোগ থাকছে না। পাশাপাশি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকেও বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’কে ডেকে এনেছে তৃণমূল। এরা ত্রিপুরার মতো পশ্চিমবঙ্গকেও বিজেপি’র হাতে তুলে দিতে চায়। তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপি’কে ঠেকানো যাবে না। তৃণমূল এবং বিজেপি’কে হারানোর জন্য সর্বস্তরের মানুষকে একজোট করতে হবে। ধর্মঘট এই লড়াইয়ে এক পা এগিয়ে দেবে। ভয়ানক দুর্নীতিতে তৃণমূল দলটা মানুষের কাছে ঘৃণিত এবং নিন্দিত। সেই ফাঁক পূরণ করার জন্য মিডিয়া দু’টি দলের কপট লড়াই দেখাতে ব্যস্ত। লাগামছাড়া দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, ফড়ে-দালালদের হাতে গ্রামবাংলার চাষির ভবিষ্যৎ, সরকারি টাকায় দান খয়রাতি - এসবের বিরুদ্ধে মিডিয়া নীরব। এরাজ্যে তৃণমূল সরকারের আমলে নজিরবিহীন দুর্নীতি দেখা গেছে টেট পরীক্ষা গ্রহণ করাকে কেন্দ্র করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে টেট কেলেঙ্কারির কথা আমরা ভুলিনি। ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর এই টেট পরীক্ষা হয়। সরকারি ঘোষণায় আমরা জানতে পারি পদ খালি ৩৫ হাজার। পরীক্ষার জন্য প্রায় ৫৫লক্ষ পরীক্ষার্থী আবেদন করে কিন্তু সরকার ৪৫ লক্ষ আবেদনের কথা স্বীকার করে। পরীক্ষায় বসেন মোট ১৭ লক্ষ ৭২ হাজার। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ১.০৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৮,৭৯২ জন। এই তালিকা তৈরি হয় কলকাতার তৃণমূল ভবনে। তালিকায় নাম ওঠে এমএলএ-এমপি-দের আত্মীয়স্বজন এবং মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে পেরেছেন এমন কিছু ছেলেমেয়ের। তৃণমূলের কালনার এক এমএলএ’র বাড়ির ৮জন প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। জেলা ধরে ধরে তালিকা করা হয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছেন মুকুল রায় - আজ যিনি বিজেপি’র সর্বভারতীয় সহসভাপতি। এরপর ২০১৫ সালে টেট পরীক্ষার জন্য আবেদনপত্র চাওয়া হয়। ২৩ লক্ষ আবেদন জমা পড়ে। ৩০ আগস্ট পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ফলে পরীক্ষা পিছিয়ে ৪ অক্টোবর নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ফরম পাওয়ার জন্য মারামারি হয়। ব্যাঙ্কের সামনে সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়ে বহু আবেদনকারী ফরম পায় না, কারণ পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক সংসদ অত ফরম ছাপায়নি। সেই প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। শূন্য পদ ছিল ৩০ হাজার।
আপার প্রাইমারিতে (পঞ্চম থেকে অষ্টম) নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল ২০১৪ সালে। পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। ফল প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে। ২০১৪ সালের পর ছয় বছর অতিক্রান্ত। ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেনঃ ‘‘১৬,৫০০ পদ শূন্য আছে কিন্তু ২০,০০০ পাস করেছে। এই পরিস্থিতিতে নিয়োগ করা যায়নি। কোভিডটা কমে গেলে আমরা ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শূন্যপদে নিয়োগ করে দেব। বাকিদের পর্যায়ক্রমে হবে’’। একইভাবে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক বোর্ডকে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি জারি হয়, আর এখন পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের প্রতারণা করার ফাঁদ ছাড়া কি বলতে পারি আমরা? বিগত নয় বছর ধরে কি করলেন তিনি? বিদ্যালয়গুলো বিষয় শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় উঠে যাচ্ছে আর তার শিক্ষামন্ত্রী বলছেন আর কোনো শিক্ষক নিয়োগ হবে না। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে প্রতি বছর গড়ে আট-নয় হাজার মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগ হতো। আর গত নয় বছরে মাধ্যমিক স্তরে লক্ষাধিক শিক্ষক পদ খালি হয়েছে। স্থায়ীপদে অধ্যাপক নিয়োগ হয়নি এই আমলে। নিজেদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জির সরকার পার্শ্বশিক্ষকদের লাঠিপেটা করেছে, গ্রেপ্তার করেছে আর মাস্তান লেলিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে সরকারের পোষানেতারা। আন্দোলন করার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। সরকারি-আধাসরকারি ক্ষেত্রে, গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মী, চুক্তি ভিত্তিক কর্মী - স্থায়ীভাবে কোথাও নিয়োগ হয়নি। শুধু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং এব্যাপারে মোদীর সঙ্গে দিদির কোনো ফারাক নেই। শুধু মিথ্যাচার আর মিথ্যাচার!
শুধু ধর্মঘট করে দাবি আদায় নয়, এদের পরাজিত করতে হবে। দিদিকে না সরিয়ে মোদীকে সরানো যাবে না। সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে নয়া-শিক্ষা নীতি বাতিলের পাশাপাশি এই দুই দক্ষিণপন্থার এবং কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাসদের সরাতেই হবে ক্ষমতার মসনদ থেকে। তাই শিক্ষকসমাজ পথে নেমেছে আগামী ২৬ নভেম্বর ঐতিহাসিক ধর্মঘট সফল করার জন্য। এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।