৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮
কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের বিরুদ্ধে ৩১ জানুয়ারি দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি কৃষকদের
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার, ফসলের ন্যূনতম দাবিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে দীর্ঘ ১৫ মাস লাগাতার কৃষক আন্দোলনের চাপে কেন্দ্র সমস্ত দাবি মেনে নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে এক পাও এগোয়নি কেন্দ্র। তাই কেন্দ্রের এই প্রতারণার জবাব দিতে আগামী ৩১ জানুয়ারি দেশজুড়ে ‘বিশ্বাসঘাতকতা দিবস’ হিসাবে পালন করবে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এদিন কিষান মোর্চার ডাকে দেশের সমস্ত জেলা ও ব্লক স্তরে প্রতিবাদে শামিল হবেন কৃষকরা।
গত ১৫ জানুয়ারি সিঙ্ঘুতে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এই বৈঠক থেকেই ঠিক হয়েছে লখিমপুর খেরির গণহত্যার ঘটনায় মোর্চার তরফে উত্তর প্রদেশ অভিযান চলবে। সেখানে বিজেপি’র উদ্ধত ও সংবেদনহীনতার বিরুদ্ধে মোর্চা স্থায়ী আন্দোলন শুরু করবে। সেই লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই ঘটনার মূলচক্রী অজয় মিশ্র টেনিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করার দাবিকে জোরদার করতে কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত এই মাসেরই তিনদিন লখিমপুর খেরিতে যাবেন।
এদিন সিঙ্ঘু-কুণ্ডলী সীমান্তের সেই বৈঠকের জায়গাতেই আলোচনায় বসে সংযুক্ত কিষান মোর্চার শরিক কৃষক সংগঠনগুলি। সেখানেই নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আগামী ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ধর্মঘটকে সমর্থন জানাবে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এদিন বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলন করেও মোর্চা নেতৃবৃন্দ সাধারণ ধর্মঘটকে সমর্থন করার কথা জানান।
এদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কৃষকনেতা দর্শন পাল, অশোক ধাওয়ালে, রাকেশ টিকায়েত প্রমুখ। সাংবাদিক সম্মেলন ছাড়াও এদিন এক বিবৃতিতে আগামী কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সেই বিবৃতিতেই কৃষকদের সঙ্গে বেইমানির জবাব দিতে ৩১ জানুয়ারি দেশজুড়ে ‘বিশ্বাসঘাতকতা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ৯ ডিসেম্বর লিখিত প্রতিশ্রুতি পাবার পরই টানা একবছর ধরে রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে রাখার পর আন্দোলন স্থগিত করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন কৃষকরা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যে আশঙ্কা ছিল একমাসেই তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। মামলা তোলা হোক বা ক্ষতিপূরণ অথবা এমএমপি কমিটি নিয়ে কিছুই করেনি কেন্দ্র। আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলাগুলি তোলার ব্যাপারে কোনো কিছুই করেনি কেন্দ্রীয় সরকারসহ মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলপ্রদেশ সরকার। হরিয়ানা সরকার কেবলমাত্র কিছু কাগজপত্রের কাজ এগিয়েছে।
কিষান মোর্চা জানিয়েছে, বাকি সরকারগুলির কাছে কেন্দ্রের তরফে কোনো চিঠিই পৌঁছায়নি। শহিদ পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়েও একপাও এগোয়নি উত্তরপ্রদেশ সরকার। হরিয়ানা সরকারও এখনো ঘোষণা করেনি কী ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বা তার পরিমাণ কী দাঁড়াবে। এছাড়া লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলেও এমএসপি নিয়ে কমিটি গড়ার ঘোষণা করেনি মোদি সরকার। শুধু তাই নয়, সেই কমিটি কেমন হবে তাও জানায়নি কেন্দ্র। এই বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে ৩১ জানুয়ারি দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে টানা ৩৭৮ দিন কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন - ‘ফার্মার্স প্রোডিউস, ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০; ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইম অ্যাসিউরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিস অ্যাক্ট ২০২০ এবং এসেন্সিয়াল কমোডিটি (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২০ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে কৃষকরা। ২০২০ সালের জুন মাসে এই তিনটি অর্ডিন্যান্স আনে কেন্দ্রের সরকার হয়। পরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে এই তিনটি আইন পাশ হয়।
দেশের মোট পাঁচশতাধিক কৃষক সংগঠনের সম্মিলিত মঞ্চ ‘সংযুক্ত কৃষক মোর্চা’র নেতৃত্বে দিল্লি সীমান্তবর্তী সিঙ্ঘু, টিকরি, শাহজাহানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান, ধরনার মাধ্যমে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা। প্রবল শীত, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ, রোদ, বৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের দমনপীড়ন, নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেও কৃষকরা আন্দোলন জারি রাখেন। এই আন্দোলনে শামিল হয়ে মোট ৭১৫ জন শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কোনো কিছুই এই আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। ক্রমশ এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অবশেষে এই আন্দোলনের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ২৯ ডিসেম্বর সংসদে এই আইন প্রত্যাহারের বিল অনুমোদিত হয়। ৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রের সরকার কৃষকদের দাবিগুলি মেনে নেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়।
কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন বাতিল সহ কৃষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। এছাড়া কৃষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংক্রান্ত যেসব মামলা হয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি ছিল কৃষকদের।শস্যের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো নিয়ে আইনের ১৪ ও ১৫ ধারা প্রত্যাহার করে ফৌজদারি অপরাধ থেকে কৃষকদের অব্যাহতি দেবার দাবিও জানিয়েছিল কৃষকরা। এ কৃষকরা দাবি তুলেছিলেন শহিদ কৃষক পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়াও কৃষকদের দাবি ছিল, লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যায় অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্ত করতে হবে। এই সমস্ত দাবিই মেনে নিয়ে তা পূরণের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ সরকারও সংশ্লিষ্ট দাবিগুলি মেনে নেবার নীতিগত সম্মতি জানিয়েছিল। বিদ্যুৎ সংক্রান্ত বিলও সংযুক্ত কিষান মোর্চা সহ সমস্ত পক্ষর সঙ্গে আলোচনার পরেই আনা হবে বলে জানিয়েছিল কেন্দ্রের সরকার।
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির একমাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কৃষকদের দাবিপূরণের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। তাই কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রতিবাদে আবারও আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। তাই আগামী ৩১ জানুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
সংযুক্ত কিষান মোর্চা এক বিবৃতিতে স্পষ্টতই জানিয়েছে বিজেপি এবং কেন্দ্রের সরকার মানুষের জীবন ও সম্মানের যে তোয়াক্কা করে না তা বেআব্রু হয়ে গেছে লখিমপুর খেরি গণহত্যায়। সিট-এর রিপোর্টে তাকেই মূল চক্রান্তকারী বলা হলেও এখনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় রয়ে গেছে অজয় মিশ্র টেনি। এটা কৃষকদের কাটা ঘায়ে নুনের ছেটার সমান। উলটোদিকে ঘটনা সূত্রে কৃষকদের গ্রেপ্তার করতে অতি সক্রিয় উত্তরপ্রদেশের সরকার। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে লখিমপুর খেরিতে লাগাতার আন্দোলন শুরু করবে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সংযুক্ত কিষান মোর্চা স্পষ্ট করে দিয়েছে ‘মিশন উত্তরপ্রদেশ’ চলবে। তার মাধ্যমেই কৃষকবিরোধী রাজনীতিকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।
শ্রমিক বিরোধী চার শ্রমবিধি প্রত্যাহারের পাশাপাশি কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে আগামী ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ইউনিয়নগুলির ডাকা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে গ্রামীণ ধর্মঘটের মাধ্যমে সমর্থন জানানোর কথা ঘোষণা করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।