৫৮ বর্ষ ২য় সংখ্যা / ২১ আগস্ট ২০২০ / ৪ ভাদ্র ১৪২৭
টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা
গৌতম রায়
বিগত লোকসভা নির্বাচনের (২০১৯) আগে-পরে, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল উঠে এসেছিল সংবাদ শিরোনামে। রাজনৈতিক চাপান-উতোরের ভিতর সেসব আলোচনায় একটিবারের জন্যও কিন্তু উঠে আসেনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম পর্বের ক্রান্তিলগ্নে, সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলন এখানে যেভাবে দানা বেঁধেছিল - তার কথা।
সেই আন্দোলনকে শুরুতেই বিনাশ করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভয়ঙ্কর পরিকল্পনায় ১৯৩৫ সালে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’ হয়েছিল, সে সম্পর্কে বস্তুত আজকের প্রজন্ম কিছু জানে না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম পর্বে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা ঘিরে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সেই কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে সঠিক আলোচনার প্রায় হয়নি বলা যেতে পারে।
বস্তুত এই ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল ব্রিটিশের পাঁজর কাঁপিয়ে দেওয়া একটি ঘটনা। সশস্ত্র বিপ্লবীদের সমসাময়িক বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের নানা ষড়যন্ত্রের ষড়যন্ত্রমূলক মামলার একটি পরিপূরক মামলা, আইনের ভাষায় যাকে সাপ্লিমেন্টারি মোকদ্দমা বলা হয়, এটি ছিল তাইই।
টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলার বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ব্রিটিশকে উৎখাত করবার লক্ষ্য নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবীরা গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে কতখানি সক্রিয় ছিল। এই সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল নেতৃত্বে ছিলেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা।
এই মামলায় অসংখ্য মানুষকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। কার্যত গোটা দেশব্যাপী তল্লাশির পর প্রায় ৫০০ জন বিপ্লবীকে ব্রিটিশ পুলিশ বিনা বিচারে আটক রেখেছিল। ৪০ জন বিপ্লবীকে বিচারের নামে প্রহসনের উদ্দেশ্যে বঙ্গপ্রদেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে চালান করেছিল।
বস্তুত স্বদেশি চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ, সশস্ত্র উপায়ে ব্রিটিশকে এই দেশ থেকে বিতাড়নের উদ্দেশ্য নিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া বিপ্লবীরা, ব্রিটিশকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে যে কয়েকটি স্বদেশি ডাকাতি করেন, তার সূত্র ধরেই এই ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’ ব্রিটিশ প্রশাসন সাজিয়েছিল।
১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে একটি আন্তঃপ্রাদেশিক মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানি শুরু হওয়ার ঠিক আড়াই মাসের মাথায় অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার হিলি রেল স্টেশনে এক দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়। এই ডাকাতিকে কেন্দ্র করে কয়েকজন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবককে ব্রিটিশ পুলিশ ধরে। ব্রিটিশের তদন্তের নামে প্রহসন থেকে এটা বোঝা যায় যে, যাঁদেরকে পুলিশ ধরেছিল, সেইসব যুবকেরা প্রায় সকলেই অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন।
এই যুবকদের বিচার হয়েছিল রাজশাহী জেলায় সেইসময়ের জেলা ও দায়রা জজ ইজে সিমসনের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের প্রধান সিমসন ছিলেন সেই সময়কালের কারা বিভাগের অধ্যক্ষ, যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিনয় বাদল দীনেশ রাইটার্স আক্রমণ করেছিলেন, সেই কুখ্যাত সিমসন সাহেবের ভাই।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বিপিন মুখার্জি এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এমদাদ আলী। এই মামলায় বিচারকরা প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী, সত্যব্রত চক্রবর্তী, ঋষিকেশ ভট্টাচার্য এবং সরোজ বসু - এই চারজনের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। প্রফুল্লনারায়ণ সান্যাল, কিরণচন্দ্র দে এবং ডাক্তার আব্দুল কাদের চৌধুরীর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দিয়েছিলেন। হরিপদ বসু, কালিপদ সরকার এবং রামকৃষ্ণ সরকারকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। এই মামলাটির একটি সাপ্লিমেন্টারি মামলাতে বিজয় ব্যানার্জি ওরফে বিজয় চক্রবর্তীকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
হাইকোর্টে মামলাটি নিয়ে আপিল হয়। সেই আপিলে প্রাণদন্ডে দন্ডিত চারজনকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। প্রফুল্ল সান্যাল এবং হরিপদের কারাদণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দশ এবং সাত বছরে নামানো হয়। কাদের চৌধুরী, রামকৃষ্ণ সরকার এবং কিরণ দে’র সাজাও কমিয়ে পাঁচ বছরে নামানো হয়। কালিপদ সরকারকে হাইকোর্ট মুক্তি দিলেও মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং বিনা বিচার আটক করে।
এই হিলির স্বদেশি ডাকাতির ঘটনা ব্রিটিশ প্রশাসনকে কতখানি উলঙ্গ করে দিয়েছিল, তা বুঝতে পারা যায় হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার বিলেতের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করবার সিদ্ধান্তের ভিতর দিয়ে তথাকথিত আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির হাইকোর্টের দেওয়া সিদ্ধান্ত যাতে প্রিভি কাউন্সিল পুনর্বিবেচনা করে, এই মর্মে ব্রিটিশ সরকারের করা আবেদন প্রিভি কাউন্সিল সরাসরি অগ্রাহ্য করেছিলেন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপর ব্রিটিশ পুলিশ, প্রশাসন যে কতখানি নির্দয় ছিল, তার উদাহরণ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক বন্দি ধনেশ ভট্টাচার্যের প্রতি ব্রিটিশের ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। সেই সময় কুষ্ঠরোগকে ঘিরে নানা ধরনের সামাজিক কুসংস্কার ছিল। অত্যন্ত কৌশলে ব্রিটিশ রটিয়ে দেয় বন্দীদের ভিতরে; ধনেশ চক্রবর্তী কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত।
এই ‘অভিযোগে’ বাঁকুড়ার সরকারি কুষ্ঠ চিকিৎসালয়ে মারাত্মক রকমের কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগীদের ভিতরে আদৌ কুষ্ঠ না হওয়া সশস্ত্র বিপ্লবী ধনেশ চক্রবর্তীরকে রাখা হয়েছিল। অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা অত্যন্ত কৌশল অবলম্বন করে ধনেশ চক্রবর্তীকে বাঁকুড়া সরকারি কুষ্ঠ চিকিৎসালয় থেকে বের করে এনে গোপন আশ্রয়ে রেখে দেন।
১৯৩৪ সালের ৮ মার্চ বরিশাল শহরে অনুশীলন সমিতির সদস্য শান্তি মিত্রের বাড়িতে পুলিশ হঠাৎ তল্লাশি চালিয়ে একটি কাগজ বাজেয়াপ্ত করে। বাজেয়াপ্ত করা কাগজটি ছিল অনুশীলন সমিতির নেতা প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের (ইনি কিন্তু পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া প্রফুল্ল চন্দ্র সেন নন) লেখা একটি চিঠি।
১৯৩০ সাল থেকে প্রফুল্ল সেন আত্মগোপন করে অনুশীলন সমিতির পক্ষ থেকে নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেই সময়ের আইন অনুযায়ী প্রফুল্ল সেনকে পলাতক ঘোষণা করা হয়েছিল এবং পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়েছিল।
পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রফুল্ল সেন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আত্মগোপন করে অত্যন্ত গোপনে অনুশীলন সমিতিকে সংগঠিত করে নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
১৯৩৪ সালের ১২ নভেম্বর ব্রিটিশ পুলিশ অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার ডিঙ্গামানিক নামক একটি গ্রাম থেকে জীবনকৃষ্ণ ধুপি নামক এক বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে। ডিঙ্গামানিক গ্রামে জীবনকৃষ্ণ ‘বালক সঙ্ঘ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অত্যন্ত গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করছিলেন।
জীবনকৃষ্ণের কাছে ‘লক্ষ্য-আদর্শ’ নামক একটি বই ব্রিটিশ পুলিশ পায়। সেই বইটিকে সশস্ত্র বিপ্লবী চিন্তাভাবনার একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে মামলায় ব্রিটিশ সংযুক্ত করেছিল। তার কিছুদিন পর, অবিভক্ত রাজশাহী জেলার পুঠিয়াতে দেবেন্দ্র করগুপ্ত নামক আর এক বিপ্লবীর বাড়িতে ‘বিপ্লব-শিক্ষা’ নামক ওই বইটি পুলিশ পায়।
এই দুই ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক খতিয়ে দেখে ব্রিটিশ পুলিশ পুঠিয়া রাজবাড়িতে তল্লাশি চালায়। তল্লাশিতে প্রায় তিন হাজার কপি ওই বইটি পুলিশ উদ্ধার করে। ১৯৩৪ সালের একেবারে শেষ লগ্নে ১৯ ডিসেম্বর বেলঘরিয়ার একটি বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়।
সেই বাড়িতে তখন বাস করতেন সিলেটের প্রীতিরঞ্জন দাশ পুরকায়স্থ। সেই বাড়িটি তখন ছিল অনুশীলন সমিতির একটি অত্যন্ত গোপন কেন্দ্র। প্রীতিরঞ্জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্রীতিরঞ্জন, দেবপ্রসাদ সেন ও শান্তিরঞ্জন সেন নামক তিনজন বিপ্লবী তখন সেই বাড়িতে ছিলেন। দেবপ্রসাদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারলেও শান্তিরঞ্জনকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
বিপ্লবী প্রফুল্ল সেনকে এই সময়ে পুলিশ বেলঘরিয়ার বেঙ্গল কেমিক্যাল নেট কর্মচারীদের একটি মেস থেকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৩৫ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রফুল্ল বাবু সংশ্লিষ্ট মেস থেকে বেরিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনেরই কোনো কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যে টিটাগড় শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রফুল্লবাবু ছিলেন ছোটোখাটো চেহারার মানুষ, কিন্তু নিয়মিত শরীরচর্চার ফলে তাঁর শারীরিক গঠন অত্যন্ত মজবুত ছিল। এই সময়কালে ব্রিটিশ পুলিশকে সাহায্য করবার জন্য দেশের মানুষের একটি ছোটো অংশ বিভিন্ন জায়গায় ‘গ্রাম রক্ষীবাহিনী’ তৈরি করেছিল। টিটাগড়ে গ্রাম রক্ষীবাহিনীর প্রধান ছিলেন সুরেন ঘোষ নামক এক ব্যক্তি। তিনি প্রফুল্লবাবুকে টিটাগড়ের ভিতর দিয়ে যেতে দেখে, জোরে হুইসেল বাজিয়ে গ্রামের লোককে জড়ো করে, প্রফুল্লবাবুকে ঘিরে ধরেন।
প্রফুল্লবাবু খালি হাতে জোরদার লড়াই চালান একা। কার্যত নিরস্ত্র অবস্থায় এইভাবে লড়াই চালিয়ে বেশিক্ষণ যুঝতে পারেননি প্রফুল্লবাবু। গ্রাম রক্ষীবাহিনীর আড়ালে থাকা একদল দেশিয় লোকেদেরই কৃতঘ্নতায় তাঁকে শেষ পর্যন্ত টিটাগড় থানা নিয়ে যাওয়া হয়। টিটাগড় থানার পুলিশ সেই মুহূর্তে প্রফুল্লবাবুর বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানতেন না।
তবু ব্রিটিশ পুলিশের নিয়ম ছিল এই যে, কোনো অপরিচিত মানুষ ধরা পরলে, তাকে ঘিরে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে, তবে সেই মুহুর্তেই বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশের দৃষ্টিগোচর করতে হবে। টিটাগড় থানার পুলিশ বিষয়টি আইবি দপ্তরে জানায়। পলাতক অবস্থায় প্রফুল্লবাবুর ছবি পুলিশের বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল - সে কথা এই নিবন্ধের আগেই বলা হয়েছে। সেই ফটোগ্রাফের সঙ্গে মিলিয়ে পুলিশ প্রফুল্লবাবুকে পলাতক বিপ্লবী প্রফুল্ল সেন বলে শনাক্ত করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
১৯৩৫ সালের ২০ জানুয়ারি টিটাগড়ের এক শ্রমিক অধ্যুষিত বস্তির ভিতর যে ঘটনা ঘটেছিল তা হয়তো আজকের প্রজন্মের প্রায় কারোরই জানা নেই।
১৯৩৪ সালের ৩১ জুলাই বিপ্লবী পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত তিনজন সহযোদ্ধা বন্দিকে নিয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের উঁচু পাঁচিল দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। জেল থেকে পালিয়ে তাঁরা টিটাগড়ের এক শ্রমিক অধ্যুষিত বস্তির ভিতরে ঘর ভাড়া নিয়ে থেকে, সেখানে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করতেন। পূর্ণানন্দবাবুর সাথে শ্যামবিনোদ পাল চৌধুরী নামক আরও এক বিপ্লবী সেখানে থাকতেন।
পুলিশ যাতে কোনো অবস্থাতেই এই বিপ্লবী কর্মকান্ড বুঝতে না পারে, সেই জন্য আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অনুশীলন সমিতির বিশিষ্ট নেতা অমূল্য মুখার্জির বোন পারুল মুখার্জী ওই বস্তির ভিতরেই পূর্ণানন্দবাবুদের সাথে থাকতেন। কুমিল্লার অধিবাসী পারুল মুখার্জি ছিলেন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত চেহারার এক বিদূষী রমণী।
পূর্ণানন্দ বস্তি থেকে বাইরে গিয়ে যখন কাজকর্ম চালাতেন, তখন মুসলমানের ছদ্মবেশে যাতায়াত করতেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লোকেদের একাংশের ধারণা হয় যে, সম্ভবত কোনো মুসলমান, হিন্দু রমণীকে অপহরণ করে ওই বস্তির ভেতরে রেখেছে।
স্থানীয় লোকেরা টিটাগড় থানায় নিজেদের এই সন্দেহের কথা জানায়। থানা স্থানীয় মানুষদের সেই সন্দেহ গোয়েন্দা দপ্তরে জানায়। গোয়েন্দা দপ্তর থেকে গোপনে ওই বস্তুর উপরে নজরদারি চালানো হয়। নজরদারি চালিয়ে তারা এই সিদ্ধান্তে আসে যে, দুর্ধর্ষ বিপ্লবী পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত বস্তির ভিতরে ভাড়াটে হিসেবে আত্মগোপন করে রয়েছেন।
১৯৩৫ সালের ২০ জানুয়ারি কয়েকজন প্রথম সারির গোয়েন্দা অফিসারের নেতৃত্বে এক বিশাল পুলিশবাহিনী টিটাগড়ের সেই শ্রমিক অধ্যুষিত বস্তি, যেখানে পূর্ণানন্দ বাবু আত্মগোপন করে ছিলেন, সেটিকে ঘিরে ফেলে।
পুলিশের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে; বাড়ি ঘেরাও হওয়ামাত্রই পূর্ণানন্দবাবু এবং তাঁর সহযোদ্ধা শ্যামবিনোদ বস্তি বাড়ির ছাদে উঠে পড়েন। পুলিশের বিবরণ; শ্যামবিনোদ পালকে কোনো একটি জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিতে দেখা যায়। পুলিশ পাশের বাড়ির উঠোন থেকে একটি তাজা কার্তুজ ভরা পিস্তল উদ্ধার করে। এই অবস্থায় পারুল মুখার্জি একটি ঘরের ভিতরে ঢুকে, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে, যে ধরনের কাগজপত্র ঘিরে আপত্তি উঠতে পারত, সেই সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে দিতে শুরু করেন।
পুলিশের বিবরণ অনুযায়ী; নানা ধরনের অনুরোধ-উপরোধ, ভয় দেখানোর পর নাকি পারুল মুখার্জি শেষপর্যন্ত দরজা খুলে দিয়েছিলেন। পুলিশ ঘরে ঢুকে দেখে কাগজপত্র তখনো পুড়ছে। পুলিশ ঘরের ভিতর থেকে অর্ধদগ্ধ কিছু কাগজ উদ্ধার করে এবং জোরদার কিছু রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার করে।
পুলিশের মতে; খুব বড়ো ধরনের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া সৃষ্টি হতে পারে, এই ধরনের বোমা তৈরি করার উদ্দেশ্যে সেখানে রাসায়নিক পদার্থ মজুত করা হয়েছিল। পুলিশ বেশ কিছু ছদ্মবেশ নেওয়ার উপকরণ, কিছু বোমার নকশা, বোমা তৈরির ফর্মুলা, তৈরি হওয়া বোমা এবং নানা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য, তার পাশাপাশি বেশ কিছু বিপ্লবী আদর্শ প্রচারমূলক বই, কিছু ছেঁড়া কাগজ ও পোড়া কাগজ বাজেয়াপ্ত করে।
ওই ছেঁড়া ও পোড়া কাগজের টুকরো টুকরো অংশগুলিকে জুড়ে পরবর্তীকালে পুলিশ বেশ কিছু নাম-ঠিকানা সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছে বলে মামলায় দাবি করেছিল।
পুলিশ মামলাতে জানিয়েছিল যে; বোমাটি তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন কারাগার থেকে বিপ্লবীদের মুক্ত করে আনবার উদ্দেশেই। পুলিশের মতে; পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত কারাগারে যখন বন্দী ছিলেন, তখন প্রফুল্ল সেনের উপর এই সংগঠনের নেতৃত্ব অর্পিত হয়েছিল।
সীতানাথ দে ব্রহ্মচারী নামক আরেক সহযোদ্ধাকে নিয়ে জেল থেকে পালিয়ে পূর্ণানন্দ আবার অনুশীলন সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলে পুলিশ মামলায় দাবি করেছিল। এই ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’য় পুলিশ ৩১ জন আসামিকে বিচারের উদ্দেশ্যে চালান করেছিল।
তাঁরা হলেন পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, পারুল মুখার্জি, শ্যামবিনোদ পাল চৌধুরী, ধনেশ ভট্টাচার্য, দেবপ্রসাদ ব্যানার্জি, দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শান্তিরঞ্জন সেন, যজ্ঞেশ্বর দে, সন্তোষকুমার সেন, বিভূতি ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, বিজয়কৃষ্ণ পাল চৌধুরী, অজিতলাল মজুমদার, মাখন কর, নিরঞ্জন ঘোষাল, নীরদ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনকৃষ্ণ ধুপি, জগদীশ চক্রবর্তী, সীতানাথ দে ব্রহ্মচারী, কালীপদ ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্রনাথ বসু, ধীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি, প্রীতিরঞ্জন দাস পুরকায়স্থ, দেবব্রত রায়, হরেন্দ্রনাথ মুন্সি, জুড়ান গাঙ্গুলি, সুবিমল দত্ত, কার্তিক সেনাপতি, ধীরেন্দ্রনাথ ধর।
সীতানাথ দে ব্রহ্মচারীকে পুলিশ কোনো অবস্থাতেই ধরতে পারেনি। পলাতক অবস্থাতে তিনি মাদ্রাজে উতকামুন্ড ব্যাঙ্ক ডাকাতি সংগঠিত করেছিলেন।
এই টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের ভিতর ১৫ জন ছিলেন অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার মানুষ। পাঁচজন ছিলেন ঢাকা জেলার মানুষ। বরিশাল জেলার ছিলেন চারজন। সিলেট জেলার ছিলেন দু’জন। ত্রিপুরা, যশোহর, চট্টগ্রাম এবং হাওড়া জেলার ছিলেন একজন করে। ধীরেন্দ্রনাথ ধর ছিলেন কলকাতার মানুষ পরবর্তী জীবনে কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে এই ধীরেন্দ্রনাথ ধর প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
পূর্ণানন্দ দাশগুপ্তর বিপ্লবী পরিমণ্ডলে নাম ছিল ‘বড়দাদা’, প্রফুল্ল সেনের নাম ছিল ‘রাঙা দা’, পারুল মুখার্জি গ্রেপ্তারেরকালে নিজের নাম বলেছিলেন সুরমা দেবী। জুড়ান গাঙ্গুলির নাম ছিল ‘গুরুদেব’। ধনেশ ভট্টাচার্যের নাম ছিল ‘দীনভিখারি’।
১৯৩৫ সালের ১৬ নভেম্বর প্রবীণ আইসিএসএইচজিএস বিভাগের নেতৃত্বে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য ছিলেন কেসি দাশগুপ্ত এবং রায়বাহাদুর এনকে বসু। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন এই মামলার শুনানি চলছিল ব্যারাকপুর কোর্টে।
১৯৩৭ সালের ২৭ এপ্রিল বিচারকেরা মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন। পূর্ণানন্দবাবুকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত করা হয়েছিল। প্রফুল্লবাবুকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। শ্যামবিনোদ পালের জুটেছিল ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। দেবপ্রসাদ সেন, নিরঞ্জন ঘোষালের আরো ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পারুল মুখার্জি, প্রীতিরঞ্জন দাস পুরকায়স্থ, বিভূতি ভট্টাচার্য, কার্তিক সেনাপতি, হরেন্দ্র মুন্সি - প্রত্যেকে তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।
প্রমাণের অভাবে ১২ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ। তাঁরা হলেন ধনেশ ভট্টাচার্য, সীতানাথ দে ব্রহ্মচারী, অজিত মজুমদার, জীবন গাঙ্গুলী, রবি ঘোষ, দেবব্রত ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ ধর।
এই ‘‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’’র ভিতর দিয়ে একদিকে যেমন ব্রিটিশের ভয়াবহ অত্যাচারী ভূমিকার কথা আমরা জানতে পারি, তেমনি জানতে পারি, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বিপ্লবীরা এখানকার সাধারণ মানুষদের একটা বড় অংশকে কিভাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা-উপধারার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্র মামলা পরবর্তীতে গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনকে একটি সুসংগঠিত করেছিল। সেই আন্দোলনকে মেহনতি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলা’ খুব বড় রকমের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।
(তথ্য সূত্রঃ সংশ্লিষ্ট মামলার ফাইল, যেগুলি ব্যারাকপুর আদালতে সংরক্ষিত আছে।)