৫৮ বর্ষ ২য় সংখ্যা / ২১ আগস্ট ২০২০ / ৪ ভাদ্র ১৪২৭
রাজনীতি-মতাদর্শ-সংগঠন-সংগ্রাম একসূত্রে গেঁথে এগিয়ে যেতে হবে
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর স্মরণসভায় নেতৃবৃন্দ
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর অনুকরণযোগ্য আদর্শগত গুণাবলী ও শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার অবদান থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে। ১৮ আগস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রয়াত কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর স্মরণ সভায় এই আহ্বান জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। এদিন পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির দপ্তর প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আয়োজিত এই স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু। বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিআই’র রাজ্য পরিষদের সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন-এর নেতা বাসুদেব বসু, এসইউসিআই (সি) নেতা অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেতা অসিত মিত্র এবং প্রয়াত কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর কন্যা উষসী চক্রবর্তী।
এদিনের এই স্মরণ অনুষ্ঠানে সিপিআই(এম)’র রাজ্য দপ্তরের কর্মী প্রয়াত কমরেড দিলীপ গিরির প্রয়াণেও শোকজ্ঞাপন ও শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্রসঙ্গত, গত ৬ আগস্ট কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর জীবনাবসান হয়। কমরেড দিলীপ গিরি প্রয়াত হন ১৬ আগস্ট।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর স্মরণসভায় বক্তব্য রাখছেন বিমান বসু। মঞ্চে সূর্য মিশ্র-সহ নেতৃবৃন্দ।
স্মরণসভার সূচনায় প্রয়াত দুই কমরেডের স্মরণে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন বিমান বসু।
বিমান বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেন, কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীকে কোনো দায়িত্ব দিলে তা ছাত্র সংগঠনই হোক বা পার্টির, তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করেছেন। ১৯৬০-৬১ সালে মালদা কলেজে আয়োজিত এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তাঁর সঙ্গে পরিচয়। সেখানে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ও কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী দমদম মতিঝিল কলেজ থেকে অংশ নিয়েছিল, আমি ছিলাম মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়, অবশ্য সুভাষের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। তিনি বলেন, কমরেড শ্যামলকে পরিবহণ, বিদ্যুৎ, ডক প্রভৃতি ক্ষেত্রে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন কমিউনিস্ট হিসেবে বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিমান বসু বলেন, এখন যে অবস্থা চলছে, সেই সময়ে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, শ্রমআইনকে সংশোধন করে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন নামিয়ে আনা হচ্ছে। সেই সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের একজন পরীক্ষিত নেতা হিসেবে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর খুবই প্রয়োজন ছিল।
সূর্যকান্ত মিশ্র তাঁর বক্তব্যের সূচনায় প্রয়াত কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী এবং কমরেড দিলীপ গিরির স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, পার্টির রাজ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত কমরেড দিলীপ গিরি কেবল গাড়ি চালাতেন না, পার্টির রাজ্য দপ্তরে অতিথিরা এলে তাঁদের আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করেছেন, যখন যে কাজ দেওয়া হয়েছে তা গুরুত্বের সাথে পালন করেছেন।
কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, আমাদের ভবিষ্যতের দিশা হিসেবে মনে রাখতে হবে উনি মতাদর্শ ও রাজনীতি বিষয়ে যা লিখে গেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। কেন্দ্রে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে যখন রাম মন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে রথযাত্রা শুরু হয় তখন সেই বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরতে গভীর ভাবে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পেরেছি, হিন্দু শব্দটা রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ কোথাও ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে যখন জনগণনা হয় তখন হিন্দু-মুসলমান এইসব বিভাজন করা হয়। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী খুঁজে বার করেন বিজয়নগর-বাহমণি রাজ্যে প্রথম এই শব্দের ব্যবহার হয়েছিল। তবে তা সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে ব্যবহার করা হয়নি। এসব বিষয় সহজ করে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু এখন যা নির্মাণ হচ্ছে সব মিথ্যা।
তিনি বলেন, মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরকে তিন ভাগ করা হয়। এর মধ্যদিয়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ওপর আক্রমণ করা হলো। এসব নিয়ে শ্যামলদা আগেই লিখে গেছেন। মতাদর্শ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর যে সমস্ত লেখা আছে তা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মতাদর্শ ও রাজনীতির কোনো মানেই হয় না, যদি না তা প্রয়োগ করা যায়। পৃথিবীটাকে দার্শনিকরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো তার পরিবর্তন করা। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের ঐক্য কী করে করতে হবে এ নিয়ে তিনি দীর্ঘ চর্চা করেছেন। কারণ, এরাই হচ্ছে জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ। এ নিয়ে তিনি নিয়মিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলতেন কৃষক-শ্রমিকদের যুক্ত কর্মসূচি হওয়া দরকার। কতগুলো ব্যাপারে বোঝাপড়া হওয়া দরকার। কেবল কৃষির ওপর নির্ভর করে আজ জীবনধারণ করা সহজ হচ্ছে না। তাই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। তাই কৃষকদের সংগ্রামের সাথে শ্রমিকদের সংগ্রামকে যুক্ত করার কথা বলেছেন তিনি। এ নিয়ে শুধু মতাদর্শগত চর্চাই নয়, তা প্রয়োগের রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। সেই পথ আমাদের অনুসরণ করতে হবে।
সূর্য মিশ্র আরও বলেন, কেবল শ্রমিক-কৃষকের যুক্ত আন্দোলনই নয়, তার সাথে কর্মচারী, ছাত্র, যুব, মহিলা এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠন - যেমন আদিবাসী-দলিত, যারা শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে তাদের সবাইকে একত্রিত করে ব্যাপক সংগ্রামের মঞ্চ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী। আগে এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মঞ্চ ছিল এনপিএমও। সেই ধাঁচেই তিনি বাংলায় গড়ে তোলেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মঞ্চ বিপিএমও।
বর্তমানে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার যেভাবে বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, ইতিহাসকে বিকৃতি ঘটাচ্ছে, গুলিয়ে দিতে চাইছে, সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে যা দেখা গেল তাতে লক্ষ করা যাচ্ছে ওরা ইতিহাসের কিছুই মানছে না। ৫ আগস্ট রামমন্দিরের শিলান্যাসকে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের সাথে এক করে দেখা হচ্ছে। ওরা বলছে ‘নতুন ভারত’ হবে - তা কেমন হবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। বর্তমানে যা হচ্ছে তা আসলে মিথ্যার নির্মাণ হচ্ছে। প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া সবগুলোকে দখল করে ব্যবহার করা হচ্ছে - মিথ্যা প্রচার হচ্ছে। ওদের লক্ষ্য হলো যুক্তিবাদকে ধ্বংস করো।
তিনি বলেন, বর্তমান অতিমারীজনিত পরিস্থিতিতে ওরা চাইছে মানুষকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিতে, নয়তো জেলে। আমরা কী তা মেনে নেব? পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমাদের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামতেই হবে। লড়াই-সংগ্রাম করব তাতে তো ঝুঁকি থাকবেই। এই পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতি-মতাদর্শ-সংগঠন ও সংগ্রাম এই চারটি দিক একসূত্রে গ্রথিত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী আজীবন তাই করে গেছেন।
স্মরণসভায় স্বপন ব্যানার্জি বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও দেশ ও রাজ্যের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে না পারার সুযোগকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রের সরকার অমানবিক, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অসভ্যভাবে গরিব-শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। একদিকে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট, বেকারি কর্মহীন মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি, অন্যদিকে মৃত্যুর হাতছানি। সেই সময়ে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর মতো নেতার মৃত্যু কেবল কমিউনিস্ট আন্দোলন নয়, বামপন্থী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি।
মনোজ ভট্টাচার্য কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ও কমরেড দিলীপ গিরির স্মৃতিচারণা করে বলেন, করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সংবিধান শুধু নয়, মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। মানুষের হক কথা বলবার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ইউএপি’এর মতো দানবীয় আইনে সমাজকর্মী, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, কবি সবাইকে বিনাবিচারে আটকে রাখা হচ্ছে, গণতন্ত্রের যাবতীয় শর্তকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করা যাবে - তার পথ বার করতে হবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শবোধ ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকা কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর মতো মানুষের আরও কিছুদিন থাকা প্রয়োজন ছিল।
নরেন চ্যাটার্জি বলেন, কমরেড শ্যামল চক্রবর্তীর মতো মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলেই রাজনীতি আজ কলুষিত হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষেরা আজ গভীর সঙ্কটে। শ্যামলদা বিপিএমও-র লঙ-মার্চের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসহ জল, জমি বিক্রির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
এদিনের স্মরণ সভায় প্রয়াত নেতার কন্যা উষসী চক্রবর্তী বলেন, বাবা যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ করতেন, তা হলো তিনি ছিলেন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী। সেই হিসেবে তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, যে জীবনচর্চা তিনি লালন করেছেন, সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, তা থেকে বর্তমান প্রজন্মের কর্মীরা শিক্ষাগ্রহণ করলেই তাঁর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
এদিনের স্মরণসভায় আরসিপিআই-র মিহির বাইন, এমএফবি-র জয়হিন্দ সিং, পিডিএস-র সমীর পূততুণ্ড, কংগ্রেস দলের শুভঙ্কর সরকার, সুখবিলাস বর্মন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।