৬০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২১ এপ্রিল, ২০২৩ / ৭ বৈশাখ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (সাত)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
শ্রমণ ধর্মগুলির তাৎপর্য
● শ্রমণ ধর্মগুলি যথাক্রমে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ও তাদের দর্শন ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাব ও আচার ব্যবস্থার কবল থেকে উৎপাদনশীল চরিত্রগুলিকে মুক্ত করতে ভূমিকা পালন করেছিল। বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদ পশু হত্যার বিরোধী। পশু হত্যার বিরুদ্ধাচারণ কৃষি ও পরিবহণের বিকাশ ঘটায়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের এই প্রচেষ্টায় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য শ্রেণির মানুষ উন্নত উৎপাদনের ক্ষেত্রে উপকৃত হয়। এর পরিণতিতে এই ধর্মগুলি রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য লাভ করে। তবে আর যাই হোক, এই শ্রমণ ধর্মগুলি সংঘ ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল তা জনগণকে মুক্ত করতে পারেনি।
আস্তিক দর্শন
● এবার আমরা আস্তিক দর্শনের আলোচনায় প্রবেশ করব। পূর্বেই ভারতীয় দর্শনে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মাপকাঠি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আস্তিক দর্শন হলো যথাক্রমে সাংখ্য, মীমাংসা, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক ও বেদান্ত। এই হলো ভারতীয় দর্শনে প্রধান আস্তিক দর্শন।
(ক) সাংখ্য দর্শন - সাংখ্য দর্শন ভারতীয় সমাজে অতীতে এক প্রভাবশালী দর্শন ছিল। এর উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাথমিক বৌদ্ধ সাহিত্যে। আবার উপনিষদে (বিশেষ করে ছান্দোগ্যপনিষদ, পঠোপনিষদ, শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ) এবং শঙ্কর (শঙ্করাচার্য)-এর লেখায়ও সাংখ্য দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতায় একটি সম্পুর্ণ অধ্যায় রয়েছে যার নাম সাংখ্যযোগ। এর উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি। কপিল ঋষিকে সাংখ্য দর্শনের স্রষ্টা মনে করা হয়। সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনে দ্বৈতবাদী দর্শনের একটি ধারা, যেখানে বাস্তবতাকে দুইটি উপাদানের সৃষ্টি বলে ব্যাখ্যা করা হয়। পুরুষ ও প্রকৃতি এই দুইটি উপাদান।
● একাদশ শতাব্দীর ঈশ্বরকৃষ্ণ রচিত সাংখ্যকারিকা ও চতুর্দশ শতাব্দীতে সাংখ্য সূত্রগুলি সাংখ্য দর্শনের একমাত্র সংকলন। ঈশ্বরকৃষ্ণ নিজে একজন ভাববাদী হিসাবে নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি জনপ্রিয় করার প্রয়াস করেছেন। প্রাচীন দার্শনিক ভাবনায় এমন অজস্র নজির রয়েছে। কপিল ঋষি ও ঈশ্বরকৃষ্ণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১৮ বা ১৯ শতাব্দীরও বেশি। কপিল ঋষির ভাবনা বিকৃত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থেকে যায়। আমাদের ভারতের প্রাচীন দার্শনিকদের অনেককেই কোনো না কোনওভাবে সাংখ্য দর্শনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। সাংখ্য দর্শনে মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করতে বস্তুবাদী ধারণার যথেষ্ট প্রাধান্য রয়েছে। ঈশ্বরবাদীদের বক্তব্য হলো - ব্রহ্মা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণে সমস্ত কিছু পরিচালিত হচ্ছে। সাংখ্য দর্শন এই বক্তব্য স্বীকার করে না। দৃঢ়ভাবে এই বক্তব্য তারা অস্বীকার করে। সাংখ্য দর্শনে সমস্ত কিছুর মধ্যে তার বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ‘স্বভাব’-এর কথা বলে। ঈশ্বরবাদের বিরুদ্ধে স্বভাববাদের কথা বলে। স্বভাব সর্বদাই প্রকৃতি নির্ধারিত। সাংখ্য দর্শনে দুইটি ধারা। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক গুণরত্নর বক্তব্য অনুসারে দুইটি ধারা হলো, যথাক্রমে (১) মৌলিক ও (২) উত্তরা। মৌলিক ধারা হলো সাংখ্য দর্শনের প্রাচীনতম ধারা। সাংখ্য দর্শনের উৎস সম্পর্কে গুরুতর মতভেদ রয়েছে। অনেকে একে বেদ-পূর্ব ও অনার্য যুগের বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তার সংকলন বলে বিবেচনা করেন।
● সাংখ্য দর্শন কার্য-কারণ-এর তত্ত্বকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। শূন্য থেকে কোনো কার্য সম্ভব নয়। প্রকৃতিকে সমস্ত কিছুর কারণ বলে গণ্য করা হয়। সাংখ্য দর্শন প্রকৃতি-পরিণামবাদ বলেও ব্যাখ্যাত হয়। কার্যকে পরিণাম বলে চিহ্নিত করা হয়।
● সাংখ্য দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো - (চরকের বক্তব্য অনুসারে)
১. পুরুষ হলো অব্যক্তর একটা রূপ;
২. অব্যক্তর মিশ্রণের সাথে এর উৎপন্নর সংমিশ্রণই তথাকথিত জৈব পদার্থের সৃষ্টি করে;
৩. রজস ও তমস হলো মনের খারাপ অবস্থা এবং সত্তা হলো মনের ভালো অবস্থা;
৪. তন্মাশ্র উল্লিখিত হয় না;
৫. মুক্তির চূড়ান্ত অবস্থা হয় চরম ধ্বংসসাধন অথবা চরিত্রের অনুপস্থিতি এমন এক চরম অস্তিত্ব এবং এটাকে ব্রাহ্মণ অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থায় চেতনার কোনো অস্তিত্ব নেই কারণ চেতনা ব্যক্তির সাথে তার বিবর্তন, বুদ্ধি, অহংকার প্রভৃতির সমষ্টির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে।
৬. বস্তুকে কেন্দ্র করেই অনুভূতি গড়ে ওঠে।
● সাংখ্য দর্শনে জ্ঞান অর্থাৎ প্রমাণের মাধ্যম রূপে যে তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয় সেগুলি হলো যথাক্রমে, (ক) প্রত্যক্ষ, (খ) অনুমান ও (গ) শব্দ বা আপ্তবাক্য। ‘দুঃখ’ ধারণায় যেভাবে বৌদ্ধ দর্শনে জোর দেওয়া হয়েছে, ঠিক সেভাবেই সাংখ্য দর্শনেও জোর দেওয়া হয়েছে। এই কারণে অনেকে সাংখ্য ও বৌদ্ধ দর্শন সমসাময়িক সময়ের বলে মনে করেন। বেশ কিছু প্রাচীন নথি আবিষ্কৃত হওয়ায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্বের অনুমানের তুলনায় অনেক বেশি পণ্ডিত মানুষের অবদানেই সাংখ্য দর্শন গড়ে উঠেছিল। সাংখ্য মতবাদে ‘নিখুঁত সত্তা’ (Perfected Beings)-র ধারণায় বিশ্বাস করলেও ঈশ্বর ধারণাকে খারিজ করে। সাংখ্য দর্শন স্বভাববাদ-এর কথা বলে, যা ঈশ্বরবাদের বিরুদ্ধে। স্বভাববাদের প্রধান বক্তব্যগুলি হলো - প্রকৃতি চিরন্তন। প্রকৃতির স্বভাবই হলো তার নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে। সেই স্বভাবই মহাবিশ্বের বর্তমান রূপ সম্ভব করেছে। মহাবিশ্বের বর্তমান রূপের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। ঘাস খাওয়া, জল পান করা, দুধ দেওয়া এগুলি তো গোরুর স্বভাব। গোরুর সেই দুধ পান করা বাছুরের স্বভাব। উঁচু থেকে নিচের দিকে জলের প্রবাহিত হওয়া, এটা তো স্বাভাবিক। জলের নিজস্ব কোনো চেতনা নেই। কিন্তু জীবনের জন্য জল অপরিহার্য। তৃষ্ণা মেটানো, চাহিদা মেটানো হলো জলের অন্তর্নিহিত গুণ। এটাই সাংখ্য দর্শনে স্বভাব। এসব কিছুর জন্য অস্তিত্বহীন ঈশ্বরকে কৃতিত্ব দেওয়া যায় না। আগুনের স্বভাব হলো তাপ ও আলো (তাপ ও আলো আগুনের মধ্যে নিহিত)। তাপ ও আলোকে আগুন থেকে পৃথক করা যায় না। বট গাছের বিশালত্ব তার স্বভাব। বিশেষ জাতের ঘাসের প্রান্তভাগ ধারাল, এই তীক্ষ্ণতাই এর স্বভাব। কোনো গাছের পাতা অতিকায়, এটাই এর স্বভাব। স্বভাবকে বৈশিষ্ট্য হিসাবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রকৃতঅর্থে স্বভাব হলো তাই যা নির্দিষ্ট বস্তুর থেকে আলাদা করা যায় না। বস্তুর স্বভাব বস্তুর মধ্যেই লীন থাকে। ঈশ্বরবাদকে অস্বীকার করতে গিয়ে সাংখ্য দর্শন বলে -
(ক) ঈশ্বরবাদীরা ঈশ্বরকে নির্গুণ বলে। অথচ এই বিশ্ব নানা গুণে ভরপুর। নির্গুণ থেকে গুণ সংবলিত বিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হতে পারে। সুতোর গুণই তো কাপড়ের গুণ নির্ধারণ করে। তাই তো সাদা সুতোয় কাপড় বুনলে সাদা কাপড় হবে, কালো সুতোয় কাপড় বুনলে কালো কাপড় হবে। বিশ্বে সমস্ত উপাদানই সংশ্লিষ্ট উৎস থেকেই গুণ অর্জন করে। বিশ্ব যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তাহলে জগতের সমস্ত গুণ ঈশ্বরের থেকে পাওয়া। তাই যদি হয়, তাহলে তো ঈশ্বর নির্গুণ এই বক্তব্য ভুল। এই জগৎ তো বস্তু দিয়ে তৈরি। নানা বস্তুর তো নানাবিধ গুণ রয়েছে। তাহলে তো বস্তু জগতের স্রষ্টা ঈশ্বর (ঈশ্বরবাদীদের বক্তব্য) কী করে নির্গুণ হয়। কারণ তার সাধারণ প্রভাবের মধ্যে তো একটি সাধারণ চরিত্র থাকবে? সাধারণ চরিত্রের অভাবে মূল বক্তব্য ঈশ্বর নির্গুণ - এটা ভ্রান্ত ও স্ববিরোধী।
(খ) ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা হলে তিনিই তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। এটা কি তিনি সুখ বা আনন্দের জন্য করলেন। কোনো পরিণতি না ভেবেই নিজের আনন্দের জন্য তৈরি করলেন। এতো স্বার্থপরতা। নির্গুণের মধ্যে স্বার্থপরতা আসবে কোথা থেকে?
হতে পারে ঈশ্বর সম্ভবত সহানুভূতি ও ভালোবাসা থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সহানুভূতি তো জীবন্ত প্রাণীদের দেখানো যায়, জড় বস্তুর ওপর তো দেখানো যায় না। জীবন সৃষ্টির পরেই তো সহানুভূতি দেখানো সম্ভব। জীবন সৃষ্টির আগেই কী করে ঈশ্বর জীবন্ত প্রাণীদের সহানুভূতি দেখাতে পারেন? তাহলে প্রশ্ন, কোনটা আগে? জীবন, প্রাণী না সহানুভূতি?
(গ) ঈশ্বর সহানুভূতি থেকেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, এটা মেনে নিয়ে যে প্রশ্ন জাগে, এটা কি জীবন্ত প্রাণীদের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য? অথচ জীবেদের কষ্ট পাওয়ার কারণ কী? কারণ তাদের শরীর রয়েছে। শরীর থাকলে যন্ত্রণা-কষ্ট থাকবে। শরীর অর্থাৎ দেহ না থাকলে তো এই যন্ত্রণা থাকত না। ঈশ্বর যদি সত্যি চাইতেন যে, কোনো কষ্ট-যন্ত্রণা থাকবে না, তাহলে কেন তিনি দেহ সৃষ্টি করলেন? যন্ত্রণার আধার এই দেহ যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই ঈশ্বরই সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ। ঈশ্বরবাদীরা কি সাংখ্য দার্শনিকদের এই বক্তব্য মানবেন?
(ঘ) সৃষ্টির পরেই দুঃখ-যন্ত্রণা দেখা দেয়। অতঃপর ঈশ্বর সহানুভূতিশীল হয়ে দুঃখ-কষ্ট দূর করেন। এটা সত্য হলে, আগে সৃষ্টি, পরে সহানুভূতি। তাহলে ঈশ্বর সহানুভূতিশীল হয়ে ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন - এটা সঠিক নয়।
● সাংখ্য দর্শনের বিশেষত্ব হলো, তা কারণ ও কার্য অর্থাৎ ফলাফলের যুক্তিকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে। এইভাবে সাংখ্য দর্শন ভাববাদকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
● মহাভারতে সাংখ্য দর্শনের তিনটি ধারার কথা বলা হয়েছে। সাংখ্য দর্শনে তিন ধরনের বিভাগ (categories), যথাক্রমে ২৪, ২৫ ও ২৬টি বিভাগ অনুসারে তিনটি ধারা।
সাংখ্য দর্শনের সীমাবদ্ধতা
● সাংখ্য দর্শন ঈশ্বরবাদ তথা ভাববাদী দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের প্রকৃত দ্বন্দ্বগুলিকে চিহ্নিত করতে পারেনি। ফলে পুরোহিততন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি। লোকায়ত দর্শনের থেকে এক্ষেত্রে সাংখ্য দর্শন পিছিয়ে ছিল। এই কারণেই শাসকশ্রেণি সাংখ্য দর্শনকে আক্রমণ বা নিশ্চিহ্ন করার পরিবর্তে একে গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয়। শাসকশ্রেণি নিজের ভাষায় সাংখ্য দর্শনকে ব্যাখ্যা করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। সাংখ্য দর্শনের বস্তুবাদী অংশকে বাদ দিয়ে কপিল মুনিকে বিষ্ণুর অবতার বলে ঘোষণা করেছে।
(ক্রমশ)