E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০

বের্টোল্ট ব্রেখট ও তাঁর কবিতা

পল্লব সেনগুপ্ত


● যদিও ইউজিন বের্থোল্ড ফ্রিডরিশ ব্রেখট (অন্তত আমাদের কাছে) মূলত পরিচিত তাঁর অসামান্য কিছু নাটকের জন্যই, তবু আরও একটা কথা তাঁর প্রসঙ্গে আলোচনা না করলে, স্রষ্টা হিসেবে মানুষটির সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করা যাবে না। সেটা হলো তাঁর কবিতা। এই ২০২৩ সালে তাঁর জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি হচ্ছেঃ সেই উপলক্ষেই এদেশে তাঁর প্রায়-অনালোচিত সেই বিষয়টি নিয়েই এ নিবন্ধের অবতারণা করা গেল।

ব্রেখটের জন্ম ১৮৯৮-র ১০ ফেব্রুয়ারি, জীবনাবসান হয় ১৪ আগস্ট, ১৯৫৬। ফলত, দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে-পড়া একটি দেশের মানুষ হিসেবে সেই নির্মম অভিজ্ঞতার প্রতিভাস তাঁর লেখায় প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে বিধৃত আছে - নাটকে একভাবে, কবিতায় অন্যভাবে। যে রাজনৈতিক প্রত্যয় তাঁকে লেখক হতে প্রণোদনা জুগিয়েছে, সেই কমিউনিজমের সঞ্জীবনীতে তাঁর সৃষ্টিগুলি অনুপ্রাণিত হয়েছে - অবশ্য সেটা কোথাও বেশি, কোথাও বা কিছু কম। কিন্তু সাম্যবাদী ভাবনার গরহাজিরা ঘটেনি কখনওইঃ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সামগ্রিক উপলব্ধির জন্য যেসব চিন্তার নানাভাবে উদ্‌ভাস ঘটে, সেগুলোই ব্রেখটের কবিতায় এবং নাটকে ব্যঞ্জিত হয়েছে।

।। দুই ।।

ব্রেখটের বিভিন্ন লেখা থেকে কিছু-কিছু কঠিন ও অনিবার্য সত্যের প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে, তা যদি এই সূত্রে স্মরণ করি - তাহলেই কিছু তাঁর রাজনৈতিক প্রত্যয়ের পরিচয়টা ঠিকঠাক পাওয়া যাবে। যেমনঃ

ক) ‘‘শিল্প কখনোই বাস্তবের দর্পণ নয়; বরং তা হলো বাস্তবকে গড়েপিটে নেবার হাতুড়ি।’’
খ) ‘‘অরাজনৈতিক-শিল্প সৃষ্টির অর্থ, শাসকশ্রেণির সঙ্গে দোস্তালি।’’
গ) ‘‘অন্ধকার ঘিরে-থাকা সময়েও গান গাইতে হবে - হ্যাঁ, তা হবে সেই সময়টাকে চেনানোর গান।’’
ঘ) ‘‘তুমি যদি মনে করো টাকা চুরি করবে, তাহলে ব্যাঙ্ক-ডাকাতি না করে বরং ব্যাঙ্ক খোল একটা।’’
ঙ) ‘‘ক্ষুধার্ত মানুষ হাতে বই তুলে নাও, ওটাই হবে তোমার হাতিয়ার।’’
চ) ‘‘সবচেয়ে বড়ো অশিক্ষিত হলো সে - যার কোনও রাজনৈতিক শিক্ষাই নেই।’’
ছ) ‘‘মশাইরা, আপনাদের চমৎকার ওই সব তত্ত্ব আওড়াতেই পারেন, কিন্তু যতক্ষণ আমাদের দু-মুঠো অন্ন না জুটছে, ওইসব ঠিক- ভুলের কড়চা অপেক্ষা করতে পারে বরং।’’
জ) সেই দেশ বড়োই অসুখী, যার জন্যে আলাদা করে বীর নায়কদের দরকার হয়।’’
ঝ) ‘‘যখন ঝড় ওঠে আকাশে, তখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা না করে, নিজেই নিরাপদ একটা আশ্রয় খুঁজে নাও।’’
ঞ) ‘‘প্রত্যেকেরই প্রয়োজন হয় অন্যদেরকে।’’
ট) ‘‘এমন কিছুই নেই, যার পরিবর্তন করা যায় না।’’
ঠ) ‘‘ধনতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই না-করে হারানো যায় না ফ্যাসিবাদকে।’’

বিভিন্ন নিবন্ধে-নাটকে ছড়িয়ে-থাকা এই সমস্ত তিক্তকষায় সত্যবাচনগুলির মধ্যেই ব্রেখটের রাজনৈতিক প্রত্যয়, শিল্প এবং তার সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, এবং ঈশ্বর-কল্পনা, সমাজ ভাবনা আর নান্দনিক-চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে মোটামুটি পুরোপুরিভাবেই। এ ধরনের আরও অজস্র কথা তাঁর প্রচুরায়ত লেখার মধ্যে খুঁজলেই মিলবে, তবে মনে হয় এই বারোটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। এদের মাঝেই তাঁর সৃষ্টির (যা-কিনা তাঁর জীবনেরই অনবচ্ছিন্ন অংশ) পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে। আর এই পরিপ্রেক্ষাতেই ব্রেখটের কয়েকটি খুব উল্লেখযোগ্য কবিতার প্রতিবেদন করা যেতে পারে হয়ত বা!

।। তিন ।।

(এক)

ইতিহাসের বই পড়ে কোনও এক শ্রমিকের প্রশ্ন

সাত-সাতখানা দরোজাওয়ালা থিবস শহর গড়ে তুলেছিল কারা?
বইতে তো শুধু পাতা জুড়ে আছে রাজারাজড়ারই নাম -
তারাই কি তবে বয়ে এনেছিল পাথরের চাঁইগুলো?
আর ব্যাবিলন? ধ্বংস স্তূপ হয়ে পড়েছিল কতবার -
তাহলে আবার তাকে বারবার ফের গড়েছিল কারা?
সোনায়-মোড়ানো লিমা নগরীর মিস্ত্রিরা কোথা থাকত?
চিনের প্রাচীর যেই-সন্ধ্যায় শেষ হয়েছিল তৈরি -
মজুরের দল তারপরে সব কোন্‌খানে চলে যায়?
রোম শহরের হেথা হোথা যত জয়স্তম্ভ ছিল
যাদের শ্রমেতে তৈরি সেগুলো - নামহীন তারা আজও।
এত প্রশংসা বৈজন্টিম পায় কবিদের গানে,
যেখানে থাকত প্রাসাদগুলোর মালিকেরাই শুধু?
গল্পকথায় আটলান্টিস শহরের খোঁজ মেলে,
যে-রাত্রে সেটা সমুদ্রে ডোবে, তখনও কি হাঁকডাকে
মালিকের দল জানতে চেয়েছে, ‘‘কেনা গোলামেরা কই?’’
উদ্ধত যুবা আলেকজান্দ্র একাই কি গিয়েছিল
বহু দূর দেশ ভারতবর্ষ দখলের অভিলাষে?
গল্‌ যুদ্ধের বিজয়োৎসবে সিজারের সাথে কোনও
ভৃত্য-পাচক ছিল না কি কেউ? একজন ক্রীতদাসও?
হিস্পানিরাজ ফিলিপের যত যুদ্ধজাহাজগুলো
হেরে গিয়ে সব যখন ডুবেছে মহাসাগরের জলে,
তখন কি শুধু ফিলিপ একাই ফেলেছে চোখের জল?
ফ্রেডারিক­দুই জিতেছিল ঠিকই সাত বছরের যুদ্ধে -
যাদের শৌর্যে - ইতিহাসে তারা নামহীন হয়ে আছে।
ইতিহাস-বইয়ে প্রতিটি পাতায় যুদ্ধজয়ের কথা -
বিজয়ীদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে রান্না করত কারা?
প্রতি দশকেই একজন করে নেতার আবির্ভাব
হয় যদি তবে তাদের জন্যে খরচ মেটায় কারা?
অনেক খবর; অনেক প্রশ্ন। নেই কোনও উত্তর।।


(দুই)

বই পোড়ানো এবং এক কবির দাবিপত্র

যখন সরকারি হুকুম এলো বিপজ্জনক কথাবার্তা শেখায়
এমন সব বইপত্তর সর্বত্র পোড়াতে হবে, প্রকাশ্যে -
আর সেই জন্যে বলদে-টানা গাড়িগুলো বোঝাই করে অজস্র বই
নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঘটা-করে-জ্বালানো চিতায় ফেলতে -
নির্বাসিত এক বুড়ো কবি - বেশ বিখ্যাতও বটে - দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন
সেই পোড়ানোর লিস্টিতে তাঁর কোনও বইয়েরই
নাম না দেখে! উনি ভাবলেন, ওরা ভুলেই গেছে বোধহয় সেগুলোর কথা!
রাগে গস্‌গস্‌ করতে করতে উনি প্রায় উড়েই গেলেন ওঁর লেখার টেবিলে,
কত্তাবেক্তিদের কাছে একখানা পত্তর লেখার জন্যে -
খস্‌খস্‌ করে লিখে চললেন বুড়ো কবি, ‘‘পোড়াও, পোড়াও -
এভাবে আমাকে হেনস্তা না করে, আমার সব বইও পুড়িয়ে ফেলো
অছেদ্দা করে আমায় বাদ দিও না...
আচ্ছা, আমিও কি চিরকাল ধরে শুধু সত্যি কথাই লিখিনি বইতে?
আর এখন তোমরা আমাকে সাব্যস্ত করতে চাইছো মিথ্যুক বলে!
আমি হুকুম করছিঃ
পোড়াও আমাকেও... আমার বইগুলোকে...


(তিন)

শয়তানের মুখোশ

আমার ঘরের দেয়ালে একটা জাপানি মুখোশ ঝোলানো আছেঃ
ভয়ানক একটা দানবের মুখোশ। সোনার জলের প্রলেপ বুলোনো।
খুব সহানুভূতি নিয়ে আমি দেখি সেটাকে যখন
আমার চোখে পড়ে ওটার কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে -
বোঝাই যায়, শয়তান হতে গেলে কী চাপই না নিতে হয়!


(চার)

শিল্পকলা আকাদেমি দাবি করেছিল সৃষ্টির স্বাধীনতা

তাদের দাবিটা ছিল মাছি-মারা আমলাদের কাছে।
আশপাশে হইচই পড়ে যায় সেজন্যে, হুঙ্কারও শোনা গেছিল।
কিন্তু সমস্ত শব্দকে ছাপিয়ে শোনা গেল হাততালির বজ্রধ্বনি,
মহল্লার বাইরে থেকেও।
স্বাধীনতার গর্জন ধ্বনিত হলো -
চাই, শিল্পীর স্বাধীনতা, সবকিছুর স্বাধীনতা, সকলের জন্য স্বাধীনতা
শোষকদের থেকে রেহাই পাবার স্বাধীনতা, যুদ্ধবাজদের কবল থেকেও,
অস্ত্র বোঝাই গাড়িগুলোর উৎপাত থেকে মুক্তি পাবার স্বাধীনতা,
হিটলারের বাহিনীর কবল থেকে বাঁচবার স্বাধীনতা।
বন্ধুগণ! খুব সঙ্গোপনে কিন্তু! বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্ত ভালবাসার ছলে
বিপন্ন করবে শিল্পীদের, শ্রমিকদের অচিরেই।
একমুখ হেসে তারা কখন চুপিসাড়ে ঢুকে পড়বে শিল্প আকাদেমিতে
লুকিয়ে পেট্রোলের টিন হাতে, সব পুড়িয়ে খাক করে দেবার মতলবে।
কিন্তু তাদেরকে (বন্ধু ভেবে) জড়িয়ে ধরতে যেও না,
ওর নোংরা হাতে ধরা জ্বালানির পাত্রটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিও বরং।
আমরা তো চেয়েছিলাম পাশের একটামাত্র ঘরই,
যেখানে খুব সামান্য বিদ্যেবুদ্ধিওয়ালাও শান্তি খুঁজে পাবে,
আর শিল্পের কদর করবে; ঘোষিত সব সমঝদারদের থেকে অনেক বেশিই।
কারণ, সেই শিল্পরসিকরা তো আবার যুদ্ধের শিল্পকেও পছন্দ করে।


(পাঁচ)

নরক সমীক্ষা

নরক-সমীক্ষা কথাটা একবার শুনেছিলামঃ
আমারই ভাই শেলি জায়গাটাকে অনেকটা লন্ডন শহরের মতোই মনে করেছিল।
আমি অবশ্য লন্ডনে থাকিনি কখনও, তবে আমার মনে হয়েছে
বরং নরকের সঙ্গে লস এঞ্জেলসেরই মিলটা বেশি।
আমার কোনও সন্দেহ নেই, সেখানেও এরকম সাজানো-গোছানো
সব বাগান আছে - গাছের মতো বিরাট বিরাট মাপের নানান ফুল ফোটে সেখানে,
আর ঠিক মতো খুব দামি জল দেওয়া না হলে খুব তাড়াতা‍‌ড়ি শুকিয়ে যায়।
আর সেখানকার ফলের বাজারে পাঁজা পাঁজা ফলগুলোর না আছে স্বাদ,
আর না আছে কোনও গন্ধ!
সেখানে অবিরাম গাড়ির স্রোত রাস্তায় -
গাড়িগুলো যেন ছায়ার চেয়েও হালকা, আর
বোকা বোকা ভাবনাচিন্তার চেয়েও জোরে ছোটে।
আর বসত বাড়িগুলো? সুখী সুখী একটা জীবন কাটানোর জন্যে
তৈরি হলেও, বাড়ি-ভরতি বাসিন্দা থাকলেও, একদম খালি বলে মনে হয়।
তবে কি-না সেসব সত্ত্বেও বাড়িগুলো কিন্তু বড় হতকুচ্ছিৎ নয়।
কিন্তু দুশ্চিন্তা হয় তাদের নিয়েই, যাদের পথেই কাটে রাত এবং দিন,
তাদের খিদেও কিন্তু বড়োলোকী বাংলোর, অথবা
মধ্যবিত্তের বারাকের বাসিন্দাদের চেয়ে একটুও কম নয়!


(ছয়)

কী ঘটছে বলুন তো?

শিল্পপতিরা নিজেদের প্লেনগুলোকে মেরামত করাচ্ছে।
ধর্মযাজকরা ভাবছে দু’মাস আগে নরকের বৈতরণী নিয়ে কী বলেছিল।
সেনাপতিরা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে ভাবতে-ভাবতে
ব্যাঙ্কের কেরানিদের মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে।
রাস্তায় পুলিশও গরিব, সস্তা টুপি মাথায় লোকদেরও
ঠিকঠাক রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছে -
বাড়িওয়ালা ভাড়াটের ঘরে গিয়ে শুধোচ্ছে, ঠিক মতো জল আসছে কি-না?
খবরের কাগজের লোকেরা ‘জনসাধারণ’ শব্দটা বড়ো বড়ো হরফে
লিখেছে! ...গাইয়ে বিনে পয়সায় গান গাইছে অপেরাগুলোতে,
ডাক্তাররা বিমা কোম্পানিগুলোর নামে মামলা ঠুকে দিচ্ছে, আর
পণ্ডিতরা নিজেদের আবিষ্কার সকলের কাছে তুলে ধরছে,
খেতাবি চটকদারিগুলো আড়ালে রেখেই।
চাষিরা সৈন্যদের ব্যারাকে নিজেরাই সবজি পৌঁছে দিচ্ছে।
আসলে ব্যাপারটা হলোঃ বিপ্লবের প্রথম পর্ব সফল হয়েছে।
ঘটনাই এইটাই।

।। চার ।।

এমন কথা কখনোই বলা যাবে না যে, অনুবাদ করা এই ছ’টি কবিতাই শুধু ব্রেখটের কাব্যকৃতির প্রতিনিধিস্থানীয়। আন্তর্জালের তথ্যভাণ্ডার জানাচ্ছে যে, তাঁর লেখা কবিতার সংখ্যা কমবেশি ২,৫০০ - যার প্রায় ৫০ শতাংশই অজার্মান কোনও ভাষার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে, ‘Poems 1913-1956: Bertolt Brecht (1997) এবং ‘Poetry and Prose: Bertolt Brecht’ (2003) - এই দুটি প্রামাণ্য সঙ্কলনের মধ্যে তাঁর যে- লেখাগুলি পাওয়া যায়, তাতে সামগ্রিকভাবে তাঁর কাব্য সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ধারণা করা যায় বলেই মনে হয়। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত ডেভিড কন্সট্যান্টাইন এবং টম কুহ্‌ন অনূদিত ‘The Collected Poems of Bertolt Brecht’ বইতে প্রায় ১,২০০ কবিতা সঙ্কলিত আছে। এবং এটাও জানা গেছে যে, ব্রেখটের অজস্র কবিতাই কখনও মুদ্রিত হয়নি এবং বহু মুদ্রিত কবিতাই ফ্যাসিস্ট আমলে জার্মানিতে এবং ম্যাকার্থি-আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেন্সরের কাঁচিতে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে - যার বহুসংখ্যক অংশই এখন হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো।

অনুবাদের মাধ্যমে পাওয়া কবিতাগুলি থেকেই অবশ্য কবি হিসাবে তাঁর প্রাপ্য পরিচয়কে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর প্রাপ্ত (অবশ্যই অনুবাদে!) কবিতাগুলিকে একটু ভেবেচিন্তে পড়লে মোটামুটিভাবে কিছু শ্রেণিবিভাজন করা সম্ভব। সমসাময়িক বহু ছোটোবড়ো ঘটনার প্রতিভাস যেমন আছে তাদের মধ্যে, তেমনই ব্যক্তিগত বহু অনুভব-অভিজ্ঞতাও সেখানে প্রাপ্য। রাজনৈতিক চেতনার অভিঘাত এবং সেই সূত্রে আর্থ-সামাজিক শ্রেণি অবস্থানের আতীব্র চিত্রায়নের (বিশেষত ১৯২০ নাগাদ কমিউনিজমের আদর্শে অপুপ্রাণিত হবার পর থেকে) একটা বিরাট ভূমিকা আছে ব্রেখটের কবিতায়। আর ঠিক এই কারণেই তিনি নিজের কবিতাকে দ্বান্দ্বিক (ডায়ালেক্টিক্যাল) বলেছেন, যেমন নিজের নাটক তাঁর আপন কথায় মহাকাব্যিক (এপিক্যাল)!

ব্রেখটের কবিতাকে পাঠকদের একগোষ্ঠী মনে করেন তা হলো ‘‘প্রতিবেদক বাচনধর্মী শিল্প’’ (কমিউনিকেটিভ স্পোকেন আর্ট)। এবং তাঁর কবিতার মহলে নিবিষ্টভাবে ঢুকলে বোঝা যায় যে, তাঁর সেই প্রতিবেদন হলো, বুর্জোয়া-সুলভ বিভিন্ন (আরোপিত) মুল্যবোধের বিরোধী, জঙ্গী মানসিকতা, শ্রেণিশোষণ এবং কল্পনায় আপ্লুত হবার বিরোধী। ব্রেখট যে সময়ে লিখতে শুরু করেন, তখন জার্মান কাব্যে ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’দের ব্যাপক প্রভাব। এবং সেই বাস্তব-বিমুখী অসংলগ্নতা ধর্মী সংবেদনের বিরুদ্ধে সরব হন ব্রেখটই সর্বপ্রথম। ব্রেখটের কবিতা বহুক্ষেত্রেই সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহৃত (বিশেষত তাঁর নাটকে), তবু মানতেই হবে যে, রূঢ়-বাস্তবতা থেকে সেগুলি বিচ্ছিন্ন হয়নি। ঠিক এই কারণেই সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুষঙ্গে যে ‘ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক ব্যুরো’ তৈরি করা হয় কয়েক বছর পরেই, সেখানে ১৯৩৪ সালে ব্রেখট আমন্ত্রিত হন, আর তারই সূত্রে রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত ‘ইউনাটেড ফ্রন্ট সং’। পরবর্তীকালে স্পেনের গৃহ যুদ্ধের সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ে ব্রেখটের লেখা এই গানটি ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’-এর যোদ্ধারা গাইতেন - নিজেদের সংঘশক্তিকে প্রেরণা দিতেই!

।। পাঁচ ।।

ব্রেখটের একটি কবিতা আছেঃ ‘I Live in Dark Times’, জার্মানিতে যখন নাৎসিরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, সেই পটভূমিটার প্রাথমিক ইঙ্গিত সূচিত হয়েছে কবিতাটির মধ্যে। তারপরে তো, হিটলারি বাহিনীর উচাটনে দেশছাড়া হন ব্রেখট - স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলিতে প্রথমে, তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এবং সর্বত্রই কমিউনিস্ট বলে চিহ্নিত হবার কারণে তাঁর বিড়ম্বিত হওয়া বারংবার। আর সবটা মিলিয়েই তৈরি হয়েছিল তাঁর ওই ‘‘ডার্ক টাইমস’’ - তমসাবৃত কলি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে জার্মানি যখন দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, ব্রেখট তখন ফেরেন স্বদেশে - জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অর্থাৎ কমিউনিস্ট সরকার পরিচালিত অংশে। লেখক সঙ্ঘের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে তখন সাংগঠনিক কাজে বেশি ব্যাপৃত হন এবং নিজের লেখাটা - বন্ধ না হলেও, স্তিমিত হয়ে যায়।

ব্রেখটের কবিতায় অনেক সময়েই মৃদু-হতাশ্বাস দেখা গেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ব্যাপক হয়ে ওঠেনি কখনও। বরং ধনতন্ত্রে পরিপ্রেক্ষায় যেসব নাগরিক-বৈভব প্রকট হয়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ এবং শানিত প্রতিবাদই সেখানে শেষ পর্যন্ত গম্ভীর স্বরে ধ্বনিত হয়েছে। আর, ধনতান্ত্রিক সমাজের শোষণকারী মূল্যবোধের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষদের প্রতি সমবেদনায়, তাঁর কবিতা (নাটকের মতোই - হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। তেমনই একটি কবিতার অনুবাদ উদ্ধৃত করে এই আলোচনাটা সাঙ্গ করব। কবিতাটা ছোটো হলেও ব্যালাডধর্মী। নামঃ ‘মারি ফারার’। অল্পবয়সিনি একটি দরিদ্র গৃহ পরিচারিকা - কুমারী অবস্থাতেই অন্তঃসত্ত্বা হয় বড়োলোকের বখাটে ছেলেদের জুলুমে। পরিশ্রমের চাপে, প্রবল শীতের মরশুমে, সামাজিক বিপর্যয়ের প্রাবল্যে বাচ্চাটা জন্মের পরই মারা যায়। আর তারপর অসহায় সেই মেয়েটিও আর বাঁচে না। এই ঘটনাকে নিয়েই ব্রেখট কবিতাটি লিখেছিলেন তীব্র মর্মস্পর্শী ব্যঞ্জনায়ঃ
‘‘গত এপ্রিল মাসে মারি ফারার মেসিয়েনের জেলখানায় মারা গেছে। তার অপরাধ ছিল গুরুতর! আইবুড়ো অবস্থায় পোয়াতি হয়েছিল সে। আইন তো তাই বলেছিল। সেই গর্ভের হেতু অবশ্য ছিল ধবধবে পোশাকপরা বাবুমশাইরা। কিন্তু মারি ফারারের মৃত্যুটা দেখিয়ে গেল, তাদের সামনে ওরা কত অসহায়। তোমারা তো সন্তানসম্ভাবনাকে বল ‘আশীর্বাদ’! তাই না? কিন্তু এই মেয়েটা - তোমাদের ভাষায়, ‘পাপী’ - সে তো তার ওই ‘পাপের’ চেয়ে ঢের বেশি শাস্তি পেয়েই চলে গেল! তাই, বাবুরা! ব্যাগত্যা করি রাগঝাল দেখিও না ওর ওপর - কারণ ওদের তো দরকার সাহায্য আর সহানুভূতি।’’ বলতে পারি, ব্রেখটের হয়ত এটাই মহত্তম কবিতা। আপনারা কি একমত?