৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০
বাঁকুড়া জেলার মানুষ বলছেন
তৃণমূলের লুটের পঞ্চায়েত আর না - ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের পঞ্চায়েত
মধুসূদন চ্যাটার্জি
‘‘আমাদের গতর খাটার মজুরির টাকাগুলো কোথায় গেল? যদি টাকা না ছিল তাহলে কাজ করালেন কেন? টাকা তো অঢেল ছিল, সেই টাকা কার পকেটে ঢুকল? দুবছর আগে কাজ করার মজুরির টাকা কবে পাব? আর নতুন করে কেন আমরা মাটি কাটার (রেগার) কাজ পাব না, তার জবাব দিয়ে যান’’ - বিষ্ণুপুরের লায়েক বাঁধ গ্রামপঞ্চায়েত অফিসের সামনে এসে চিৎকার করে কথাগুলো বলেন অর্চনা মাল। খেতমজুরের কাজ করে সংসার চালাতে হয় তাঁকে। তিনি কি একা? না, তাঁর সঙ্গে কয়েক’শো মহিলা, পুরুষ জনমজুর এসেছেন এই কড়া রোদে। কারণ, এই সময়ই তো রেগার কাজের সময়। গত বছর কোনো কাজ পাওয়া যায়নি, এবছরও কাজের কোনো খবর নেই। তাহলে কি আমরা না খেতে পেয়ে মরব? চোয়াল শক্ত করে খেতমজুরের এই সহজ সরল জিজ্ঞাসার সামনে পঞ্চায়েতের প্রধান থেকে শুরু করে ব্লকের বিডিও, এমনকী জেলাশাসক পর্যন্ত থতমত খাচ্ছেন। কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। নতুন কাজ তো দূরের কথা, বকেয়া মজুরির কী হবে তারও কোনো হদিস নেই এঁদের কাছে। কিন্তু পঞ্চায়েত, সরকারি আধিকারিকদের কাছে এই শুকনো উত্তর শুনতে রাজি নন বাঁকুড়া জেলার লক্ষ, লক্ষ জনমজুর।
কোতুলপুরের মদনমোহনপুর, বিষ্ণুপুরের রাধানগর, তালডাংরার শালতোড়া, জয়পুরের গেলিয়া, বাঁকুড়া ১নং ব্লকের আধারথোল, বড়জোড়ার সাহারজোড়া, রানিবাঁধের রুদঢ়া, রাওতোড়া, রাইপুরের ফুলকুসমা, ঢেকো, শালতোড়ার তিলুড়ি, ইন্দাসের রোল, শাসপুর, সোনামুখীর নবাসন, ওন্দা সহ বাঁকুড়া জেলার ১৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশিরভাগ পঞ্চায়েত অফিসেই আজ মানুষের এই বিক্ষোভ আছড়ে পড়ছে। কথা একটাই, প্রধান বেরিয়ে এসে জানাক কী করবেন তিনি? বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহ অঞ্চলে এই দাবি নিয়ে যাতে খেতমজুররা যেতে না পারেন তার জন্য তৃণমূলবাহিনী আগে থেকেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে হুমকি দিয়েছিল। রেগার কাজের ৪(ক) ফর্ম খেতমজুরদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেয় তারা। দমে যাননি তাঁরা। একটা ফর্ম জোগাড় করে সেটা জেরক্স করে পরের দিন পঞ্চায়েত অফিসে যান তাঁরা। সেখানেও তৃণমূলবাহিনী হামলা করার চেষ্টা করে। এবার মহিলারাই পাল্টা প্রতিরোধে নামলে পুলিশ এসে তৃণমূলের লোকজনকে বাঁচায়। মহিলারা জানতে চান এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনারা? এখন আমরা হামলাকারীদের উত্তমমধ্যম দিচ্ছি বলে তাদের বাঁচাতে এসেছেন? আপনাদের লজ্জা, শরম নেই? আমতা আমতা করে পুলিশ বাহিনী। খেতমজুরদের এই মূর্তি দেখে প্রধান ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে হাত জোড় করে জানান, আমার কিছুই করার নেই। আমি আপনাদের মজুরির টাকা দিতে পারব না, আর নতুন করে কাজও খুলতে পারব না। একই দৃশ্য দেখা যায় কোতুলপুরের মদনমোহনপুর, শালতোড়ার তিলুড়ি, বিষ্ণুপুরের রাধানগরে। মদনমোহনপুরের প্রধান তো জানিয়েই দিলেন - এখান থেকে ছেড়ে চলে যেতে পারলে তিনি বাঁচেন। কাজ, মজুরি চাইতে আসা মানুষজন জানান - যদি মজুরির টাকা, কাজ দিতে না পারবেন তাহলে চেয়ার আলো করে বসে আছেন কেন? আমরা মানুষের পঞ্চায়েত দেখতে চাই। এই মুহূর্তে এটাই বাঁকুড়া জেলার চিত্র। আপনি যে প্রান্তেই যাবেন, মানুষ চাইছে মানুষের পঞ্চায়েত হোক। কেন মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা? কৃষক সভা, সিপিআই(এম), সিআইটিইউ কর্মীরা মানুষের সামনে বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন বলেই কি মানুষ আসছেন? না। গ্রাম, শহরের একেবার প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত মানুষজন তাঁদের একদিন-প্রতিদিনের জীবনের মধ্য দিয়ে মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছেন, আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সংসার নিয়ে তো বাঁচতে হবে।
গত ২০১৮ সালে বাঁকুড়া জেলায় ৭০শতাংশ পঞ্চায়েত আসনেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস কোনো বিরোধীকে দাঁড়াতেই দেয়নি। বিশেষকরে বামফ্রন্টকে তিনটি মহকুমা এলাকাতেই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী দিয়ে আটকানো হয়েছিল। পুরো বিষ্ণুপুর মহকুমা এলাকায় কোনো নির্বাচনই হয়নি। এই মহকুমা এলাকার গ্রামের মানুষ চেনেন না কে পঞ্চায়েতের সদস্য বা সদস্যা। যেহেতু ভোট হয়নি তাই পঞ্চায়েতের লোকজনের গ্রামে যাওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয়নি। পরের পাঁচ বছর সেভাবেই তারা দিন কাটিয়ে দেন। ২০২১সালের প্রথম দিকে কিছু রেগার কাজ হয়েছিল। সেই কাজের মজুরিও আজ পর্যন্ত কোনো জনমজুর পেলেন না। সেই কাজ আবার বেছে বেছে শাসকদলের লোকজনকে দেওয়া হয়। প্রায় সমস্ত গ্রামপঞ্চায়েতেই এমন বহু ব্যক্তির নামে কাজ দেখানো আছে যারা কোনোদিন কাজ করা তো দূরের কথা, তাঁরা কোনোদিন কোথাও এক ঝুরি মাটিও ফেলেননি। তাদের নামের কাজের টাকার একটা অংশ তাদের দিয়ে বাকিটা তৃণমূলের ছোটো, মাঝারি স্তরের নেতাদের পকেটে ঢুকেছে। আর জেলাপরিষদের বড়ো কাজের টাকার ভাগ বড়ো নেতাদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়েছে নির্বিচারে। এটা এখন আর কোথাও গোপন নেই। তথ্য জানার অধিকারে জানতে হয় না। সবাই সবটা জানেন। জানেন এই কারণে যে, এক একজন প্রধান বা পদাধিকারী যে পেল্লাই বাড়ি বানিয়েছেন, দামি গাড়ি কিনেছেন সেই টাকার কোনো বৈধ উৎস তো নেই। তাহলে কোথা থেকে এলো এই টাকা? পঞ্চায়েতের বহুবিধ প্রকল্প থেকে সোজা সেই টাকা তাদের পকেটে ঢুকেছে। মানুষ তাঁর গতর নিঙড়ে যে কাজ করেছেন তার মজুরি পেলেন না। বাঁকুড়া জেলার ২২টি ব্লকে ৭৬কোটি টাকা রেগার মজুরি বাকি। তৃণমূল থেকে বাইরে প্রচার করা হচ্ছে - কেন্দ্র নাকি টাকা দেয়নি। ঘটনা হলো, রেগা প্রকল্পে ৭৫ভাগ কেন্দ্র ও ২৫ভাগ টাকা রাজ্য দেয়। ২০২১-২২ আর্থিক বছরের টাকা তো কেন্দ্র দিয়েছিল, সেই টাকায় কাজও হয়েছিল। তাহলে মজুরি আটকে রইল কেন? এর কোনো উত্তর দিতে পারছে না পঞ্চায়েতগুলি।
ঘটনা হলো রাজ্য সরকার রেগার কাজের যে হিসাব কেন্দ্রে পাঠিয়েছে, সেই হিসাব দেখেই সরেজমিনে বাঁকুড়া জেলায় তদন্ত করতে আসে কেন্দ্রীয় সমীক্ষক দল। দেখা যায়, ফলের বাগান করা নিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচের হিসাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেলায় কোথাও কোনো বাগানের অস্তিত্ব নেই। বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরের কাছে কংসাবতী নদীর চরে বনশোল গ্রামে আম, লেবু, পেয়ারা ও ঘাস চাষের বাগান দেখানো হয়েছে। কংসাবতী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কিছু গাছ লাগানো হয়েছিল। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন খাতড়া পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্মাধ্যক্ষ, বর্তমানে শাসকদলের খাতড়া ব্লক সভাপতি। সেই কটি গাছ কংসাবতীর জলে তলিয়ে গেছে। এখন সেখানে কোনো গাছেরই অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এই কাজে ৪৪লক্ষ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কোথায় গেল এই টাকা? আবার এখানেই কৃষকদের জন্য সরকারি স্তর থেকে দেওয়া সার কৃষকদের না দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে গিয়েছিল তৃণমূলের লোকজন। মানুষ জানতে পারার পর সেই সার মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। কৃষকরা সার পেলেন না। লক্ষ লক্ষ টাকার সার নষ্ট হলো। কৃষক সভার ডাকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে খাতড়া মহকুমাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আজও। একইভাবে বাগান দেখিয়ে টাকা লুট হয়েছে ইন্দাসের শাসপুর, রোল, আকুই, শালতোড়ার তিলুড়ি অঞ্চলে। তিলুড়ির প্রধানের নিজস্ব জায়গায় ফলের বাগান দেখানো হলেও সেখানে একটি গাছও নেই। মানুষ যখন জানতে চান কোথায় গেল গাছগুলি? তিনি জানিয়েছিলেন - ছাগলে খেয়ে নিয়েছে। তাহলে গোড়াগুলো তো থাকবে? কোনো উত্তর আসেনি প্রধানের কাছ থেকে। শাসকদলের এই সমস্ত দুর্নীতির খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রামের গরিব মানুষকে।
কেন্দ্রীয় সরকার রেগায় টাকা বন্ধ করে দিল। মানুষের প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রী তো কথায় কথায় মামলা করেন, তাহলে কেন্দ্র সংবিধান স্বীকৃত একটি প্রকল্পের টাকা রাজ্যকে পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ার পরও মামলা করছে না কেন তৃণমূল সরকার? রহস্য এখানেই। একাধিক পঞ্চায়েতে তৃণমূল যে দুর্নীতি করছে বিজেপি’র লোকজন তাতে সমর্থন জানাচ্ছে। এবং সেটা প্রকাশ্যেই। আবার বিজেপি’র টিকিটে পঞ্চায়েতে জিতে বোর্ড গঠন করা সমস্ত বিজেপি সদস্য, সদস্যারা দু'বছরের মধ্যেই তৃণমূলে চলে যাওয়ার ঘটনাও বাঁকুড়া জেলার মানকানালী অঞ্চলে ঘটেছে। এখন মানকানালী পঞ্চায়েত তৃণমূলের পরিচালিত। কোনো কাজ চাইতে গেলে তারাই বলছে, বিজেপি’র পঞ্চায়েত ছিল তাই কিছু তখন হয়নি! মানুষ জানতে চাইছেন তোমরাই তো ছিলে। নীরব পঞ্চায়েতের কর্মকর্তারা। এ খেলা কতদিন চলবে?
এর পাশাপাশি আছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় দুর্নীতি। প্রায় প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতেই প্রকৃত প্রাপকরা বাড়ি পেলেন না। কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়ে তৃণমূল সার্ভে করায়। শাসকদলের নির্দেশ ছিল - যা আছে সেটাই রাখতে হবে। অর্থাৎ শাসকদলের ঘনিষ্ঠ তার দোতলা বাড়ি থাকলেও গোরু রাখার জন্য নতুন বাড়ি সে পাবে। বড়জোড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, বাঁকুড়া ২নং ব্লকের বিকনা সহ জেলার সর্বত্র এই ঘটনা ঘটেছে। মানুষের প্রতিবাদের ফলে জেলাশাসকের হস্তক্ষেপে কিছু কাজ হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৃত প্রাপকরা বাড়ি পেলেন না।
জেলায় ইটভাটা গুলি বন্ধ। বন্ধ বালি তোলাও। ৩০০ টাকার বালি আজ ৩,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দু’বছর পাথর খাদান বন্ধ। লক্ষাধিক শ্রমজীবী মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই। শুকনো মুখে বসে আছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। দলে দলে যুবকরা বাইরের রাজ্যে কাজ করতে চলে যাচ্ছে। নীরব পঞ্চায়েত, প্রশাসন। তাই মানুষ চাইছেন - এই পঞ্চায়েত আর না। একে পরিবর্তন করতেই হবে। তাই সমস্ত ভয়ডর কাটিয়ে মানুষ আজ রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের হাতে লালঝান্ডা। মানুষ লালঝান্ডার কর্মীদের বলছেন - আপনারা আসুন। সামনে থাকুন। লড়াই করবে মানুষ। কারণ লালঝান্ডার পঞ্চায়েত কেমন ছিল আমরা তা জানি। সেটাই ফিরিয়ে আনতে হবে।