৫৮ বর্ষ ২য় সংখ্যা / ২১ আগস্ট ২০২০ / ৪ ভাদ্র ১৪২৭
‘‘সারে জাহাঁসে আচ্ছা ইয়ে ‘গুলিস্তাঁ’ হমারা’’
পল্লব সেনগুপ্ত
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে, বিশ্বজোড়া এই ভূমারী-তথা-প্যানডেমিকের ভয়াবহ রাক্ষসিবেলাতেও মানুষের মূঢ়তা এবং তাকে মূলধন করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ফয়দা ওঠানোর পরিমাণ প্রবলভাবেই বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য-গবেষকদের একটি দল কোভিডে আক্রান্ত বিভিন্ন সব দেশের গণমাধ্যম এবং অন্যান্য কয়েকটি প্রাসঙ্গিক সংস্থার থেকে পাওয়া তথ্যকে অবলম্বন করে ওই সমীক্ষা চালিয়েছেন। সমীক্ষাটির প্রথম প্রতিবেদনেই যা উদ্ঘাটিত হয়েছে, তা খুবই চমকে যাবার মতো অবশ্য! সমীক্ষকরা যা সেখানে তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যেঃ কোভিড-১৯ ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা, নিরাময়ের সংখ্যা, নিরাময়ের পদ্ধতি এবং তার আনুষঙ্গিক কুসংস্কার, কাল্পনিক ধারণা ও তাকে মান্য করে বিভ্রান্তি ঘটা - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে যা যা তথ্য পাওয়া গেছে, তার পরিণাম হয়েছে ভয়ঙ্কর; এবং মৃত্যু তো বটেই, অসুস্থতার হারও ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছে। আর সবচেয়ে খারাপ কথা হলো এই যে, এই অন্ধতামস মূঢ়তা বহুক্ষেত্রেই রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রকদের কাছেও প্রশ্রয় পেয়ে গেছে এবং যাচ্ছে!! এটা বিশেষত ঘটেছে এদেশেই যে, তাও বলা দরকার।
সবচেয়ে দুঃখের এবং লজ্জার বিষয় হচ্ছে এটাই যে, ওই সমীক্ষাপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ওই সব মূঢ়তা (এবং শঠতা) পূর্ণ কাজে এগিয়ে আছে - আর কেউ নয়, আমাদের এই ভারতবর্ষ। ঢাকার ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়ারিয়াল রিসার্চ’-এর বিশিষ্ট গবেষক ডঃ সইফ-উল-ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই সমীক্ষাটি করা হয় বিশ্বের ৮৭টি দেশের থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে, এই বছরের জানুয়ারির প্রথম দিক থেকে এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত মাস তিনেকের মধ্যে যেগুলি সংগৃহীত হয়েছে নানা দেশের সহযোগী সমীক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াসে। এরপরেও অবশ্য আরও চারমাসের মতো সময় অতিবাহিত হয়েছে, ফলে সমীক্ষার পরবর্তী স্তরে নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি তথ্য বেরোবে যে, এটা বলাই নিষ্প্রয়োজন।
কিন্তু যা ইতিমধ্যেই বেরিয়েছে, তাতেই তো অধোবদন হতে হয়! যে ৮৭টি দেশের তথ্যবিচার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্ধসংস্কার, বিভ্রান্তিকর প্রচার, ষড়যন্ত্রধর্মী মিথ্যা ভাষণ ইত্যাদি বিভিন্ন অপহ্নবের তালিকায় ১ম স্থানাধিকারী হলো ‘‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দোস্তাঁ হমারা!’’ ডঃ সইফ-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন ওই বহু দেশজোড়া সমীক্ষকদল দেখাচ্ছে যে, তেমন ‘সুকৃতি’-র সংখ্যা এদেশে (ওই সময়কালের মধ্যে) ‘মাত্র’ ৩৫৭টি। এর পরেই আছে মর্ত্যমানবের ‘‘কামনার মোক্ষধাম’’ (গ্রিনকার্ড-লোলুপ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ‘তীর্থের কাক’-তুল্য হা-পিত্যেশ করা মানুষের কাছে!) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৩০৭টি তথ্য) এবং তারপরে রয়েছে খাস চীন দেশ (১৮৯টি তথ্য)। প্রথম পাঁচের (ডি)-মেরিট লিস্টে এদের পরে নাম ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলের। ‘আমেরিকান জুর্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় এই সমস্ত তথ্যসমেত সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়েছে তবে (এদেশের মতো) সরকার-পোষিত কোনো গুন্ডার দল ওখানে ওই পত্রিকার অফিসে হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি তার জন্যে।
।। দুই ।।
যে কালব্যাধিতে বিশ্বে ইতিমধ্যে সাড়ে সাত লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আমাদের নিজেদের দেশেও ২৫ লক্ষের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রয়াত - তাকে উপলক্ষ করে ক্ষমতার সিংহাসন থেকে পাড়ার চায়ের দোকানের কাষ্ঠাসনে আসীন আছেন ও থাকেন যেসব ‘বিজ্ঞ’জন, তারা প্রত্যেকে না হলেও অনেকেই বহু বিচিত্র ধরনের জ্ঞান, উপদেশ, চেতাবনি এবং চিকিৎসা কিংবা প্রতিরোধের পদ্ধতি নিয়ে হরহামেশাই আমাদের মতো আমজনতাকে হক্চকাচ্ছেন! ইসলাম সাহেবের নেতৃত্বাধীন ওই গবেষকবৃন্দ যে সময় পর্যন্ত তাঁদের সমীক্ষার বিবরণ দিয়েছেন, তারপরেও প্রায় মাসচারেক কেটে গেছে ইতিমধ্যে। তো, এই সময়ের মধ্যে ওঁদের খুঁজে-পাওয়া ৩৫৭টি ‘সুভাষিত’ তো বারংবার শোনা গেছে অবশ্যই, কিন্তু সেই সঙ্গে আরও কতগুলি যে অমন সব মণিমুক্তো ঝরে পড়েছে স্বঘোষিত-জ্ঞানীদের শ্রীমুখ থেকে, তার আর ইয়ত্তা নেই! তবে একটা ব্যাপারে এই অভাজন-দুর্মুখ নিশ্চিত যে, এখনও অন্তত এই ক্ষেত্রেও ‘‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’’টি আমাদেরই অধিকারে আছে, অন্যান্যদের তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ‘‘গুল্প’’ (বিখ্যাত ব্রজদার কাহিনিমালার থেকে শব্দটা ধারা নিলাম) বানানোর সুবাদে। দৈনিক সংক্রমণেও সেই ‘সম্মান’ অক্ষুণ্ণ!! এই সব ‘‘গুল্পে’’ কখনও চিকিৎসাপদ্ধতি বাতলানো হয়েছে; কখনও বিশ্বাস-ও-ভক্তির রসে জরো-জরো কিছু বাণী উদ্গিরিত হয়েছে (অবশ্যই রাজনীতির স্বার্থ আছে তার উৎসে)। আপনারা তো জানেন এগুলোর কিছু কিছু; তবু বাছাই করা কিছু কিঞ্চিৎ আবার তুলে দিচ্ছি আপনাদের হাতে - যুগপৎ, রাগ, বিরক্তি এবং কৌতুক (আর তার সঙ্গে তাচ্ছিল্য) বোধ করানোর ইচ্ছায়!
।। তিন ।।
খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে ডাক্তার-সুলভ ভঙ্গিতে বিচিত্র ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রতিষেধক আর নিরাময়কারী ওষুধ (!) নিদান দেওয়ার একটা প্রবণতা বহু মানুষেরই সহজাত। সঙ্কোচের সঙ্গেই স্বীকার একটু আগে যে আমাদের ‘‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’’ দেশটিতে এই ব্যাপারটা একটু বেশিই। এই কোভিড-১৯ মহামারীর কালোসময়ে আরও সেটা বেড়ে গেছে। তেমন বহুবিধ উপদেশামৃতের সঙ্গে আপনাদেরও অবশ্য জান-পহ্চান আছে জানি; তবুও দু-চারটে উল্লেখ করিঃ চিনি ছাড়া লিকার চায়ে রসুন থেঁতো করে গরম-গরম খাওয়া; কালোজিরের সঙ্গে মধু মেখে চেটে-চেটে খাওয়া; হাঁ করে গরম জলে ভাপ গলায় নিয়ে নাক দিয়ে প্রশ্বাসের সঙ্গে সেটা বার করে দেওয়া; সদ্য বাছুর হওয়া গাইগোরুর চোনা খাওয়া; রোজ চার-পাঁচ বার গায়ে গোবর মাখা (বিধানান্তরে খাওয়া); ধুতরোর বীজ বেটে ভেলিগুড়ের সঙ্গে না-চিবিয়ে গিলে ফেলা (এর ফলে বেশ কয়েকটি লোক এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে); লেবুর জলে গোলমরিচের গুঁড়ো ফুটিয়ে খাওয়া; ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ তো গেল ‘ওষুধ’(?)-পত্রের বিধান। এগুলোর পাশাপাশি ‘বিষুধ’-ও (তথা, রোগ তাড়িয়ে শরীরকে ‘বিশুদ্ধ’ করার পদ্ধতি) কিছু কম শোনা যায়নি এবং যাচ্ছে না। সেইরকম কিছু বিধান উদ্ধৃত করিঃ প্রথমেই আমাদের মান্যবর প্রধানমন্ত্রীর দুটি ‘অমর’ বাণীঃ কোনো এক বিশেষ তারিখে দেশশুদ্ধু লোক যদি ঘরের বাইরে এসে ৫ মিনিট হাততালি দেয়, তাহলে যাঁরা ব্যাধির চিকিৎসা এবং সেবা করে চলেছেন তাঁদের উৎসাহ দেওয়া হবে। ভালো কথা! কিন্তু ‘‘পারিষদ দলে বলে তার শতগুণে’’ যে! অতএব, বিজেপি-র সিকি-আধুলিরা আরও অনেকদূর ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করলেন যে, দেশজোড়া হাততালির ফলে যে শব্দ এবং উত্তাপ (হস্তঘর্ষণজনিত) সৃষ্টি হবে, তাতে করোনা ভাইরাসেরা দলে দলে ‘এন্তেকাল ফরমাইবে’ (অর্থাৎ, নিকেশ হয়ে যাবে)!
এরপরে মোদীবাবু বিধান দেন দিনবিশেষের ‘সন্ঝাঁর’ কালে থালা-বাসন ইত্যাদি টং টং করে বাজাতে এবং সেই হুকুমনামাও দেশশুদ্ধ সবার জন্যে। সেটার প্রাথমিক হেতু প্রেরণা দেওয়া, আর পরবর্তী কারণ, শব্দে ভাইরাসদের মৃত্য!
সিকি-আধুলিরাও কেউ পিছিয়ে রইলেন না। কেউ বিধান দিলেন যে, ক’দিন প্রাতঃকালে গোরুর চোনা খাওয়া এবং মুখে-চোখে মাখা বাঞ্ছনীয়। কারুর বিধান, গোরুর দেহনির্গত নানবিধ বাতাস যদি ক’দিন হাঁ করে নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা হয় তাহলে করোনার চতুর্দশ পুরুষ দেশছাড়া হবে। কারুর নিদান, কোভিড হাসপাতাল বানানোর বদলে সর্বত্র যেমনভাবে হোক মন্দির গড়া হোক (নিদেনে ‘দেবতার থান’) - সেটা বেশি ফলপ্রসূ হবে এই সময়ে। আরেকজনের প্রেসক্রিপশান রোজ সহস্রবার ‘হনুমান চালিশা’ পাঠ করতে হবে এক সিটিং-এ এবং যারা পড়তে জানে না, তাদের জন্যেও বিধান আছে - তাদেরকে ওইভাবে বসে শুনতে হবে! ওইভাবে হাজারবার রামনাম জপলে না-কি কোভিডের ‘‘ভূত’’ দেশছাড়া হবে (অন্যান্য ভূতেরা যদি না-ও হয়!) এমন বলেছেন একজন গেরুয়া পার্টিজান। তবে, সর্বশেষ যে বিধানটি শোনা গেল, সেটিও কম মজাদার নয়! জনৈক বিজেপি সাংসদ বলেছেন যে, সারা গায়ে মাটি মেখে (বাঞ্ছনীয় পক্ষে গঙ্গামৃত্তিকা) পাঁচবার শাঁখে ফুঁ দিলে করোনার ‘নচ্ছার’ ভাইরাসরা একেবারে লবেজান হয়ে যাবে!
।। চার ।।
এধরনের ধর্মোন্মাদী-মূঢ়তাকে ঘৃণা করা গেলেও তো উপেক্ষা করা যায় না। তার কারণ, এসব কথায় বহু মানুষই বিভ্রান্ত হয়। রাশিয়ার কোভিড টিকার গুষ্টির তুষ্টি করতে যত আগ্রহ দেখছি চতুর্দিকে, টিভি-সমাবৃত বিশেষজ্ঞদেরকে যেমন বীরবিক্রমে নিন্দে করতে দেখছি সেটার - তার সিকির সিকিভাগ জোর দিয়েও যদি গণমাধ্যমে ওইসব দুর্মেধস অপহ্নবগুলির বিরুদ্ধে প্রচার করতে দেখতাম, তা হলে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারা যেত না-কি!
কিন্তু কী করে আর হবে তা? অধিকাংশ গণমাধ্যমেরই টিকি-বাঁধা বিজেপি সরকারের কাছে - আর বিজেপি সরকারের টিকি বাঁধা ট্রাম্পের কাছে। ...কিন্তু স্বঘোষিত বিজেপি-বিরোধী আমাদের রাজ্য সরকারই বা কী করছে এক্ষেত্রে?