E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২য় সংখ্যা / ২১ আগস্ট ২০২০ / ৪ ভাদ্র ১৪২৭

প্রসঙ্গঃ অর্থনীতি

দেশের অর্থনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও জাতীয় শিক্ষানীতি

ঈশিতা মুখার্জি


শিক্ষানীতি দেশের উন্নয়নে কি ভূমিকা পালন করে? শিক্ষার সাথে দেশের শ্রীবৃদ্ধি বা জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হারের কি যোগাযোগ আছে? আছে তার কারণ শিক্ষা দেশের মানবসম্পদ সৃষ্টি করে। এবার এই নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের নাম বদল হয়ে শিক্ষা দপ্তর হয়ে গেল। নাম বদল খুব মামুলি বিষয় নয়। এই শিক্ষানীতি এমনই একটি নীতি যে এর সাথে দেশের মানবসম্পদের কোনো যোগাযোগ নেই। এই ঘটনা ঘটছে আজ বেশ কয়েক বছর ধরে। শিক্ষার সাথে দেশের অর্থনীতির সম্পর্ক কিন্তু সরাসরি। শিক্ষা মেধা বৃদ্ধি করে, কাজ করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানুষের শ্রমশক্তির বিকাশ ঘটায়। এই শ্রমশক্তি একটি দেশের সম্পদ। এই শ্রমশক্তিকে উৎপাদনে রূপান্তরিত করে একটি দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলে। এটিই হলো মানবসম্পদ। একটি দেশের অনেক সম্পদের মতো এই মানবসম্পদ হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক ধরনের চাবিকাঠি। কারণ যদি কোনো দেশ তার শ্রমশক্তির পূর্ণ ব্যবহার না করে তাতেও এক ধরনের উন্নয়ন ঘটে তবে তাতে দেশের মানুষ বেকার থাকে এবং বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়। তাই দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হলেও বেকার থাকা সম্ভব যদি সেই উন্নয়ন পুঁজিনিবিড় উন্নয়ন হয়। অর্থনীতিতে এই বিতর্ক আছে যে, পুঁজিনিবিড় উন্নয়নে বৃদ্ধির হার বেশি হয়, না কি শ্রমনিবিড় উন্নয়নে বেশি হয় এবং কোন্‌টি কখন গ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশেও শ্রমনিবিড় উৎপাদনের পথ ছেড়ে পুঁজিনিবিড় পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল নয়া-উদারীকরণের হাত ধরে। অবশ্য পুঁজিও এই শ্রীবৃদ্ধি বিশেষ আনতে সক্ষম হয় নি আমাদের দেশে, সে আলাদা প্রশ্ন। শ্রমশক্তিকে কোন্‌ সরকার কতটা ব্যবহার করবে তা সেই সরকারের নীতির রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রশ্ন। কিন্তু শ্রমশক্তি দেশের শ্রীবৃদ্ধির পথ খুলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এ কথা স্পষ্ট। আবার এটাও সঠিক যে, শ্রমশক্তি একা কোনো উৎপাদন করতে পারে না। এর জন্য নিশ্চয়ই প্রয়োজন বিনিয়োগ অর্থাৎ পুঁজির বিনিয়োগ। তাই শ্রমশক্তি দেশের সম্পদের ঠিকানা। এটি হলো মানবসম্পদ।

মানবসম্পদের সাথে জাতীয় উৎপাদনের পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। শিক্ষা যেমন মানবসম্পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে, তেমনই জাতীয় উৎপাদনের সাথে শিক্ষার এবং মানবসম্পদ সৃষ্টির সম্পর্কও আছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল অর্থনীতিতে শিক্ষার হার কম থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে অর্থনীতির গতি বাড়লে শিক্ষার হার বাড়ে। অমর্ত্য সেন অবশ্য শিক্ষাকে স্বাস্থ্যের সঙ্গে জুড়ে মানবোন্নয়নের কথা বলেছেন। তাঁর তত্ত্ব হলো এই যে, অর্থনৈতিক গতি ছাড়াও আরেক ধরনের উন্নয়নের সঙ্গে দেশের মানুষের ভালো থাকার যোগ আছে, এটিই হলো মানবোন্নয়ন। এই মানবোন্নয়নের মূল স্তম্ভ হলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। তাই দেশের শিক্ষানীতির সঙ্গে দেশের অর্থনীতির যোগ ঘনিষ্ঠ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন শিক্ষানীতিকে আলোচনা করা উচিত।

একটি সমস্যার কথা বিশ্ব শ্রম সংস্থা ভারতের ক্ষেত্রে কিছুদিন ধরে বলছে। অর্থনীতির গবেষকেরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কথাটা হলো এই যে, আমাদের দেশে যতজন ক্লাসরুমে লেখাপড়া শেখে ততজনকে কাজ করতে দেখা যায় না। মহিলাদের ক্ষেত্রে তো ভীষণভাবে এই কথা সত্য। এর মধ্যে সমস্যা কোথায়? সমস্যা এইখানে যে, এই দেশ তার শ্রমশক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে না, করলে হয়ত তার আরও বেশি উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হতো। আমরাও পরিসংখ্যানে দেখেছি যে, দেশের বেকারি রেকর্ড ছুঁয়েছে। এই সমস্যার সমাধান দুভাবে হয়। লেখাপড়া শেখা এবং চাকরি পাওয়া - এর মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য যুক্তি বলে, হয় চাকরি আরও সৃষ্টি করতে হবে নয় লেখাপড়া শেখানোটাই কমিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষানীতি প্রথম পথে না হেঁটে দ্বিতীয় পথে হাঁটল। অর্থাৎ লেখাপড়া শেখানোর সুযোগটাই কমিয়ে দিল, আর তা হলে শ্রমশক্তি অতিরিক্ত হবার কোনো প্রসঙ্গ আসবে না। কেন করবে এই কাজ একটি দেশের সরকার? কোন্‌ রাজনৈতিক-অর্থনীতির ফলে একটি দেশ তার নিজের শ্রমশক্তি আর তৈরি করতে চায় না?

এই কাজ করা সম্ভব ঠিক যখন একটি দেশ তার মানবোন্নয়ন তৈরির কাজ থেকে নিজে হাত গুটিয়ে নিয়ে শিক্ষা স্বাস্থ্যের দায়ভার সবটা চাপিয়ে দেয় বেসরকারি ক্ষেত্র এবং করপোরেটের উপর। আমাদের দেশে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, সে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার এবং দেশের উন্নয়নের একটি মূল ভিত্তি হিসেবে না দেখে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে দেখে। এইভাবে দেখলে শিক্ষার ব্যবসায়িক দিকটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। শিক্ষার সম্পুর্ণ বেসরকারিকরণ এইভাবেই সম্ভব হবে। শিক্ষাকে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে দেখলে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেওয়া যায়, কারণ দেশ স্বাধীন হবার সময় থেকেই শিক্ষাকে সর্বজনীন করার কথা বলা হয়েছিল। এই সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলা হয়েছে বলে সাধারণভাবেই দেশের গরিব-বড়লোক সব পরিবার থেকেই শিক্ষার এক বিপুল চাহিদা আছে। সেই চাহিদাকে বাজারে রূপান্তরিত করতে পারলে কিন্তু ব্যবসায়িক লাভ প্রচুর। ভারতে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের ইচ্ছুক শিক্ষার্থী রয়েছে ৫০ কোটি। এর মধ্যে আর্থিক বৈষম্য রয়েছে প্রবল। এর অল্প অংশকেই বেশি টাকার বিনিময়ে শিক্ষাকে অতি সহজেই বিক্রি করা যায়। এই বাজারকে লাভজনক করতে গেলে তো সর্বজনীন শিক্ষার ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। সরকার এই কথা মুখে বলতে পারবে না, তাই দলিলেও এই কথা বলা হয় নি। এই দেশে সর্বজনীন শিক্ষা সর্বজনস্বীকৃত একটি ধারণা। তাই এমন মোড়কে এই কথা বলা হলো শিক্ষানীতিতে যে প্রায় বোঝাই গেল না যে, আসলে শিক্ষাকে বেসরকারি ও কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হলো।

শিক্ষানীতিতে যাই থাক, যেমন করেই থাক, দেশের মানুষ তো তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা চাইবে। তাহলে শিক্ষার বাজারকে নিশ্চিত করতে হলে যারা দাম দিতে পারে শিক্ষাকে তাদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। অন্যদের বলা হলো এই যে, তারা ইচ্ছে করলে পড়তে পড়তে শিক্ষানবিশি করতে পারে নানা জায়গায়। অবশ্য কোথাও এমন কথা বলা নেই - হতেই পারে এই বেসরকারি ও কর্পোরেটের কাছেই এরা শিক্ষানবিশি করবে বিনা অথবা কম মজুরিতে। শিশুশ্রম বাড়বে নাকি? এই ছাত্রছাত্রীরা কি আর্থিক শোষণের চাপে পড়বে? বিভিন্ন বিষয়ে পড়বে বলে এদের নাকি পড়ার স্বাধীনতা থাকবে আর যে কোনো সময়ে যে কোনভাবে তারা পড়া ছেড়ে দিতে পারে; আবার পরে আসতেও পারে। পড়া ছেড়ে দেওয়াকে আকর্ষণীয় করার এক চেষ্টা আছে এই দলিলে। খুব স্পষ্টভাবে দ্বৈত শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। এক ধরনের শিক্ষা যা আদপেই মানবসম্পদ তৈরি করবে না। আরেক ধরনের শিক্ষা যা বেসরকারি ও কর্পোরেটের ব্যবসার কাজে লাগবে। এর সাথে মানবোন্নয়নের সম্পর্ক নেই। দক্ষতা তৈরি করে এদের নাকি শিল্প উদ্যোগী তৈরি করা হবে। শিল্পপতিরাই যেখানে শিল্প আনতে পারছে না এই দেশে, সেখানে ক্ষুদ্র শিল্পই নাকি দেশকে বাঁচাবে, এই ভাবে মূলস্রোত থেকে বেরিয়ে যারা যাবে সেই সব ছাত্রছাত্রীর হাত ধরে। এ তো শুধুই আপ্তবাক্য। আবার অনলাইন শিক্ষার রমরমার ফলে পড়াশোনাকে প্রায় ডিস্ট্যান্স লার্নিং বানিয়ে দেওয়া হলো। এতে সরকারকে পরিকাঠামো দিতে হবে না, মোবাইল কোম্পানিগুলির লাভও বাড়ে। শিক্ষানীতির দলিলের যে দিকেই তাকাই না কেন, সে দিকেই এই অন্তর্নিহিত সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। প্রকাশিত হয়ে পড়ছে এই শিক্ষানীতির বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে আত্মসমর্পণ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বহুদিন থেকেই শিক্ষাকে বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্মুক্ত করার চাপ দিয়ে এসেছে। খুব বেশি দেশ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসে নি। আমাদের দেশ তো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা পরোক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে নানাদিক থেকেই। তাই ভারতের বর্তমান সরকার এই শিক্ষানীতিকে সেইভাবেই সাজিয়েছে। এটি আমাদের দেশের মানবসম্পদ তৈরি না করে তাই সরাসরি একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে যেমন দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকেও বিক্রি করতে এগিয়ে গেছে, শিক্ষাক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়।