E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮

১৯৮২ সালের ১৯ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতে শ্রমিকদের ডাকা প্রথম দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট

শংকর মুখার্জি


দিল্লিতে শ্রমিক-কৃষক ঐক্য দিবস পালনের অনুষ্ঠানে হান্নান মোল্লা, তপন সেন সহ নেতৃবৃন্দ।

স্বাধীন ভারতে শ্রমিকদের ডাকা প্রথম দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ জানুয়ারি। এবছর সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ৪০ বছর। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের জাতীয় ফেডারেশনসমূহের ন্যাশনাল ক্যাম্পেন কমিটি এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। ১৩ দফা দাবি ছিল ধর্মঘটের দাবিসনদে। কেন্দ্রের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের কাছেই ছিল এই দাবিসনদ। ধর্মঘটকে সফল করতে সারা দেশেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক এবং খেতমজুর রাস্তায় নেমেছিলেন ওই দিন। তাঁরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান-বিক্ষোভ, মিছিলে শামিল হন। কিন্তু পুলিশ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘটীদের ওপর নামিয়ে আনে পাশবিক নিপীড়ন। পুলিশের বর্বর আচরণে ১০ জন শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর শহিদ হন ধর্মঘটের দিন। সবচেয়ে নৃশংস ঘটনাটি ঘটে উত্তরপ্রদেশের বেনারস-মির্জাপুর রোডে বাবুর বাজারে এবং তামিলনাডুর নাগাপাট্টিনাম জেলায়। উত্তরপ্রদেশের এই জায়গাটা তখন ছিল বেনারস জেলায়,এখন চান্দৌলি জেলায়। এখানে কংগ্রেসী সরকারের পুলিশের গুলিতে শহিদ হন দুই ভাই ভোলা পাশোয়ান এবং লাল চাঁদ পাশোয়ান। কমরেড ভোলা ছিলেন কৃষক সভার নেতা, আর কমরেড লাল চাঁদ স্থানীয় অশোক ইন্টার কলেজের এসএফআই’র আহ্বায়ক। তামিলনাডুর নাগাপাট্টিনাম জেলায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন তিন খেতমজুর অঞ্জন, নাগুরান এবং জ্ঞানশেখরন।

স্বাধীন ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের এক মাইলফলক ১৯৮২ সালের ১৯ জানুয়ারির ধর্মঘট। শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর ঐক্যকে আরও শক্তিশালী ও প্রসারিত করতে সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষক সভা এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন এবছরের ১৯ জানুয়ারি দিনটি যৌথভাবে ‘শ্রমিক-কৃষক ঐক্য দিবস’ হিসেবে পালন করেছে।

ধর্মঘটের দাবিসনদে শ্রমিকদের মৌলিক দাবিগুলির সাথেই খেতমজুরদের ন্যূনতম মজুরি, খেতমজুরদের জন্য সুসংহত আইন প্রণয়ন, কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম; ভরতুকি মূল্যে খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, চিনি, জামাকাপড় সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গণবণ্টন ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে সরবরাহ ও এর নজরদারির জন্য জনগণের কমিটি; এবং কালোবাজারি, মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মতো দাবিগুলিও স্থান পেয়েছিল। সেই কারণেই এই ধর্মঘট শ্রমিকদের সাথেই কৃষক-খেতমজুর সহ সমাজের ব্যাপক অংশের সমর্থন লাভ করে এবং ওই দিন তাঁরা ব্যাপক সংখ্যায় রাস্তায় নেমেছিলেন ধর্মঘটকে সফল করতে।

এই ধর্মঘট ছিল তার আগের বছরের টানা নয় মাস ধরে প্রচার আন্দোলনের ফসল। ১৯৮১ সালের ২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি দিল্লিতে এক বৈঠক করে। ওই বৈঠকে ঠিক হয়, ৪ জুন তৎকালীন মুম্বাই শহরে শ্রমিকদের জাতীয় কনভেনশন সংগঠিত করা হবে। সিআইটিইউ, এআইটিইউসি, আইএনটিইউসি, এইচএমএস, বিএমএস, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জাতীয় ফেডারেশন এবং অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারীদের ফেডারেশনগুলি ওই কনভেনশনে অংশ নেয়। কনভেনশনেই ঠিক হয় ১৩ দফা দাবিতে ১৯৮২ সালের ১৯ জানুয়ারি সারা ভারত ধর্মঘট ডাকা হবে। এই ধর্মঘট হবে ট্রেড ইউনিয়নগুলির ন্যাশনাল ক্যাম্পেন কমিটির ব্যানারে। কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনগুলিও এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানায়। কিন্তু পরে এই ধর্মঘট থেকে সরে দাঁড়ায় আইএনটিইউসি। এই ধর্মঘটের প্রচার এবং দাবিগুলিকে জনপ্রিয় করতে পরবর্তী ছমাস ধরে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার আন্দোলনের কর্মসূচি চলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২৩ নভেম্বর সংসদ অভিযান। সেদিন দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লক্ষাধিক শ্রমিক, কৃষক এবং খেতমজুর দিল্লিতে সংসদ অভিযানে এসেছিলেন।

ধর্মঘটের দিন উত্তরপ্রদেশে, তামিলনাডুতে

ধর্মঘটের দিন কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী উত্তরপ্রদেশের বেনারস-মির্জাপুর রোডে রাস্তা অবরোধ করেন। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর ছাড়াও ভালো সংখ্যার ছাত্ররাও এই রাস্তা অবরোধে অংশ নিয়েছিল। ফলে বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত যানবাহন। যদিও কর্মসূচি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। তৎকালীন মুঘলসরাই পুলিশ ইন্সপেক্টর সত্যনারায়ণ সিং পিএসি’র সশস্ত্র বাহিনীর ট্রাক নিয়ে বিক্ষোভস্থলে আসেন। বিনা প্ররোচনায় কোনোরকম সতর্ক না করেই শান্তিপূর্ণ অবস্থানকারীদের ওপর তিনি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। প্রথমেই মারা যায় স্থানীয় কৃষক সভার শাখার সম্পাদক ভোলা পাশোয়ান। এরপরেও আন্দোলন থেমে যায় নি। তাঁর ভাই এসএফআই নেতা লালচাঁদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলে। পরে তিনিও পুলিশের গুলিতে নিহত হন, আহত হন আরও ৩২ জন। জনগণের ক্ষোভের ভয়ে পুলিশ দুই ভাইয়ের মৃতদেহ তাঁদের পরিবারের হাতে দেয় নি। পুলিশ মৃতদেহগুলিকে কার্যত কেড়ে নিয়ে গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে রামসানচি শ্মশানে পুড়িয়ে দেয়। এখানেই উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস সরকারের পুলিশ থেমে থাকেনি। তাঁরা এই শহিদ দুই ভাইকে নকশাল হিসেবে অভিহিত করার চেষ্টা করে। পরে জানা যায় পুলিশ কয়েকজন সিপিআই(এম) নেতাকেও এনকাউন্টারে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কমরেড ভোলা এবং কমরেড লাল চাঁদ উভয়েই ছিলেন সিপিআই(এম)’র সদস্য এবং দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান।

তামিলনাডুতে ধর্মঘটের আগেরদিন থেকেই পুলিশি সন্ত্রাস নামিয়ে আনে এআইএমডিএমকে সরকার। ১৯ জানুয়ারি সফল ধর্মঘট হয় তামিলনাডুতে। ধর্মঘটের দিন নাগাপাট্টিনাম জেলায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন তিন খেতমজুর। জেলার থিরুমাগনানমে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের দুই কর্মী কমরেড অঞ্জন এবং কমরেড নাগুরান। অপরজন কমরেড জ্ঞানশেখরন শহিদ হন থিরুথুরুপুন্ডিতে। কমরেড জ্ঞানশেখরন ছিলেন ভারতীয় খেতমজুর ইউনিয়নের কর্মী। থিরুমাগনানম গ্রামে এই শহিদদের স্মরণে শহিদ স্মারক নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর সিআইটিইউ তামিলনাডু রাজ্য কমিটি ১৯ জানুয়ারি দিনটিকে রাজ্যের গণআন্দোলনের সমস্ত শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে। এবছরও শহিদ দিবস পালিত হয়েছে।

আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেদিন তামিলনাডু সিআইটিইউ। তারা ঠিক করে, প্রতিবছর তামিলনাডুর প্রতিটি সিআইটিইউ সদস্য ১ টাকা করে দেবে। সেই টাকা ওই তিন খেতমজুর পরিবারকে তুলে দেওয়া হবে। সেই তহবিল সংগ্রহের কর্মসূচি এখনও জারি আছে। প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালে সংগৃহীত হয়েছিল ৪০ হাজার টাকা। আর গতবছর হয়েছে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।