৫৮ বর্ষ ২য় সংখ্যা / ২১ আগস্ট ২০২০ / ৪ ভাদ্র ১৪২৭
নতুন শিক্ষানীতিঃ প্রাথমিক শিক্ষার সর্বনাশ করার চক্রান্ত
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়
আমরা স্বাধীনতার ৭৪তম বর্ষ যখন পালন করছি, সেই সময় যারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তেরঙ্গা ঝান্ডা তোলেননি, সেই আরএসএস-র হাতে দেশ চালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। এরা মনে করে দেশের অভ্যন্তরে তিনটি শক্তি বিপদ - এক, মুসলমান, দুই, খ্রিস্টান ও তিন, কমিউনিস্ট। এখন এদের আলোচনার বিষয় দেশের স্বাধীনতা নয়। এরা ব্যস্ত - দেশভাগ, হিন্দু বনাম সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘু, নাগরিকত্ব আইন এবং হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নির্মাণকল্পে।
স্বাভাবিকভাবেই সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শে লালিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রীসভা অনুমোদিত শিক্ষানীতিতে এর প্রতিফলন থাকবেই। প্রথমে এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র নীতিগত দিকটায় একটু আলোকপাত করা যাক। এই নতুন শিক্ষানীতিতে পাঠক্রম পাঠ্যসূচি নির্মাণে প্রাচীন চিরাচরিত ব্যবস্থার উপাদান যোগ করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, চাণক্য, চক্রপানিদত্ত, মাধব, পাণিনি, পতঞ্জলি, নাগার্জুনের কথা। আমরা বলছি না এদের ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান নেই, কিন্তু এরাই একমাত্র ভারত মানস গঠন করেছে? বৌদ্ধ, মোগল, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ কারোর অবদান নেই? এমনকি পাঠান সম্রাটরাও বাংলা শিখেছিলেন এই কারণে যে, তারা সংস্কৃত মহাকাব্য ও মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করবেন। মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ সম্রাট নাসিরা শাহের আদেশে শুরু হয়। (দীনেশচন্দ্র সেন - বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস) আওরঙ্গজেবের বড়ো ভাই দারাশিকো সংস্কৃত শিখেছিলেন এবং নিজে ফারসি ভাষায় উপনিষদের কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি কোরানের সঙ্গে উপনিষদের তুলনাও করেছিলেন।এমনকি আমরা জেনেছি ওই অনুবাদই প্রথম অনুবাদ যার মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়া ও ইয়োরোপ প্রথম হিন্দু দর্শনের সংস্পর্শে আসে। (অমর্ত্য সেন; ভারতঃ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ)। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য এবং প্রাচীন ভারতের কথা বলা হয়েছে সেখানে ইতিহাসের এই অংশটি অন্তর্ভুক্ত নয় কেন? এরা কোন্ ভারতবর্ষের কথা ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে চায়? সুতরাং, পাঠ্যপুস্তকগুলিতে হিন্দুত্ব রাজনীতি ও বিভেদকামী বিষয়বস্তু স্থান পাবে এবং বিজ্ঞান ও যুক্তির বদলে বিশ্বাস ও মিথের মাধ্যমে নবপ্রজন্মকে হিন্দু ভাবধারা ও সংস্কৃতির নামে হিন্দুত্বের বাহিনীতে পরিণত করার চেষ্ঠা হবে তা আর নতুন কিছু নয়। এদের হাতে ইতিহাসের পুনর্লিখন হলে তা বিকৃত মতাদর্শ, কুসংস্কার, তথ্য বিভ্রান্তির বিকৃত দলিল ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। তাই গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী আর গান্ধীজি, জওহরলাল থেকে ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং সহ তামাম স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানকারীরা দেশদ্রোহীতে পরিণত হবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বিগত ২০১৯ সালে ৩১ জুলাই কে কস্তুরীরঙ্গন কমিটি শিক্ষানীতির খসড়া রিপোর্ট জমা দেয় আর ১ জুন সরকার তা প্রকাশ করে এবং মতামত আহ্বান করে। কোনো মতামত যে সরকার গ্রহণ করেনি তা প্রথম অনুচ্ছেদ থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন এবং সেজন্য স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় তা তড়িঘড়ি ৩১ জুলাই নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রীসভা অনুমোদন করে প্রকাশ করে দিল। সংসদে কোনো আলোচনা হলো না, রাজ্যগুলো কোনো মতামত দিল না, দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষাব্রতীরা কোনো আলোচনা করলেন না, শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিকস্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত স্তরে সমস্ত ধরনের শিক্ষক সংগঠনগুলো আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন না অথচ এই শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অনুমোদন পেল। কস্তুরীরঙ্গন কমিটির ৪৮৪ পাতা প্রতিবেদন মাত্র ৬৬ পাতায় ফরমান হিসাবে দেশবাসীর কাছে নির্দেশ হয়ে এলো। আপনাকে মানতেই হবে।
এই রিপোর্টকে আসলে গাছের গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়, যা মানুষকে বোকা বানানোর একটি সনদ। এরা বুনিয়াদি শিক্ষার মূলেই আঘাত করেছে। রবীন্দ্রনাথ বুনিয়াদি শিক্ষার অভাব ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার অন্যতম একটি বলে মনে করে বলেছিলেনঃ ‘‘আমার মত এই যে ভারতবর্ষের বুকের উপর যত কিছু দুঃখ আজ অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার একটি মাত্র ভিত্তি হচ্ছে অশিক্ষা। জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ, কর্মজড়তা, আর্থিক দৌর্বল্য - সমস্তই আঁকড়ে আছে এই শিক্ষার অভাবকে।’’ (রাশিয়ার চিঠি)। স্বাধীনতার ৭৪ বছরের প্রাক্কালে দেশের বুনিয়াদি শিক্ষার অবস্থার কি একটুও পরিবর্তন হয়েছে? অনেকগুলি শিক্ষা কমিশন হয়েছে। তারা অনেক ভালো ভালো সুপারিশ করেছে কিন্তু কার্যকর করবেন যারা তারা যদি জনগণের শিক্ষার বিস্তার না চান, তা হলে অশিক্ষা কিভাবে দূর হবে? এ ব্যাপারে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যেকেই কম-বেশি দায়ী। শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বাজেটে ৬ শতাংশ ব্যয় করার কোঠারি কমিশনের সুপারিশকে কেউই মান্যতা দেননি। বরং, বাজেটগুলোতে শিক্ষাখাতে ব্যয় উত্তরোত্তর কমেছে। আবারও ছয় শতাংশ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি এই শিক্ষানীতিতে দেওয়া হয়েছে। এদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করবে কে? অধিকাংশ প্রচারমাধ্যম বিকিয়ে গেছে এদের হাতে। বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ্দের একটি বড়ো অংশ এদের দালালি করছেন এবং শিক্ষাব্যবসার তালেবরের ভূমিকা পালন করছেন। সুতরাং, অভিভাবক সমাজ সহ ছাত্র ও শিক্ষকসমাজকে একতাবদ্ধ আন্দোলনে নামতেই হবে, অন্য কোনো উপায় নেই। আর আশ্চর্য এই যে, শিক্ষানীতিতে অর্থ বিনিয়োগ ও বরাদ্দ নিয়ে কিছুই বলা নেই। সাধারণ মানুষকে এরা কীভাবে!
শিক্ষাকে ১) ফাউন্ডেশনাল পর্ব - যাতে প্রাক্-প্রাথমিক অর্থাৎ ক্লাস ওয়ানের আগে (তিন বছর বয়স থেকে ছয় বছর), প্রাথমিক অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান এবং টু (ছয় বছর থেকে আট বছর), প্রিপারেটরি অর্থাৎ ক্লাস থ্রি ও ফোর (আট বছর থেকে ১১বছর) পর্যন্ত ভাগ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার পর মাধ্যমিক স্তর - দু’ভাগে বিভক্ত। অষ্টম পর্যন্ত এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ।
প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আর্থিক অনটন। যথেষ্ট সংখ্যক স্কুল নেই এবং যে স্কুলগুলি আছে সেগুলোতে শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। দ্বিতীয়ত, প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের স্কুলে নিয়ে আসার বিস্তর সমস্যা রয়েছে। দারিদ্র্য প্রধান সমস্যা। ইতিমধ্যে শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ হতে দেখেছি, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার হাল এর ফলে একটুও কি ফিরেছে? এবার বলা হয়েছে ইসিসিই অর্থাৎ আর্লি চাইল্ড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন। সেখানে শেখানো হবে বর্ণমালা, ভাষা, সংখ্যা, সংখ্যাগণনা, রং চেনা, আকার-আকৃতি বোঝা, ইনডোর এবং আউটডোর খেলাধুলো, পাজল টেস্ট, যুক্তিপূর্ণভাবে ভাবতে শেখানো, ছবি আঁকা, হাতে-কলমে জিনিস বানানো, নাটক করা, পুতুল তৈরি, গান, শারীর শিক্ষা এবং নানা স্নায়ুকলা সংক্রান্ত কার্যকলাপ। প্রাক্ প্রাথমিকস্তরে এই কাজগুলো করতে হবে কারণ কমিশন লক্ষ করেছে শিশুর মগজের ৮৫ শতাংশ উন্নতি ঘটে ৬বছর বয়স হওয়ার আগে। ভালো কথা, কিন্তু এই কাজগুলো করতে গেলে উপযুক্ত প্রাথমিক স্কুল প্রয়োজন। দরকার একটি বড়ো পরিসরের জায়গায় পাকা স্কুল, প্রশস্ত মাঠ এবং পর্যাপ্ত শিক্ষার উপকরণ এবং অবশ্যই যথার্থ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উপযুক্ত শিক্ষক শিক্ষিকা। এইসব কাজ করতে গেলে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ, কিন্তু শিক্ষা কমিশন সে ব্যাপারে একটি কথাও খরচ করেনি।
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত প্রসঙ্গে শিক্ষা কমিশন বলেছে ১:৩৬ এবং পিছিয়ে-পড়া সমাজের শিশুদের ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:২৫ করতে হবে। বর্তমানে সারা ভারতে এই অনুপাত ১:৫০ রয়েছে। যদি একে ১:৪০-তে নামাতে হয় তাহলে শিক্ষক সংখ্যা সারা ভারতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে এবং যদি ১:৩০ করতে হয়, তাহলে শিক্ষক সংখ্যা শতকরা কুড়ি শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করতে হবে। এ ব্যাপারেও কোনো অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়নি। সুতরাং, এইসব গোল গোল কথা বলে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া রাস্তায় নেমে না রুখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
যারা এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এটাকে সম্পাদনা করেছেন। নিজেদের গোপন উদ্দেশ্য সুচতুরভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বার বার ‘যুক্তি’ ও ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ শব্দ দু’টো লেখা হয়েছে।
খসড়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, যে সমস্ত স্কুলে ছাত্র নেই এবং শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্ন, শিক্ষকরা অনুপযুক্ত সেগুলি তুলে দেওয়া হবে। এখানে সুচতুরভাবে স্কুল তুলে দেওয়ার প্রকল্প এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাক্ প্রাথমিকস্তরের শিক্ষা অর্থাৎ তিন থেকে ৬ বছর পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য আমাদের দেশে অঙ্গনওয়াড়ি ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলো রয়েছে। এই শিক্ষানীতির ফলে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা, কেন্দ্রীভূত মাধ্যমিক শিক্ষার অঙ্গীভূত অংশ হিসাবে একই ব্যবস্থাপনার অধীনে চলে আসবে। এর ফলে অঙ্গনওয়াড়ি ও শিশুশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা ও মাতৃকর্মীদের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অঙ্গনওয়াড়িতে যিনি শিশুদের শিক্ষা দেন তার বেতন সাড়ে চার হাজার টাকা আর সহযোগী কর্মীর বেতন দু’হাজার দু’শো টাকা। বলা হয়েছে এদের ডিটিএইচ (ডিসটেন্স ডিজিটাল লার্নিং)-এর আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং ক্লাস চলাকালীন সেই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এই প্রশিক্ষণ নিতে হলে স্মার্ট ফোন না হলে সম্ভব নয়। এত স্বল্প বেতনের কর্মীরা স্মার্ট ফোন কেনা তো দূরের কথা, চোখেও দেখেননি। তাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেন? কেউ ভাবতে পারেন এদের বাস্তববোধ নেই কিন্তু একটু তলিয়ে দেখুন, দেখতে পাবেন যে, এক নতুন সিন্ডিকেটের আমদানি হচ্ছে। মৌতাত জমে উঠবে, গজাবে নতুন নতুন সংস্থা এবং এরা কেন্দ্রীয় সরকার তথা জনগণের পয়সায় করে খাবে। খুব সুচতুর ক্লাস্টারড রিসোর্স সেন্টারের নামে শিক্ষানীতি ২০২০-তে বিদ্যালয়গুচ্ছ চালু করার প্রস্তাব একদিকে শিক্ষার কেন্দ্রীভবন ও উপরদিকে প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষার গোড়া কেটে আগায় জল দিয়ে পুরো প্রাথমিক শিক্ষার সরকারি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে ফেলার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এটাই সঙ্ঘের সঙ্গে কর্পোরেটদের গাঁটছড়া যার মান্যতা দিতে চাইছেন মোদী ও সঙ্ঘ পরিবার পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। অত্যন্ত গভীর এক খেলা চলছে।
কী ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর একটি কথা শিক্ষা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে - শিক্ষাকে কখনই বাণিজ্যিকীকরণ করা যাবে না কারণ শিক্ষা জনসেবা। অথচ প্রাক্ প্রাথমিকস্তর থেকেই বাণিজ্যিকীকরণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শিক্ষানীতির মধ্যে নিহিত রয়েছে। অনুচ্ছেদ ২.৯ মিড ডে মিল। এখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, একদম প্রাক্-প্রাথমিক অর্থাৎ তিন বছরের শিশু থেকে ১২ ক্লাসের কিশোর অর্থাৎ ১৮ বছর পর্যন্ত প্রত্যেকেই মিড ডে মিল পাবে। খুব সুন্দর কথা এবং প্রশংসনীয় বটে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে যায় যে!
প্রথমত, এর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তা বরাদ্দ হবে কি? দ্বিতীয়ত, এখানে বলা হয়েছে, একটি কেন্দ্রীভূত কিচেনের মাধ্যমে এই মিড-ডে-মিল সরবরাহ করা হবে। এখানেও সরকার ব্যবসার ক্ষেত্র প্রসারিত করেছেন! ধরুন, প্রথমত, কেন্দ্রীভূত কিচেন পরিচালনা করবে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অথবা ধর্মীয় কিছু প্রতিষ্ঠান, আর অর্থ জোগাবে কে? অবশ্যই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার, অর্থাৎ সরকারি পয়সায় ব্যবসা করে মুনাফা লাভ করার এক সুযোগ! দ্বিতীয়ত, এই মিড ডে মিল কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হলে সমস্ত বিদ্যালয়তে সদ্য রান্না করে গরম এবং টাটকা অবস্থায় সরবরাহ করা কখনোই সম্ভব নয়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়গুলো একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার হওয়ায় রান্না খাবার টাটকা অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। ফলে কিছু রেডিমেড খাবার সরবরাহ করার জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বরাত পাবে। এই ধরনের গোপন আঁতাত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং তার পেটোয়া বিভিন্ন ধর্মীয় ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সুপারিশ ছাড়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি পরিচালিত সরকারের আমলে এই অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যে আমরা লাভ করেছি। এই পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলশ্রুতিতে রাজ্যের প্রতিটি পঞ্চায়েত ও পৌর এলাকায় নতুন করে মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। মিড ডে মিলের যে পুরনো পরিকাঠামো ছিল - একজন রাঁধুনি ও একজন বা দু’জন সহযোগী, যারা দুপুরবেলার খাবার রান্না করে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতেন শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী বন্ধুদের তত্ত্বাবধানে - তা উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে যারা কিছু শ্রমদান করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন তারা বেকার হয়েছেন এবং পরিবর্তে নতুন মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী এলাকায় এলাকায়, গ্রামে শহরে তৈরি হয়েছে। এরা সরকারের পয়সায় মুনাফা করছেন। এবার নয়া-শিক্ষানীতির ফলে দেশব্যাপী এদের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
এই যে পুরনো ব্যবস্থা পাল্টানোর ছক, এর পিছনে গভীর চক্রান্ত অনুধাবন করে পথে না নামলে সমূহ সর্বনাশ হয়ে যাবে। দেশের সচ্ছল মানুষের সন্তানরা তিন বছর বয়স থেকে প্লে স্কুলের মাধ্যমে প্রাক্ প্রাথমিকস্তরে পড়াশুনা শুরু করতে পারে, কিন্তু আমজনতার পরিবারগুলো ছেলেমেয়েদের পেট-পুরে খেতে দিতে পারে না, তাদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীভূত শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে এনে উন্নত শিক্ষা দেওয়ার নাম করে বিদ্যালয় ছুট করার চালাকি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।