৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ‘বিকৃত’ করে পুনর্লিখনের অপচেষ্টাকে পরাস্ত করতে হবে
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী - ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ উদযাপন উপলক্ষে ১১ জানুয়ারি প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা প্রচার করেছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতীয় জনগণের মহাকাব্যিক সংগ্রামের ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং ইতিহাসকে নতুন করে লেখার মোদি সরকারের অসৎ উদ্দেশ্যই এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে স্পষ্ট করে ঘোষিত হয়েছে।
এই ঘোষণায় বলা হয়েছে, “স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেই ছিল না, তারও আগে ভারতকে দাসত্বের মধ্যদিয়ে বহু যুগ যেতে হয়েছে।” ভারতীয় উপমহাদেশে যে ভৌগোলিক মানচিত্র বর্তমানে স্বীকৃত তা বিভক্ত ছিল বিভিন্ন রাজবংশীয় শাসনে যাকে ব্রিটিশরা রাজন্যশাসিত রাজ্য বলত। স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ব্রিটিশদের বিতাড়নের পর ৬৫০ টিরও বেশি করদ রাজ্যকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। তারই ভিত্তিতে সংবিধান পরিষদ ভারতীয় সংবিধান রচনা করেছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আড়াই বছর পরে ১৯৫০ সালে এই সংবিধান গৃহীত হবার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশীয় শাসনকে সফলভাবে পরাস্ত করে ভারত একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর মধ্যদিয়েই স্পষ্ট হয় যে, আরএসএস এবং তার হিন্দুত্ববাদী পূর্বগামীরা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ ।আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের এবং বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণ যে অসামান্য আত্মত্যাগ করেছেন সে-সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ যা ছিল প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ তা অনুপ্রাণিত হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দ এবং রামানা মহর্ষির দ্বারা। স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছেন ১৮৬৩ সালে এবং রামানা মহর্ষি জন্মেছিলেন ১৮৭৯ সালে। যখন বলা হয়, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল তখন সেই দাবি হাস্যকর ছাড়া আর কী বা হতে পারে!
১৮৫৭ সালের গদর ভারতীয় জনগণের একটি ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ ছিল।যেখানে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই সহ তাঁতিয়া টোপি এবং ১৮৫৭-র বিদ্রোহের অন্যান্য নেতারা লালকেল্লার প্রাচীর থেকে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং মুঘল শাসক বাহাদুর শাহ জাফরকে স্বাধীন ভারতের সার্বভৌম নেতা ঘোষণা করেছিলেন। আরএসএস'র ভাষায় বাহাদুর শাহ জাফরকে অত্যন্ত কুরুচিকরভাবে ‘বাবর কি আওলাদ’ বলে কুৎসা করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটেই ধর্ম সংসদ থেকে মুসলিমদের গণহত্যার কুরুচিকর ডাক দেওয়া হয়েছে। মুসলিম মহিলাদের লক্ষ্য করে সমাজমাধ্যমে অশ্লীল অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এবং আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন ৮০ শতাংশ বনাম ২০ শতাংশের (উত্তরপ্রদেশের মুসলিম জনসংখ্যা আনুমানিক ১৯ শতাংশ) বলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শোনা গিয়েছে। - এইরকম দানবিক প্রচারই আরএসএস এবং মোদি সরকারের মনোবাসনাকে প্রকাশ করে দিয়েছে। আরএসএস এবং মোদি সরকার চায় ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের পরিবর্তন ঘটাতে।
চক্রান্ত ও পরিকল্পনা খুবই স্পষ্ট - ভারতীয় সংবিধানে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে প্রতিস্থাপিত করা হবে একটি চরম অসহিষ্ণু ধর্মকেন্দ্রিক ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের দ্বারা। স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় জনগণের যে মহাকাব্যিক সংগ্রাম এই চক্রান্ত হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।
প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই সব অখ্যাতনামা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আলোর বৃত্তে নিয়ে আসার জন্য অমৃত মহোৎসব শুরু করা হয়েছে।” এই কর্মসূচির মধ্যে যে লুকানো অসৎ উদ্দেশ্য আছে তাহলো, আরএসএস/হিন্দুত্ববাদী নানা ব্যক্তি যারা বাস্তবে ব্রিটিশদের সাথে সহযোগিতা করেছিল তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক হিসেবে দেখানোর ঘৃণ্য অপচেষ্টা। এমনকী আরএসএস সম্পর্কে সহানুভূতির দৃষ্টিকোণ থেকে লেখাতেও (ওয়াল্টার কে অ্যান্ডারসন এবং শ্রীধর ডি দামলে লিখিত দ্য ব্রাদারহুড ইন স্যাফ্রন) স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস'র অনুপস্থিতির বিস্তৃত বিবরণ আছে। এবং তার পুরষ্কার হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তারা যে সুবিধা পেয়েছিলেন তারও উল্লেখ ওই বইতে আছে। বাস্তবে ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বোম্বের স্বরাষ্ট্র দপ্তর বলেছিল, “সঙ্ঘ সুচতুরভাবে নিজেদেরকে আইনের গণ্ডির ভিতর রেখেছিল এবং বিশেষকরে ১৯৪২ সালের আগস্টের আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল”। একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই আরএসএস’কে কার্যত ব্রিটিশের মিত্রে পরিণত করেছিল।
ব্রিটিশদের সঙ্গে নিজেদের সহযোগিতার এমনসব প্রতিষ্ঠিত সাক্ষ্যনথি থাকা সত্ত্বেও আরএসএস অক্লান্তভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কে অনর্গল মিথ্যা প্রচার চালায়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ‘ভূমিকা’ সম্পর্কে জানতে এটা লক্ষ্য করাই যথেষ্ট যে, ১৯৯২ সালে দেশ যখন ৯ আগস্ট দিবসের পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপন করছিল, তখন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ শংকর দয়াল শর্মা ভারতীয় সংসদে মধ্যরাত্রিকালীন ভাষণে বলেছিলেনঃ “কানপুর, জামসেদপুর এবং আমেদাবাদের মিলগুলিতে ব্যাপক আকারের ধর্মঘটের পর ১৯৪২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে লন্ডনে রাষ্ট্র-সচিবকে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল। সেই রিপোর্টে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে উল্লেখ ছিল; লেখা হয়েছিল, কমিউনিস্ট পার্টির বহু সদস্যের আচরণ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণ করে যে, এই দল ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের নিয়েই গঠিত।”
আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে? স্বাধীন ভারতে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতি ভারতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে স্বয়ং স্পষ্টভাষায় সাক্ষ্য হাজির করে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, কমিউনিস্টরা সবসময়েই ছিলেন “ ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী”।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে অগ্রসর করে নিয়ে যাবার স্বার্থে, ভারতের সংবিধানে প্রদত্ত সাম্য, ন্যায়বিচার এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তাকে আরও অগ্রসর করে নিয়ে যাবার স্বার্থে সমগ্র ভারতীয় জনগণকে একতাবদ্ধ করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের চরিত্র বদলে দেবার আরএসএস/হিন্দুত্ববাদীদের এই দানবীয় চক্রান্তকে পরাস্ত করা আবশ্যিক কর্তব্য। ‘ ইন্ডিয়া তথা ভারত ’- এর স্বার্থেই এই দানবীয় শক্তিকে পরাস্ত করা প্রয়োজন।
সম্পাদকীয়, পিপলস্ ডেমোক্র্যাসি, ১২ জানুয়ারি, ২০২২