E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০

পুলওয়ামা কাণ্ডে তৎকালীন রাজ্যপালের বিস্ফোরক অভিযোগ

এ সম্পর্কে সরকারের জবাব চাইল পলিট ব্যুরো


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পুলওয়ামা বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের দেওয়া সাম্প্রতিক এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দিল্লির রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের তৎকালীন মোদি সরকারের মারাত্মক গাফিলতি ও অপদার্থতাও আজ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সেইসঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, ৪০ জন জওয়ানের জীবনের বিনিময়ে নির্বাচনী ফায়দা লোটা নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি’র কাছে কিছুই নয়। এই ঘটনা আজ প্রমাণ করছে, বিজেপি’র মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তধর্মী শক্তি ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে কতটা অমানবিক ও নির্মম হতে পারে!

দেশবাসীর স্মরণে আছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ’র কনভয়ের ওপর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী হামলায় ৪০ জন জওয়ানের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনায় দেশের নিরাপত্তার বিরাট গলদ থাকার অভিযোগ এনেছিল বামপন্থী সহ বিরোধীরা। কিন্তু সেদিন এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে পাক-বিরোধী হুঙ্কার ও দেশপ্রেমের আবেগ উসকে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোবার পথ প্রশস্ত করে নিয়েছিল মোদি বাহিনী। অথচ কারা কীভাবে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাল এবং কাদের গাফিলতি ও অপদার্থতায় এতগুলো সেনা জওয়ানের জীবন চলে গেল, তার কোনো সঠিক জবাব ছিল না সরকারের কাছে। গোটা ঘটনা এতদিন ধরে রহস্যাবৃতই ছিল।

অতি সম্প্রতি ‘দ্য ওয়ার’ ওয়েবসাইটের জন্য সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই রহস্যের জাল ছিন্ন করেছেন সত্যপাল মালিক। তিনি তখন ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে অকপটেই জানিয়েছেন, সেদিন পুলওয়ামার ঘটনায় নিরাপত্তায় গাফিলতি, অবহেলা ইত্যাদি যা তাঁর মনে হয়েছিল, তার সবকিছু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন। সব শোনার পর নাকি মোদির গম্ভীর পরামর্শ ছিল - ‘এসব নিয়ে কারো কাছে মুখ না খোলার।’ সেই সাক্ষাৎকারে সত্যপাল মালিক দ্বিধাহীনভাবেই জানিয়েছেন, পুলওয়ামার ওই হামলার ঘটনা ছিল ভারতীয় ব্যবস্থা, বিশেষ করে সিআরপিএফ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘অপদার্থতা’ ও ‘অবহেলা’র ফল। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন রাজনাথ সিং। সাক্ষাৎকারে মালিক জানিয়েছেন, সিআরপিএফ তাদের জওয়ানদের নিয়ে যাবার জন্য বিমানের ব্যবস্থা করতে বলেছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তা খারিজ করে দেয়। ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যুর জন্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অভাবই যে দায়ী, তা স্পষ্ট করে দিয়ে মালিক আরও বলেছেন, সিআরপিএফ কনভয় যাবার আগে যথাযথভাবে রুট স্যানিটাইজ করা হয়নি। ঘটনার পর টেলিফোনে মোদিকে এসব কিছুই বলেছিলেন মালিক। কিন্তু মোদি তাঁকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে আলাদা করে মালিক কথা বলেছিলেন তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে। কিন্তু দোভালও এসব নিয়ে কারো সঙ্গে কথা না বলার নির্দেশ দেন।

এর পাশাপাশি বড়ো ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রসঙ্গ টেনে সত্যপাল মালিক সেই সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন তোলেন, পাকিস্তানের একটা গাড়ি ৩০০ কিলোগ্রাম আরডিএক্স নিয়ে ১০-১৫ দিন জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়াল, উলটো দিক থেকে বিনা বাধায় সেনা কনভয়ে ঢুকে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটাল, কিন্তু কেউ সন্দেহ করল না কিংবা জানতেও পারল না?

ঘটনাক্রমে জানা গেছে, যখন পুলওয়ামা বিস্ফোরণ ঘটে তখন মোদি মগ্ন ছিলেন জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে বিদেশি টিভি চ্যানেলের জন্য শুটিংয়ে। দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শুটিং এবং রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য রেখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কোনো এক ধাবা থেকে ফোনে নাকি রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলেন। সত্যপাল মালিকের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি যখন চরম সরকারি ব্যর্থতার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানান,তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ঘটনার পর থেকে অসংখ্য গুরুতর প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছিল, কিন্তু সেসবের উত্তর দেশবাসীকে জানানো হয়নি। উলটে মোদির দল নির্বাচনে ফায়দা লোটার জন্য এতজন শহিদ জওয়ানের মরদেহকে নিয়ে উগ্রজাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে নির্বাচনী প্রচারে ঝড় তুলে লাভবান হয়েছিল। দেশের মানুষ এতদিন পর্যন্ত এই ঘটনা সম্পর্কে অন্ধকারেই ছিলেন, সত্যপাল মালিকের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার সেই অন্ধকার ভেদ করে সত্যকে সামনে তুলে ধরেছে। কিন্তু খুবই বিস্ময়কর যে, সত্যপাল মালিক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত গাফিলতি, অপদার্থতা এবং সেনা জওয়ানদের মৃত্যুর বিনিময়ে কৌশলে নির্বাচনে সাফল্য অর্জনের মতো ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনার পরও সব ব্যাপারে অতি প্রগলভ প্রধানমন্ত্রী ও সরকার নিশ্চুপ ও নির্বাক ভূমিকা নিয়ে চলেছে। যা সত্যপাল মালিক শুধু নন, পুলওয়ামার ঘটনার পর বিরোধীরা যে অভিযোগ তুলেছিলেন, তারই সত্যতাকে স্পষ্ট করছে।

এই ঘটনা প্রসঙ্গে গত ১৭ এপ্রিল সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে দাবি জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক যে অভিযোগ করেছেন, অবিলম্বে তার সুস্পষ্ট জবাব দিতে হবে সরকারকে।পলিট ব্যুরো বলেছে, ‘‘পুলওয়ামায় যে হামলায় সিআরপিএফ’র ৪০ জন জওয়ান প্রাণ হারান, তা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন মালিক। আমাদের দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র গাফিলতিও বরদাস্ত করা হবে না।’’

পলিট ব্যুরো বলেছে, জম্মু-কাশ্মীর থকে ৩৭০ এবং ৩৫(এ) ধারা প্রত্যাহার এবং রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রীয়শাসিত অঞ্চলে ভেঙে দেবার প্রক্রিয়া নিয়েও যে অভিযোগ উঠেছে, তা-ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়গুলিতে মোদি সরকারের নীরবতা আমাদের দেশের সুরক্ষা এবং একতা ও অখণ্ডতার উপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলছে। দেশের সংবিধান জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মোদি সরকারের এই অভিযোগগুলির জবাব দেওয়া প্রয়োজন। মোদি সরকার এভাবে চুপ থাকতে পারে না।