৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০
দুয়ারে সরকারঃ সামাজিক সুরক্ষা কোথায়?
সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার জনসাধারণের মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা প্রথম জার্মানিতে ১৮৮৩ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল। সামাজিক নিরাপত্তা আইনের মূল লক্ষ্য মানুষকে বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি বা অলক্ষিত ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা প্রদান করা। সহজভাবে বলতে হলে, সামাজিক নিরাপত্তা হলো সেই সুরক্ষা ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও পরিবারকে স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিশেষত বার্ধক্য, বেকারত্ব, অসুস্থতা, প্রসূতিকালীন সমস্যার সমাধানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রাপকদের পারিবারিক সুরক্ষা এবং সহায়তার অধিকার, পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। সামাজিক সুরক্ষাকে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর ‘‘দুয়ারে সরকার” নামে যে অভিযান শুরু করেছিল, তা আসলে কী বা কেন তা বোঝার বোধহয় সময় হয়ে গেছে। আউটরিচ ক্যাম্পের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পরিষেবা এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি পৌঁছে দেওয়া নাকি শাসকদলের মূল কাজ। এই শিবিরগুলি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পৌরসভার ওয়ার্ড স্তরে সংগঠিত হয়। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘‘চুপ সরকার চলছে’’ বা ‘‘১০ বছর চুপ করে থাকুন সবাই, সরকার চলছে’’-র মতো অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক কথাগুলি। যে রাজ্যে মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ‘‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’’ নিয়ে এত মাতামাতি চলছে, সেই রাজ্যের ২০১২ সালে ‘‘পার্কস্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ড’’ এবং ‘‘নদীয়া ধর্ষণকাণ্ড’’ চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেয়, বাংলায় মহিলাদের সামাজিক অবস্থান। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘‘সাজানো ঘটনা’’। এরাজ্যের মানুষ লক্ষ করেছেন, অনেক অপরাধের ঘটনায়, বিশেষকরে মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনাগুলিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা দেখা যায়নি।
আচ্ছা বলুন তো, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমানে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির কী অবস্থা? খাতায়-কলমে সংখ্যা অনেক কিন্তু বর্তমান অবস্থান কী তা একমাত্র বুঝতে পারবে, যারা ক্ষেত্র সমীক্ষা করবে। সরকারের সঠিক পদক্ষেপের অভাবে বেসরকারি ক্ষুদ্র আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের সর্বনাশের থাবা বসাচ্ছে। অন্যদিকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে অচল করে দিতে এক অন্য পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। এমনিতেই প্রকল্পগুলিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সহায়িকার ঘাটতি রয়েছে। কর্মী সহায়িকা নিয়োগের পরিবর্তে, সহায়িকাদের অন্য সরকারি কাজে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করা হচ্ছে। সহায়িকাদের দুয়ারে সরকার, আবাস যোজনার মতো একাধিক কাজ করতে হচ্ছে। তা করতে গিয়ে তৃণমূলী দুর্বৃত্তদের রোষের মুখেও পড়তে হচ্ছে। এ রাজ্যে রেগার কাজ বন্ধ। শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। গৃহহীন, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে মানুষদের জন্য পাকা ছাদযুক্ত আবাস নির্মাণ বন্ধ ছিল, আবার শুরু হয়েছে। তবে কার বাড়ি হবে সেটা কে ঠিক করবে? পুলিশ নাকি অন্য কেউ তা নিয়ে মহাবিরোধ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তৃণমূল সরকারের সার্বিক ব্যর্থতার চূড়ান্ত নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল করোনাকালে। সরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড গ্রহণ করা হয়নি। এই ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী চুপ থাকার প্রমাণ দিয়েছেন। ‘‘রেড ভলান্টিয়ার’’-রা যা ভূমিকা নিয়েছিলেন তা নতুন-করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই । সবকিছুর পিছনে কারণ একটাই দুর্নীতি, সীমাহীন দুর্নীতি। বেকারের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে অবশ্যই রাজ্য সরকারের কোনো হেলদোল নেই। ক্লাবগুলিকে বেলাগামভাবে টাকা দেওয়া হচ্ছে। বেকার যুবকদের শিক্ষা, কাজের বদলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে অসামাজিক কাজ, নেশায় ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে, তোলাবাজি থেকে বোমা বন্দুকের জগতে যুক্ত করা হচ্ছে। ভোট লুটের কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। এইরকম আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশে সরকার ‘‘দুয়ারে সরকার’’-এর নামে সামাজিক সুরক্ষার মিথ্যা জিগির তুলছে। বাংলার বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা বুঝিয়ে দিচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা বলে এই বাংলায় আর কিছু বেঁচে নেই। তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং সত্য থেকে দূরে রাখতেই সরকারের মিথ্যা প্রয়াস হলো দুয়ারে সরকার।
গত ১ এপ্রিল থেকে রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে দুয়ারে সরকার ক্যাম্প। বিভিন্ন ক্যাম্পের সামনেই বিক্ষোভ দেখান সাধারণ মানুষ। গত চার-পাঁচ বছর ধরে আবেদন করেও চালু হয়নি বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা। অনেক মানুষ চারবার পাঁচবার “দুয়ারে সরকার” ক্যাম্পে একই কারণে আবেদনপত্র জমা দিলেও এখনো তাদের সামাজিক সুরক্ষা ভাতা চালু হয়নি। প্রতিটি ক্যাম্পে চলছে দলবাজি সহ স্বজনপোষণ। বৃহত্তর অংশের জনগণ তাদের প্রাপ্য থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারের কাজের সমালোচনায় জনগণ যাতে দপ্তরের দরজায় এসে হাজির না হতে পারে তাই আমাদের রাজ্যে শুরু হয়েছে ‘‘দুয়ারে সরকার’’। গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের জন্য ন্যূনতম মজুরি সমেত কাজ পেতে হাতে জব কার্ডের পরিবর্তে বেকার মানুষগুলি তাদের ‘‘দুয়ারে’’ দাঁড়িয়ে শুনছেন, আসছে বছর আবার শিল্প সম্মেলন হবে। আচ্ছা বলুন তো, পশ্চিমবঙ্গে এখন আছে কী? লক্ষ কোটি ঘুষের পাহাড়, লক্ষাধিক শূন্যপদ, জেলের মধ্যে মন্ত্রী, আমলা আর তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা। বাংলায় এখন ঠগ বাছতে গা উজাড়। যে কথাটা বারবার মাথায় আসছে, বেশিরভাগ অংশের মানুষ বোঝেন বা জানেন সামাজিক সুরক্ষার নামে ভণ্ডামি চলছে। ‘‘দুয়ারে সরকার’’ আদতে বুথে বুথে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে, যার মূল কাজ সামাজিক সুরক্ষা নয় - বরং বাজারি কায়দায় ভোট লুটের প্রস্তুতিপর্ব। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ কেন লাইনে দাঁড়াচ্ছে? কেন বঞ্চনার শিকার হচ্ছে? আসলে ডানপন্থী পপুলিজম, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো থেকে বিচ্যুত একক অস্তিত্বসম্পন্ন, বিচ্ছিন্ন জনগণকে একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে, যা সহজেই বোধগম্য এবং ব্যক্তিগতভাবে সন্তোষজনকতা প্রদান করে। ডানপন্থী পপুলিজম প্রদত্ত ধারণাগুলি এতটাই উদ্দেশ্যমূলক এবং কর্তৃত্বমূলকভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যাতে মনে হয় ব্যক্তির স্বার্থকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে ব্যক্তির নিজস্ব ভাবনাবোধ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। ডানপন্থী পপুলিজমের মূল উদ্দেশ্য হলো, জনসাধারণ তাদের নেতৃত্বের কর্তৃত্বমূলক নির্দেশকে আত্তীকরণ করবে এবং সেই বিশ্বাসকে অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ‘‘দ্বন্দ্ব’’ বলে একটি বিষয় আছে - যেখানে যতদিন মানুষ তার ভাবনা এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না, ততদিনই গরলকে অমৃত ভেবে পান করবে। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আগে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর নিজের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে তার মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিকল্প উপায়ে জনগণের যুক্তিবোধ এবং অনুভূতি-ক্ষমতা যা গণতন্ত্রের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যক তা গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। না হলে ‘‘দুয়ারে সরকার’’-এর নাম করে চোর লুটেরা বর্তমান শাসকদল বাংলার সব উঠোনকে কলুষিত করে ফেলবে তাদের সর্বগ্রাসী থাবা দিয়ে।