৫৮ বর্ষ ১৪শ সংখ্যা / ২০ নভেম্বর ২০২০ / ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
পবিত্র সরকার
‘রাজা লিয়র’ নাটকের নামভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সাধারণভাবে চিত্রতারকাদের সুদূর নক্ষত্রলোকের মানুষ বলে মনে করা হতো এক সময়ে, তার কারণ বাণিজ্যিক ছবির হিংস্র জনপ্রিয়তা তাঁদের অনেক সময় জনতা থেকে পলায়নে বাধ্য করত। আমরা আমাদের জীবনে ওই ধরনের ‘অসুস্থ’ জনপ্রিয়তার নানা ঘটনা দেখেছি। কলকাতায় সম্ভবত ১৯৫২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়, তাতে তারকা সমাগমে, এবং নানা দুর্গত সময়ে মানুষের সাহায্যে তাঁরা ক্রিকেট ইত্যাদি খেলার আয়োজন করতেন, তাতে তারকাদের ঘিরে জনতার উন্মত্ততা আমরা লক্ষ করেছি।
বাংলা চলচ্চিত্রের নায়কদের মধ্যে সম্ভবত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই প্রথম, যিনি ‘স্টার’দের এই চেনা ছকটি ভেঙে দেন। ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’-এর অভূতপূর্ব সাফল্যের পরেও তিনি দূরবর্তী কোনও গ্রহলোকের বাসিন্দা হওয়ার কথা ভাবেননি। রবিবার সকালে নিয়মিত কফি হাউসে এসে দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকের কোনার একটি টেবিলে বসতেন বন্ধুদের সঙ্গে দুপুর পর্যন্ত আড্ডা দেওয়ার জন্য। এই বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন নির্মাল্য আচার্য, আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক এবং পরে সৌমিত্রর সঙ্গে সম্ভ্রান্ত লিট্ল ম্যাগাজিন (কোনও অর্থেই ‘ক্ষুদ্র’ নয়) এক্ষণ-এর যুগ্ম সম্পাদক; ছিলেন অধ্যাপক ও আবৃত্তিকার অশোক পালিত, আমার বঙ্গবাসীর সহপাঠী রণজিৎ সিংহ, এবং আরও অনেকে। অনেকে যে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখছে তা উপেক্ষা করার মতো নির্লিপ্ত হয়তো তিনি ছিলেন না, কিন্তু তা তাঁকে তাঁর ওই সাপ্তাহিক অভ্যাস থেকে বিরত বা নিরস্ত করেনি। এবং বন্ধু আর অন্যান্যদের ডাকে প্রায়ই আবৃত্তি করার ডাকে সাড়া দিতে দ্বিধা করতেন না। তখন বেশিরভাগ কলেজে আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়নগুলি নিয়ন্ত্রণ করত বামপন্থী ছাত্ররা, তারা সৌমিত্রকে ডাকলেই পেত। ইংরেজিতে যাকে বলে hard to get, সেভাবে আমরা তাঁকে কখনও দেখিনি। তার একটা কারণ, সৌমিত্রের বন্ধুরাও সকলেই ছিলেন বামপন্থী, কেউ কেউ তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও। তাঁর সম্বন্ধে এসব তথ্য বাজারের কাগজগুলি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে, বা কেউ উল্লেখ করলে সংকীর্ণতা বলে নিন্দা করবে। কিন্তু তারা যে উল্লেখ করবে না, বা করেনি, তাতেই প্রমাণ হবে যে এই সত্য তাদের কাছে অস্বস্তিকর। এর মধ্যেই তার নানা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
তাঁর একটা সুবিধে বোধহয় এই ছিল যে, তিনি যে ধরনের চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রথমে যুক্ত হলেন, তা বাণিজ্যিক ছবি ছিল না। তাই মনে হয়, এই সব ছবির নায়ক-নায়িকা - যাঁরা কারণে-অকারণে নাচগানে মেতে ওঠে না, নানাভাবে জনপ্রিয় প্রকরণে এবং পোশাকে প্রেমের কথাবার্তায় দর্শককে উন্মনা করে না - তাঁদের বাইরে সামাজিক ক্ষেত্রে দেখলে তাঁদের প্রতি প্রতিক্রিয়া কীরকম হওয়া উচিত, বাঙালি সাধারণ দর্শক তখনও তা বুঝে উঠতে পারেনি। আর দ্বিতীয়ত, আবৃত্তিকার ছাড়াও কবি হিসেবে তাঁর নাম যদিও ফিল্মে বিখ্যাত হওয়ার আগে আমরা খুব বেশি লোক তাঁর নাটক দেখে উঠতে পারিনি, কিন্তু নাটকের দর্শক হিসেবে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত, বিশেষত ১৯৬৯-এ ইউনিভার্সিটি ইন্সস্টিটিউটে শিশিরকুমারের জীবনের শেষ অভিনয়গুলিতে তাঁর উপস্থিতি সকলের নজরে পড়েছিল। তখনই আমরা জেনেছিলাম যে শিশিরকুমারের কাছে তিনি কিছুদিন নাটকের পাঠ নিয়েছেন। কলেজ স্কোয়ারের একটি বইয়ের দোকানের একটি চৌকিতে আমরা তাঁকে শিশিরকুমারের কাছে উপদেশ শুনতেও দেখেছি।
তাঁর চলচ্চিত্রের সাফল্য সম্বন্ধে আমার বলার বেশি কিছু নেই, সে সম্বন্ধে বলার যোগ্যতর মানুষ অনেক আছেন। ১৯৫৯তে ‘অপুর সংসার’ দিয়ে শুরু হল তাঁর জয়যাত্রা, এই অসুস্থতার আগে পর্যন্ত তাতে ছেদ পড়েনি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেড় ডজনের মতো ছবিতে কাজ করেছেন, ছোটো ছবি ‘কাপুরুষ’, ‘সমাপ্তি’, এমনকি তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘সুকুমার রায়’-এও সত্যজিৎ তাঁর অভিনয়ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছেন। সাধারণভাবে যাঁদের ‘স্টার কাস্ট’ বলা হয় তাঁরা নায়কের বিশেষ ছকের বাইরে যেতে চান না। অপু আর ফেলুদা, কিংবা মৃণাল সেনের, তপন সিংহের কিছু ছবির নায়ক হিসেবে সৌমিত্র নিজের নানা নায়কোচিত ছক তৈরি করেছিলেন। ফেলুদা চরিত্রে তো নায়কের আদলটি বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। কিন্তু অপু থেকে ‘অভিযান’-এর নায়ক, ‘বসন্ত বিলাপ’-এর চ্যাংড়া যুবক, ‘অশনি সঙ্কেত’-এর গ্রামীণ গরিব পুরুত, ‘শাখা-প্রশাখা’র অর্ধোন্মাদ যুবক, মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’ এবং তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’ এবং এ ধরনের বহু ছবিতে ভিন্ন ছকের অভিনয়, তাঁকে চলচ্চিত্রের ‘হিরো’ কাঠামোর অনেক বাইরে নিয়ে যায়, এবং তাঁকে এমন একটা বিস্তার দেয় যে, তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতার তুলনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিশেষ করে ‘কোনি’ ছবিটির কথা তো ভোলা সম্ভব নয়। সেখানে ‘কোনি’ আর ক্ষিদ্দা যেন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সাধনা আর প্রয়াসের এক মেটাফর হয়ে উঠেছিল। নিশ্চয় তার পিছনে পরিচালকদের কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা ছিল, কিন্তু সৌমিত্রর নিজের অর্জিত যোগ্যতাও কম ছিল না। গম্ভীর ও বেদনাময় থেকে হালকা চপলতায়, এমনকি ভাঁড়ামিতে (‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’) তিনি খুব সহজেই নিজেকে বিছিয়ে দিতে পারতেন। সেই সঙ্গে তাঁর সর্বাঙ্গীণ অবয়বে তৈরি হয়ে গিয়েছিল, একটা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’-এর বুদ্ধিদীপ্ত ছবি, যা অন্য তারকাদের সেভাবে অর্জিত হয়নি। আমাদের ধারণা, তাঁর মধ্যে নাটকের শিক্ষা যেটুকু ছিল তা তিনি সবটুকু কাজে লাগিয়েছেন নিজেকে নির্মাণ এবং ভাঙচুর করতে।
প্রচুর কবিতা, প্রচুরতর গদ্যরচনা, পত্রিকা সম্পাদনা, শেষদিকে ছবি আঁকা - এইভাবে মানুষের বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে নিরভিমানে বিচরণ করা, ইত্যাদি ছাড়াও যেটা সৌমিত্রকে অন্যান্য সফল তারকা থেকে আলাদা করে আনে তা হলো তাঁর নাটকের প্রতি অভাবিত এবং অবৈষয়িক ভালোবাসা। আমাদের জীবৎকালে দেখেছি অনেক সফল চিত্রাভিনেতা তখনও জীবিত স্টার, রঙমহল বা বিশ্বরূপায় অভিনয় করতে এসেছেন পেশার কারণে, কেউ কেউ যাত্রাতেও যোগ দিয়েছেন। হয়তো শুধু পেশার কারণে নয়, অন্য অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁদের অভিনয়ের শক্তি বৃদ্ধির জন্যও। কিন্তু সৌমিত্রর থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা সেই রকম ‘সিজনাল’ বা পেশাভিত্তিক ছিল না। নাটকের জন্য ভালোবাসা ছিল তাঁর অস্থিতে-মজ্জায়। যাদের রক্তে নাটকের নেশা থাকে তারা সামনে জীবন্ত মানুষের উপস্থিতি আর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে চায়। এবং আমার মতে, নাটকেই সৌমিত্র তাঁর অভিনয়ের বিপুল সামর্থ্য ও সম্ভাবনা অবলীলাক্রমে প্রকাশ করতে পারতেন। আমি তাঁর প্রথম অভিনয় দেখি কৌশিক সেনের ‘টিকটিকি’তে, সম্ভবত ১৯৯৫-এ। নাটকটি অ্যান্টনি শেফারের ‘স্লুথ্’-এর দেশিকরণ। সে অভিনয় দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। যাই এই কারণে যা, বিদেশে এই নাটকের চলচ্চিত্র-রূপ আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল, এবং তাতে সৌমিত্র-র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন স্যার লরেন্স অলিভিয়ার। এভাবে হয়তো বলা উচিত নয়, স্যার লরেন্সের বয়সটাও ধরতে হবে - কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, তিনি চূড়ান্ত রাগ আর ব্যাকুল দীনতা - এই দুটি বিকল্পের মধ্যেই বেশিরভাগ সময় চলাফেরা করছেন, ফলে তাঁর অভিনয় তেমন ব্যাপ্তি পেল না। সেখানে সৌমিত্র যে কত ভাবে কত মেজাজে নিজেকে ব্যক্ত করলেন তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। আর এই সেদিন, ২০১০-এ ‘রাজা লিয়র’-এ তাঁর অভিনয় বলে দেয় তাঁর অভিনয় কী উচ্চতায় পৌঁছোতে পারত।
নাটকের ক্ষেত্রে তিনি আরও যে কাজটা করার চেষ্টা করেছিলেন, তা হলো গ্রুপ থিয়েটারের একটা পেশাদার ভিত্তি তৈরি করা, যাতে সাফল্য পাওয়া সহজ ছিল না, পানও-নি। কিন্তু তাঁর ভালোবাসাটা অস্পষ্ট থাকে না। তিনি জানতেন এতে তাঁকে স্বোপার্জিত অর্থ ঢালতে হবে যা কখনও ফেরত আসবে না, এবং সকলেই জানেন যে ফেরত আসেনি। কিন্তু তাঁর চেষ্টায় ক্ষান্তি ছিল না। এ এক ধরনের মিশনারির কাজ, শুধু নিজের শখ মেটানো নয়। আমরা তার যথার্থ মূল্য দিতে পারিনি।
আমি তাঁকে জনতারই মানুষ হিসেবে গণ্য করি। আমার মনে আছে, নব্বইয়ের গোড়ায় যখন তাঁকে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে রবীন্দ্রভারতীর জন্য জোড়াসাঁকোতে আবৃত্তি করতে বলি তখন এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে আমি তাঁর কাছ থেকে অনুজের স্নেহ পেয়ে এসেছি। তাঁর একটি ভিডিয়ো সাক্ষাৎকার নেওয়ারও সুযোগ হয়েছিল। বহু সভাসমিতিতে তাঁর সঙ্গে মঞ্চে বসেছি, গত কয়েক বছর ধরে একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত কবিতা আর গদ্যরচনার সিডি করছিলেন, সেই প্রকল্পে ক্ষীণভাবে যুক্ত থেকে দেখেছি, কী অসম্ভব আত্মশৃংখলাপরায়ণ ছিলেন মানুষটি। আবার হালকা মেজাজে থাকলে দু-কলি গানও গেয়ে উঠতে পারতেন। আজই পড়লাম যে, ১৯৫৪ সালে এবিটিএ-র নেতৃত্বে এস্প্লানেডে শিক্ষকদের অনশনের সময় তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠক।
একটা লঘু সামাজিক ইতিহাসের তথ্য দিই। ‘অপুর সংসার’-এ তাঁর আবির্ভাব বাঙালিকে নিশ্চয়ই উত্তেজিত করেছিল, কিন্তু তাঁর নামটিতেও বাঙালি মু্গ্ধ হয়েছিল। তার আগে কোনও বাঙালি নায়ক এমন সুন্দর নাম বহন করেননি, মুম্বইতে তো ‘কুমার’ প্রায় একচেটিয়া হয়ে গিয়েছিল। তাই যে সব বাঙালি হিন্দুর বয়স এখন পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে, তাদের অনেকেরই ‘সৌমিত্র’ নাম পাওয়া যাবে।
আবার বলি, তিনি ছিলেন জনতারই মানুষ। রাজনৈতিক পালাবদলেও মাথা নোয়াননি। শুধু পর্দায় বা মঞ্চে বা কফি হাউসে তাঁর উপস্থিতি ছিল না, মানুষের মিছিলেও তিনি হাঁটতেন। এই তো সেদিন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বিশাল মিছিলে তাঁকে পেলাম এস্প্লানেড থেকে বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামে। বিপুল ব্যস্ততা, তারই মধ্যে সময় করে চলে এসেছেন পাড়ার ছোটো সভায়। নিতান্ত নাচার না হলে ফেরাতেন না।
এবারে শারদ ‘গণশক্তি’তেও বলেছেন, ‘এখনও বিশ্বাস করি, বামপন্থাই বিকল্প’।