৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০
লেনিন
আভাস রায়চৌধুরী
আজও যে নামে সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত রক্তে দেয় দোলা, মস্তিষ্কের প্রতি কোষে অনুরণিত হয় সংগ্রামী বার্তা। আজও যে নাম সারা পৃথিবীর শোষক আর লুটেরাদের রক্তচাপ বাড়ায়। আজও যে নাম সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষ ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরতে চায়। আজও যে নামের প্রতি সারা পৃথিবীর খেটেখাওয়াদের দুশমনরা ঘৃণা বর্ষণ করে - তিনি ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ লেনিন।
লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিল পৃথিবীর প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই বিপ্লব সারা পৃথিবীর উপনিবেশ বিশেষত ভারতের মতো দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। ইয়োরোপ ও আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণির অধিকার অর্জনের সংগ্রাম নতুন মাত্রায় পৌঁছেছিল। উল্টো দিকে শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে প্রথম থেকেই ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পৃথিবীর প্রায় সব ক’টা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ। সে ছিল বিংশ শতাব্দীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের সূচনালগ্ন। দুনিয়ায় শ্রমজীবী মানুষদের তীব্র শ্রেণিসংগ্রাম ও এগিয়ে যাওয়ার সময়।
রুটি, জমি ও শান্তির স্লোগানে রুশদেশের শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকেরা (আসলে কৃষক সন্তান) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাশিয়াকে পৌঁছে দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে। লেনিনের যোগ্য নেতৃত্ব সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপকার হিসেবে ইতিহাসের ধারায় বলশেভিকদের চির উজ্জ্বল করে রেখেছে। রুশ বিপ্লবের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, এই কাজ ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং বলাবাহুল্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অবশ্য যেকোনো বিপ্লবী প্রচেষ্টা সমকালীন বাস্তবতায় কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণই হয়। বিপ্লবের প্রশ্নে লেনিনকে পার্টি ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে মত ও পথের রণনীতি ও রণকৌশলগত বিতর্ক করেই চলতে হয়েছে। বিপ্লবীদের এভাবেই চলতে হয়। পার্টির অভ্যন্তরে বিপ্লবী সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে লেনিনকে যে বিতর্কের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিন ও সময় নির্ধারণ করতে হয়েছিল ইতিহাসের বিচারে তা ছিল অন্যতম সফল একটি বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের উদাহরণ। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রতি বিপ্লবের মোকাবিলা করে বলশেভিকদের শিশু সমাজতন্ত্রকে রক্ষার সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। এই সময় ছিল ওয়ার কমিউনিজম পর্ব। বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর শিশু সমাজতন্ত্রকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখা এবং যে জনগণ বিপ্লবের অংশগ্রহণ করলেন অথবা সমর্থন করলেন তাদের জীবন মানে উন্নয়ন ঘটানোই বিপ্লবের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়।
১৮৪৮-এ কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশিত হবার পরে পরেই ফরাসি দেশের শ্রমিকরা বিপ্লবী প্রচেষ্টায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। শ্রমিকশ্রেণির সেই বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছিল। ‘এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অফ লুই বোনাপার্ট’এ মার্কস এই বিপ্লবী প্রচেষ্টার অনিবার্য পরাজয়ের মধ্যেই ভবিষ্যৎ বিপ্লবের সম্ভাবনা ইঙ্গিত চিহ্নিত করেছিলেন। ১৮৭১-এ প্যারিসের শ্রমিকরা আবার বিপ্লবী সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। সাময়িকভাবে জয়লাভ করেছে এবং প্যারিস কমিউন গড়ে তুলেছে। প্যারিস কমিউন ৭২ দিন পরে আর টিকে থাকে নি। শাসক বুর্জোয়ারা গ্রামের কৃষকদের কমিউনার্ডদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বিপ্লব ব্যর্থ করেছে। মার্কস-এঙ্গেলসের ভাবনায় শ্রমিক বিপ্লবের জাতীয় ক্ষেত্রে হিসেবে সাধারণভাবে রুশ দেশের কথা উল্লেখিত হয়নি। যদিও ১৮৮২ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহারের রুশ সংস্করণের ভূমিকায় তাঁরা রাশিয়ায় বিপ্লবের ক্ষীণ সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০৫ এ রাশিয়ার শ্রমিকদের বিপ্লবের প্রচেষ্টা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। শ্রমিকশ্রেণির উপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বীভৎসা। ব্যর্থ রুশ বিপ্লবের কারণগুলি খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামের দিকে এগিয়েছিলেন লেনিন। মার্কসবাদী তত্ত্বের নিবিড় অধ্যয়ন, পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লব প্রচেষ্টার ইতিহাস এবং রুশ দেশের বাস্তবতার সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিপ্লব সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন লেনিন। রুশ দেশের বাস্তবতায় বিপ্লবী সম্ভাবনা ও তার সঠিক পথের অনুসন্ধান করতে সেই সময়কার বিপ্লবীদের বিভিন্ন পাঠচক্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। বলা যেতে পারে 'বিপ্লবী লেনিন' হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই পাঠচক্রগুলির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, রুশ দেশের বিপ্লবের সম্ভাবনা চিহ্নিত করতে গিয়ে লেনিনকে পার্টির অভ্যন্তরে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিতর্ক করতে হয়েছে। বিতর্কে সাফল্য লাভ করেছেন, বিপ্লব সংগঠিত করেছেন, বিপ্লব সফল করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পর্বে পিছিয়ে পড়া একটি বিপুল দেশে অনেকটা পিছন থেকে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ শুরু করতে গিয়ে ক্লাসিক মার্কসীয় অর্থনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি' ঘোষণা করতে হয়েছে লেনিনকে। লেনিনের কাছে এটাও কোনো সহজসাধ্য পথ ছিল না। পার্টির ভিতরে ও দেশের শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে আদর্শগত বিতর্ক করতে হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বিপ্লব উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনের নেতৃত্বে নতুন অর্থনৈতিক নীতি সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথে শ্রমিকশ্রেণির সামনে একটি সফল পরীক্ষা ছিল। আজকের চূড়ান্ত প্রতিকূল পৃথিবীতেও লেনিনের সেদিনের সৃষ্টিশীল পরীক্ষার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
লেনিনের দক্ষ নেতৃত্বে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও রাষ্ট্র নির্মাণ চলাকালীনও প্রাক্ বিপ্লবী পার্টির ভিতরের বিতর্কগুলি শেষ হয়ে যায়নি। বরং যথেষ্টভাবেই রয়ে গিয়েছিল। ১৯২৪'র জানুয়ারিতে লেনিনের মৃত্যুর পরে স্তালিন সমাজতন্ত্রকে রক্ষা ও উন্নত করার সংগ্রামে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। লেনিনের সময়ে যে বিতর্কগুলি বলশেভিক পার্টি ও সোভিয়েত সমাজের অভ্যন্তরে কেন্দ্রীভূত ছিল, লেনিন উত্তর সময়ে তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিতর্কগুলি প্রধানত বিপ্লব বিরোধী শক্তি এবং পশ্চিমি অকাদেমিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। প্রাক্ বিপ্লব এবং বিপ্লব উত্তর পরিস্থিতিতে বিতর্কগুলির অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল রাশিয়া শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের জন্য এখনও প্রস্তুত হয়নি, রাশিয়ায় পুঁজিতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়নি ফলে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের জন্য রাশিয়া এখনও প্রস্তুত নয়, বিপ্লবে পার্টির ভূমিকা কী হবে কিংবা বিপ্লব উত্তর সময়ে সমাজতন্ত্র নির্মাণে শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী বাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা কী হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরে আজকের পৃথিবীর তাত্ত্বিক জগতে নতুন করে এই বিতর্কগুলি ফিরে এসেছে এবং আসছে। আজকের দিনে অনেক বুদ্ধিজীবী ও তাত্ত্বিকেরা অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইয়োরোপের সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের ধারণাকে চিহ্নিত করতে চান। এই বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ আবার বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা ও বিপ্লবের সম্ভাবনা অস্তমিত হবার কারণ হিসেবে রুশ বিপ্লবকেই দায়ী করেন। এদের মতে রুশদেশের বলশেভিকরা জোর করে বিপ্লব সংগঠিত করে পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিতর্ক শুধুমাত্র সেদিনের বিপ্লবী সম্ভাবনা পূর্ণ রুশদেশে বিপ্লবের পথকে কেন্দ্র করে পার্টির অভ্যন্তরের বিতর্ককে শুধুমাত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া নয়; সমাজতন্ত্রিক বিপ্লব এবং বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বকারী ভূমিকা কে নস্যাৎ করতে চাওয়ার সংগঠিত প্রচেষ্টা।
লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিনের নেতৃত্বে রুশদেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি যাকে ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণে’র তত্ত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ট্রটস্কির ‘পার্মানেন্ট রেভেলিউশন’র তত্ত্ব সামনে চলে আসে। শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে যারা বাতিল করতে চান তারা অনেকেই আজ উদ্দেশ্যকে আড়ালে রেখে ‘পার্মানেন্ট রেভেলিউশন’র তত্ত্বের আড়ালে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়ে রাখছেন। এটা অন্য বিতর্কের বিষয়। এই প্রবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়। রুশদেশে বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামের দিনে যাঁরা লেনিনের সঙ্গে ছিলেন, এমন অনেকেই বুর্জোদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রণী ও সংগঠিত বাহিনী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা গ্রহণ করেন নি। স্তালিন পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নে মতাদর্শগত বিচ্যুতি, অগ্রণী বাহিনী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিজ শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি ইত্যাদি কারণগুলির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইয়োরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়কে সারা পৃথিবীর কমিউনিস্টরা মূল্যায়ন করবার চেষ্টা করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট মূল্যায়নের চেষ্টা করেছে। শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী বাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমজীবী মানুষের নিজের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই ভূমিকা একটি গুরুতর বিচ্যুতি, যা নিঃশব্দের প্রতিবিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করছে। কিন্তু বিপ্লবের সময় সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে শোষণকে চিরকালের মতো উৎখাত করতে শ্রমিকশ্রেণির হাতে বুর্জোয়াদের বিকল্প একটি সংগটিত বাহিনী প্রয়োজন হয়। ইতিহাসে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের ব্যর্থতার ইতিহাস এই প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে। বিপ্লবী শ্রেণির অগ্রণী বাহিনী কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব শ্রমিকদের ‘ক্লাস ইন ইটসেল্ফ’ থেকে ‘ক্লাস ফর ইটসেল্ফ’-এ উন্নীত করা। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামে অন্যান্য শ্রমজীবী অংশ এবং কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা অপরিহার্য।
মার্কসবাদ সমাজ পরিবর্তনের দর্শন। এই সমাজ পরিবর্তনের অর্থ একটি শোষক শ্রেণির বদলে নতুন একটি শাসক ও শোষক শ্রেণির ক্ষমতা দখল নয়। শ্রমিকশ্রেণি ক্ষমতা দখল করতে চায় বা শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতা দখল করতে হবে সমাজের অন্যান্য শ্রেণিগুলিকে মুক্ত করে নিজেকে মুক্ত করার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণির মূল লক্ষ্য সমাজ থেকে চিরকালের মতো শ্রেণি শোষণকে উচ্ছেদ করা। এই সুদূরপ্রসারী তীব্র কঠিন ও ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী বাহিনী রূপে কমিউনিস্ট পার্টির সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা ব্যতীত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের ভাবনা কেবল কল্পনাই থেকে যায়, বাস্তবের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত ঘটেনি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও ঘটবে না। মার্কসীয় তত্ত্বে লেনিনের অন্যতম অবদানের জায়গাটি হলো কমিউনিস্ট পার্টির ধারণা। এই পার্টি শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতীক। এই পার্টি পরিচালিত হয়, গণতান্ত্রিক-কেন্দ্রীকতার নীতিতে, কেন্দ্রীভূত গণতন্ত্রের নীতিতে নয়। যেহেতু শত্রু দৈত্যাকার, তার হাতে রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং শ্রমজীবী মানুষের উপর হেজিমনি প্রতিষ্ঠার সব ধরনের উপকরণ, তাই যুদ্ধের সংগঠিত সৈন্যবাহিনীর মতো কমিউনিস্ট পার্টিকেও ইস্পাত দৃঢ় হতে হয়। সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির পার্থক্যের জায়গা হলো, এখানে পার্টি সভ্যরা স্বেচ্ছায় পার্টির শৃঙ্খলা গ্রহণ করে এবং তাকে প্রয়োগ করে, পার্টির অভ্যন্তরে সকলের নিজের মতপ্রকাশ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এটা হলো কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরের গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে শক্তিশালী করতে হয়। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয় বলে পার্টিকে একটি কেন্দ্রীয় নির্দেশিকার ভিত্তিতে চলতে হয়। এটা হলো কেন্দ্রীকতা। আজও বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের সামনে ফুল বিছানো পথ নেই বরং পরিস্থিতির জটিলতা এবং শ্রেণি ভারসাম্যের দিক থেকে শ্রমিকশ্রেণি অনেক বেশি রক্ষণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দৃঢ় করেই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা কার্যকর করা কমিউনিস্টদের পার্টি জীবনের মূল চালিকাশক্তি। পার্টির অভ্যন্তরের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার সুস্থ ও দৃঢ় প্রয়োগ কখনোই বৃহত্তর সমাজে শ্রমিকশ্রেণি, শ্রমজীবী জনগণ এবং কমিউনিস্ট পার্টির দরদীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে না। বিচ্ছিন্নতা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন মতাদর্শের ঘাটতি কিংবা বিচ্যুতি সৃষ্টি হয়। কমিউনিস্টরা যেকোনো সংকটের সময় বারে বারে শ্রমজীবী মানুষের কাছেই ফিরে যান। ফিরে যেতে হয়। আজ আমাদের রাজ্যে এই কাজ আমাদের পার্টিকে করতে হচ্ছে। খেটেখাওয়া মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের পুনঃস্থাপন রাজ্যে পার্টির শক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা দিচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যদের জীবনে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার দৃঢ় ও সুস্থ প্রয়োগ এবং যেকোনো সমস্যা ও প্রতিকূলতায় জনগণের কাছে খোলামেলা আলোচনার মধ্য দিয়ে তার কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে তাদের আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এবং অবশ্যই শ্রমজীবী মানুষকে ‘ক্লাস ফর ইটসেল্ফে’ রূপান্তরিত করে যে কোনো প্রতিকূলতায় কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্টরা এগোতে পারে। পার্টি সম্পর্কে এটাই হলো লেনিনীয় শিক্ষা।
রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলসের বিভিন্ন রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা। বিপ্লব সংগঠিত করতে চাওয়া শ্রমিকশ্রেণির সামনে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণাকে সংগঠিতভাবে উপস্থিত করেছেন লেনিন তার রাষ্ট্র বিপ্লব রচনায়। বুর্জোয়া রাষ্ট্র সম্পর্কে তিনি বলেছেন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ধরন যাই হোক না কেন আসলে তা শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব। সমাজ থেকে শ্রেণির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণিকে এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করতে হয়, উচ্ছেদ করতে হয় এবং শ্রেণিহীন সমাজে পৌঁছানোর পথে একটা সময় পর্যন্ত নিজেদের একটা রাষ্ট্র গড়ে নিতে হয় এবং সেই রাষ্ট্রে অন্যান্য অশোষক শ্রেণি ও সামাজিক অংশগুলিকে যুক্ত করতে হয়। লেনিনের মত অনুযায়ী, শ্রমিকশ্রেণির এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে হতে হবে প্রলেতারিয় একনায়কত্ব। লেনিন, মাও জেদং সহ প্রতিটি সফল বিপ্লবী মার্কস তত্ত্বের মৌলিক লক্ষ্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই তার সৃষ্টিশীল বিকাশ ঘটিয়েছেন। পৃথিবীর কোথাও বিপ্লবের রেপ্লিকা ঘটেনি এবং ঘটবেও না।
সাত দশক পর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় কিংবা আজকের প্রতিকূল বিশ্বে সমাজতন্ত্র নির্মাণের সংগ্রামে চীনের অভিজ্ঞতা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও নির্মাণ কতগুলি নতুন নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে, কতগুলি নতুন নতুন সম্ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান প্রযুক্তি, উৎপাদনের ধরন এবং সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পাশাপাশি ধনবাদী দুনিয়ার কতগুলো পরিবর্তন একুশ শতকের সমাজতন্ত্র নির্মাণের সামনে নতুন কতগুলো সম্ভাবনার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র বিংশতি পাটি কংগ্রেসে গৃহীত মতাদর্শগত দলিলের বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে একুশ শতকে সমাজতন্ত্র নির্মাণের ধারণা। একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের নির্মাণ বিশ শতকের সমাজতন্ত্রের নির্মাণের রেপ্লিকা হবে না। বিশ শতকের বাস্তবতায় লেনিন প্রলেতারিয় একনায়কত্বের যে ধারণা দিয়েছিলেন, আকাশছোঁয়া সাফল্য সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে তার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা, মতাদর্শগত বিচ্যুতি শ্রমিকশ্রেণি পার্টি এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচ্যুতি ঘটেছিল। একুশ শতকে সমাজতন্ত্রে নির্মাণে পরিবর্তনশীল সমাজ, অর্থনীতি ও মনন চেতনায় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রকে আরও অনেক বেশি প্রসারিত করার সম্ভাবনা কার্যকর করা সম্ভব। পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও আজকের প্রকৃত অর্থেই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে নতুন সৃষ্টিশীল প্রয়োগ জরুরি।
মার্কসীয় তত্ত্বে লেনিনের অন্যতম একটি সংযোজন হলো সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত তত্ত্ব। লেনিন ছাড়াও রোজা লুক্সেমবার্গ সহ কয়েকজন বিপ্লবী সম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তাদের ধারণা উপস্থিত করেছিলেন। বিশ শতকের গোড়ায় লেনিন দেখিয়েছিলেন পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছেছে। আগে উল্লেখিত হয়েছে মার্কস-এঙ্গেলসের ধারণায় শ্রমিক বিপ্লবের কেন্দ্রে রাশিয়া ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে রাশিয়া বিপ্লবের অভিমুখী হয়েছিল। লেনিন ও বলশেভিকদের রুটি, জমি ও শান্তি স্লোগানে সাড়া দিয়েছিলেন রুশদেশের শ্রমজীবী মানুষ। এই স্লোগানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বস্তুগত উপাদানটি খুঁজে পেয়েছিলেন লেনিন। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কিংবা সাড়া দেওয়া যে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু পরিস্থিতির বাস্তবসম্মত সম্ভাবনার চাবিকাঠি কোনটি? লেনিন দেখালেন সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছে যাওয়া বিশ্ব পুঁজিবাদের সবথেকে দুর্বলতম গ্রন্থিটি হলো রাশিয়া। ফলে সেখানে যদি শ্রমিকশ্রেণি আঘাত করতে পারে তাহলে বিপ্লব সফল হতে পারে। ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। প্রসঙ্গক্রমে রুশ বিপ্লবের সমর্থনে আন্তোনিয় গ্রামশির ‘রেভোল্যুশন এগেনস্ট দাস ক্যাপিটাল’ রচনাটির উল্লেখ করা যেতে পারে।
লেনিন তার সময় পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তর কে আবিষ্কার করে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন। আজকের পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদ কি লেনিনের ব্যাখ্যা করা, লেনিনের সময়ের সাম্রাজ্যবাদের অবস্থাতেই রয়েছে? এর সহজ উত্তর ‘না’। লেনিনের সময় সাম্রাজ্যবাদ জাতীয় পরিচিতিতে গণ্ডিবদ্ধ ছিল। আজ ফিন্যান্স নেতৃত্বকারী আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক চরিত্র লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, পুঁজিবাদের উৎপাদনমুখী বৈশিষ্ট্য থেকে ফাটকা, বিশেষত ২০০৮-পরবর্তী কালের পৃথিবীর অভিজ্ঞতায় বলা যায় সর্বব্যাপী লুণ্ঠনের আকার নিয়েছে। ফলে আজকের পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণির ‘বিপ্লবী সংগ্রামের সম্ভাবনা’কে বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনা অনেক বেশি আন্তর্জাতিক। এই পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থি কোনটি তা চিহ্নিত করা সৃষ্টিশীল মার্কসবাদীদের কাজ।
অন্য একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ খুবই জরুরি। সাধারণভাবে বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা লেনিনকে শুধুমাত্র একটি বিপ্লবের নেতা হিসাবে উল্লেখ করতে রাজি। বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা লেনিন মনে করতেন বিপ্লবী দর্শন ছাড়া কোনো বিপ্লব সম্পন্ন হতে পারে না। মার্কসবাদ প্রয়োগের দর্শন। তত্ত্বচর্চা ও তার প্রয়োগের অভিজ্ঞতা অর্জন, পুনরায় তত্ত্বচর্চা ও নির্মাণ এবং পুনরায় তার প্রয়োগ - মার্কসীয় জ্ঞানতত্ত্বের এই সাধারণ ধারায় যে কোনো বিপ্লবী কে পটু হতে হয়। লেনিন এই জন্যই ‘লেনিন’, যে তিনি এ কাজে পটু হয়েছিলেন। সাধারণভাবে মার্কস ও এঙ্গেলসকে দর্শনের জগতে বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তীব্র সংগ্রাম করতে হয়নি। কারণ দর্শনের জগতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। তবে সেই বস্তুবাদের চরিত্র ছিল যান্ত্রিক। অর্থাৎ ভাব জগত তো বটেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই বস্তু জগতের বাইরে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। দর্শনের জগতে বস্তুবাদকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। মার্কস পূর্ববর্তী দার্শনিক হেগেল থেকে দ্বান্দ্বিকতার ধারণাকে গ্রহণ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ গড়ে তুলেছিলেন। লেনিন মার্কসীয় দর্শন শব্দের পরিবর্তে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। লেনিনের সময় বিজ্ঞান ও বস্তুবাদের নামে দর্শনে ভাববাদ ফিরে এসেছিল। যার মূল কথা ছিল অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই একমাত্র যুক্তি পূর্ণ সত্য। এর বাইরে কোনো কিছু অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই চিন্তাকে দর্শনের জগতে প্রত্যক্ষ বিচারবাদ নামে উল্লেখ করা হয়। আসলে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকেই একমাত্র যুক্তিপূর্ণ সত্য বলে ধরে নেওয়া, এর বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হলো বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে অবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলা। প্রত্যক্ষ বিচারবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অস্ট্রিয়ার চিন্তাবিদ আর্নেস্ট মাখ। মাখের প্রত্যক্ষ বিচারবাদ ছিল আসলে বস্তুবাদ ও বিজ্ঞানের নামে ভাববাদেরই পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রাশিয়াতে সেই সময় বিজ্ঞান ও বস্তুবাদের নামে মাখের এই প্রত্যক্ষ বিচারবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। লেনিন এই চিন্তার বিরুদ্ধে দার্শনিক সংগ্রাম পরিচালনা করেন। সেই সংগ্রামের অন্যতম ফসলটি হলো লেনিনের ‘মেটিরিয়ালিজম অ্যান্ড এম্পিরিও ক্রিটিসিজম’ রচনাটি। মাখের প্রত্যক্ষ বিচারবাদকে যদি মেনে নিতে হয় তাহলে দ্বান্দ্বিকতার অস্তিত্বকে বিসর্জন দিতে হয়, বিপ্লবী সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির অর্থাৎ মানুষের সচেতন ভূমিকাকে অস্বীকার করতে হয়। মাখের প্রত্যক্ষ বিচারবাদকে যদি সেদিন লেনিন মেনে নিতেন তাহলে রুশদেশের মাটিতে বিপ্লব অলীক কল্পনায় থেকে যেত। বিপ্লবীদের কাছে বিপ্লব এসে দুয়ারে ডাক দিয়ে জাগিয়ে তুলবে,তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তে হতো।
আজ পৃথিবীর শ্রেণিভারসাম্য শ্রমিকশ্রেণির বিপক্ষে। পৃথিবীর কোথাও দিগন্তে শ্রমিক বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও পুঁজিবাদকে একমাত্র প্রতিস্থাপন করতে পারে সমাজতন্ত্রিক বিকল্প। আজ তাত্ত্বিক জগতে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী কর্তব্য ও বিপ্লবের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার জন্য নতুন রাংতায় পুরনো তত্ত্বকে উপস্থিত করার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা দার্শনিক লেনিনের মতাদর্শগত সংগ্রামকে মনে করিয়ে দেয়। আসলে মার্কস-এঙ্গেলসের মতোই লেনিনও ছিলেন একাধারে বিপ্লবী এবং অবশ্যই দার্শনিক। যদিও অকাদেমিক মহল লেনিনকে দার্শনিক হিসেবে খুব বেশি স্বীকৃতি দেয় না। তা না দিক। আসলে মার্কসবাদীদের কাছে দর্শনচর্চা প্রয়োগ বিচ্ছিন্ন নিরালম্ব শুধুমাত্র অকাদেমিক বিষয়বস্তু নয়। বিপ্লবের প্রয়োজনে দার্শনিক তত্ত্ব থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বিপ্লবের সংগ্রামকে প্রসারিত করা হলো মার্কসবাদীদের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ঐক্য। এই জন্যই মার্কসবাদ হলো প্রয়োগের দর্শন। লেনিনের প্রায় প্রতিটি লেখাতেই দার্শনিক তত্ত্বের মনিমুক্ত ছড়ানো আছে। আবার মার্কসের মতোই লেনিনের প্রতিটি রচনা ছিল শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির দর্শনকে প্রয়োগের জন্য মতাদর্শগত সংগ্রাম ও বিপ্লবী সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা থেকেই লেখা। লেনিন যে কাজ সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, মৃত্যুর পর তা ফিলোজফিক্যাল নোটবুক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। তা পড়লে বোঝা যায় দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের এই নেতার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি কত উন্নত ছিল। তাঁর দর্শন চর্চা ছিল শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের জন্য নিবেদিত, বুর্জোয়া স্বীকৃতির জন্য নয়। বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ ও সেই অনুযায়ী প্রয়োগে যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য সকল মার্কসবাদীকে প্রস্তুতি নিতে হয়। মার্কসবাদী সে, যে তার নিজের সময়ে নিজের বাস্তবতায় মানব মুক্তির জন্য সংগ্রামে সৃষ্টিশীল হতে চেষ্টা করে। সৃষ্টিশীলতা বাদ দিয়ে স্থবির জলাশয়ে সাঁতার কেটে জলাশয়ের এপার থেকে ওপারে চলাচল করাটা কোনো মার্কসবাদীর কাজ নয়। দুনিয়ায় কোনো সফল মার্কসবাদী এ কাজ করেন নি। ‘দার্শনিক লেনিন’, ‘বিপ্লবী লেনিন’র সমগ্র জীবন ও সংগ্রাম এই শিক্ষাই দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির সামনে উপস্থিত করেছে।