৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০
মতুয়াদের প্রতি নকল ভালোবাসা
অলকেশ দাস
বাংলায় তখন বর্ণহিন্দু জমিদার মহাজনদের দাপট। সেই দাপটে নমঃশূদ্র সহ নিম্নবর্ণের জাতিগুলি অর্থনৈতিক তো বটেই ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে অবহেলিত, ঘৃণিত, শোষিত। সেই সময়েই মতুয়া ধর্মমত।
‘মাতোয়ারা’ থেকে। প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর। তাঁর বাবা ছিলেন বৈষ্ণব মতাদর্শে বিশ্বাসী। মানুষ তাদের 'ঠাকুর' বা ‘গোঁসাই’ বলে ডাকত। ‘ঠাকুর’ পদবী সেখান থেকেই। প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম। ‘হাতে কাম, মুখে নাম’। যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ কৃষিকাজ। বহুত্ববাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, ভাবের আদান-প্রদান - সব মিলিয়ে মতুয়া ধর্ম বর্ণময়।
মতুয়া সমাজ সম্মানজনক স্থানের জন্য শিক্ষাকে স্বীকার করে। গুরুবাদকে অস্বীকার করে। এখানে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত অপ্রয়োজনীয়। দীক্ষার স্থান নেই। এধর্ম প্রসার পেয়েছে নিম্নবর্ণের মানুষের সমাজকে কেন্দ্র করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রাহ্মণরা বাংলায় অন্ত্যজ বর্ণগুলিকে ‘জল অচল’ জাতিতে রূপান্তরিত করেছিল। অন্ত্যজরা ব্রাহ্মণদের মুখে চাঁড়াল, দুর্বৃত্ত, নরাধম অতি অধম ইত্যাদি গালাগালি শুনতে অভ্যস্ত ছিল। এর বিরুদ্ধে হরিচাঁদ গর্জে উঠে বলেছিলেন - ‘যাগযজ্ঞ, বৈদিক ধর্ম/ইহা নহে মতুয়া ধর্ম’। ধর্মের সমতা, সামাজিক সমতা, নিম্নবর্গের মানুষের উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার - এইভাবে এগিয়েছে মতুয়া ধর্ম।
মতুয়া ধর্মে জাতভেদের কোনো ঠাঁই নেই। পরধর্মে সহিষ্ণুতার কথা আছে। ব্রাহ্মণ ও পুরোহিততন্ত্র বিরোধী এই ধর্মমতে ব্যবহৃত লাল নিশান সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। বিজয় পতাকা সংগ্রামের প্রতিবাদের শব্দময় সংকেত। হরিচাঁদ ঠাকুর নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বিভাজন করেননি। তাঁর সংকীর্তনের দলে মেয়েরাও দলনেতা হতে পারতেন। সেই সময় পুত্র-কন্যার সম্পত্তিতে সমান অধিকার, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অর্থসঞ্চয় করার অধিকার, বিবাহে পণ না নেওয়ার অনুশাসন তিনি দিয়েছিলেন। সার্বিক শিক্ষা বিস্তার এবং নারী শিক্ষার বিস্তারে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে এক বৈপ্লবিক ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি বলেছিলেন যে, আত্মোন্নতির জন্য শিক্ষা অর্জন চাই। ১৮৮০ সালে নিজের বাড়িতে প্রথম পাঠশালা, গোয়ালঘরে পাঠশালা, শিক্ষাগুরু ট্রেনিং, ‘মুষ্টিভিক্ষা তণ্ডুল’ সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বসবাসের জায়গা, মেয়েদের স্কুল- নমঃশূদ্র সমাজ এবং বাংলার সমগ্র নিম্নবর্ণের সমাজকে সঞ্চালিত করেছিল। ১৯১১ সালে চণ্ডাল থেকে নমঃশূদ্র রূপান্তরের আন্দোলনের অগ্রভাগেও ছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর।
হরিচাঁদ গড়ে তুলেছিলেন সহজ-সরল ধর্ম - মতুয়া ধর্ম। তাঁর ঈশ্বর ছিল বঞ্চিতের শোষিতের, নির্যাতিতের, অস্পৃশ্যের। মতুয়াধর্ম সত্যিকার অর্থে বাংলার এক অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। গুরুচাঁদ ঠাকুর লিখেছেন - বিশেষত এক কথা কহি সকলেরে/ হিন্দু ও মুসলমান আজি দেশ ভরে।।/ এক ভাষা, এক আশা, এক ব্যবসাতে।/ ....../ দুই ভাই, এক ঠাঁই, রহ মিলেমিশে।।
অথচ মুসলমানকে পায়ের তলায় পিষে হিন্দু সম্প্রদায়িকতার চূড়ায় বসে মতুয়াদের কাছে ভক্ত হতে চাইছে বিজেপি। এহেন মতুয়া মতে পদ্মের যে কিছুটা মাতামাতি তৈরি হয়েছে তা আজ আর অস্বীকার করা যায় না। মতুয়া ধর্ম নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া চলছে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে। ভালো করে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় ভালোবাসা বা আন্তরিকতার চেয়ে নির্বাচনী ক্ষমতা দখলই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। হরিচাঁদ ঠাকুরের মতবাদ ধর্মের নারী কারও অধীন নয় - স্বাধীন। অথচ মোদিদের প্রস্তাবিত সংবিধান ‘মনুসংহিতা’ বলেছে - স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহতি। স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। শুদ্র, নারী পূর্ণ মানব নয়। শুকর, কুকুরের সঙ্গে তুলনীয়।
আর একজনও পিছিয়ে থাকতে চান না। ১৯টা মন্দির আর একটা মাজার পরিক্রমা নন্দীগ্রামে নির্বাচনী মনোনয়ন পত্র পেশের দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মসূচি ছিল। বলেছিলেন - আমার সঙ্গে হিন্দু তাস খেলো না। আমিও মন্ত্র জানি বলে যে মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করেছিলেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কের দৌলতে তা আজও আমাদের কান ঝালাপালা করে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ায় সিংহবাহিনী মন্দির, জানকীনাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। শুভেন্দু বলেছিলেন - আমি ব্রাহ্মণের ছেলে, রোজ চণ্ডীপাঠ করি। তৃণমূল হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মকে ব্যবহার করে লোকসভার থেকে এই বিধানসভায় হিন্দু ভোটের ৭ শতাংশ বাড়িয়ে নিয়েছিল। ধর্মীয় মেরুকরণে এরা সংসদীয় ক্ষমতার সিংহাসনে বসতে চায়। হরিচাঁদ চেয়েছিলেন সহজ সরল ধর্ম। মানুষের জন্য। অথচ এরা ধর্মকে ব্যবহার করতে চায়।
হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে এই বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করে। লক্ষ্য ভোট। আবেগ তৈরি করে ভোট কুড়ানো। কিন্তু সেই আবেগ ভেঙে যায় হরিচাঁদ ঠাকুরের বারটি অবশ্য পালনীয় অনুজ্ঞার দিকে তাকিয়ে। তার প্রথমটি - ‘সদা সত্য কথা বলিবে’। কেন্দ্রের প্রধান এবং রাজ্যের প্রধান দু’জনেই জাল ডিগ্রিতে অভিযুক্ত। প্রথমের আবার জন্মদিন নিয়ে বিভ্রান্তি। দু’জনেই ভোটের আগে এবং পরে জনগণের কাছে মিথ্যার ঝুড়ি খুলতে পারদর্শী। হরিচাঁদ ঠাকুরদের আলোর দিক অনুসরণ না করে ভোটের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারের পথে এরা থাকেন।
মতুয়াদের এক বড়ো অংশ পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু। সেই উদ্বাস্তু জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে বিজেপি এবং তৃণমূল। ২০০৪ সালে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রের কাছে যখন বামফ্রন্ট সরকার ৫০০০ কোটি টাকা চেয়েছিল, তখন বিরোধিতা করেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। নিজে সরকারে এসে কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে কলোনি স্বীকৃতি দেওয়ার নাম করে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তামাশা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ব্যক্তিগত জমিতে যে কলোনি প্রতিষ্ঠিত, তার জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র পরিবর্তন না করে তাকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে এনডিএ সরকার যখন ছিল তখন উদ্বাস্তু সমস্যা আর নেই বলে কেন্দ্রের উদ্বাস্তু দপ্তর উঠিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার বিজেপি'র মন্ত্রী আদবানি। একই পথে হেঁটে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে পৃথক উদ্বাস্তু দপ্তর তুলে দিয়ে তা ভূমি দপ্তরের সঙ্গে যোগ করে দিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, উদ্বাস্তুদের সমস্যা তাঁর কাছে গৌণ। ’৯৩ সাল থেকে এই উদ্বাস্তুদেরই বাংলাদেশি বলে চলেছিলেন মমতা। তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য জ্যোতি বসুর চেয়ার দখল করতে রাইটার্সের দিকে রওনা দিয়েছিলেন বিশৃঙ্খলা করার জন্য। ২০০৩ সালে যে বিধ্বংসী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিজেপি করেছিল মমতা তার শরিক। ওই এক আইনেই উদ্বাস্তুদের সব ধরনের নাগরিকত্বের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বলা চলে, নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ২০০৫-এ উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশের পুশব্যাকের দাবির জন্য লোকসভায় স্পিকারের মুখে কাগজ ছুড়ে মারা আজ ইতিহাস। ২০১৪ সালে উদ্বাস্তু দপ্তরের সচিবালয় ক্যামাক স্ট্রিট থেকে রাজারহাটের কারিগরি দপ্তরে স্থানান্তরিত করেছিল তৃণমূলের সরকার। পুরনো নথি রাখা হয়েছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ার এক পরিত্যক্ত বাড়িতে। বস্তাবন্দি হয়ে জলে ভিজে সব নথি শেষ। নিঃশর্ত দলিল দেওয়ার সময় উদ্বাস্তুরা যে নথি দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল উদ্বাস্তু শংসাপত্র, কনরিট - যেখানে লেখা আছে উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে কবে এসেছিল, কোর্টের এফিডেভিট, কলোনির ম্যাপ, সাইট প্লান ইত্যাদি। মমতা ব্যানার্জিদের দৌলতে সব নথি এখন জলে।
এদিকে বিজেপি এখন নতুন করে উদ্বাস্তুদের অ-নাগরিক সাজাতে চাইছে। বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। আর তার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য নাকি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯। ধর্মকে ভিত্তি করে তৈরি করা নাগরিকত্ব আইনের মধ্য দিয়ে উদ্বাস্তুদের বার্তা পাঠাতে চাইছে যে, আসলে তারা মুসলমান তাড়াতে চাইছে। সাম্প্রদায়িকতার এই বিষবাষ্পে হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিজের কবর তাকে দিয়েই খোঁড়াতে চাইছে বিজেপি। ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার কল্পসুখে বিজেপি যাদের ফাঁসাচ্ছে তারা জানে না দেশভাগের যে পাঠ সেই সময় তাঁদের শ্যামাপ্রসাদ তৈরি করেছিল, আজ দেশভাগের নতুন পাঠ তৈরি করছে আরএসএস-বিজেপি। যার নাম হিন্দু রাষ্ট্র। যাতে মতুয়া, তফশিলি, উদ্বাস্ত, গরিব মানুষ কারোরই কোনো স্বার্থ থাকবে না।