৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮
থেমে গেল নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজের জীবনের ছন্দ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ থেমে গেল ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য কত্থকের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বিরজু মহারাজের বর্ণিল জীবন। ১৬ জানুয়ারি রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অন্ত্যাক্ষরী শুনছিলেন। সে সময়ই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই তাঁর হৃদস্পন্দন থেমে যায়। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ৮৪ বছরে পা দিতেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। তাঁর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ধ্রুপদি নৃত্য শিল্প, বিশেষ করে কত্থক নৃত্যের ভুবনে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হলো। ১৭ জানুয়ারি তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।
এই বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পীর জীবনাবসানে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সরোদ শিল্পী আমজাদ আলি খান, অভিনেতা কমল হাসান, হেমামালিনী, মাধুরী দীক্ষিত, সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ সমাজের নানা অংশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি শোকজ্ঞাপন করেছেন।
শিল্পী বিরজু মহারাজের জন্ম লক্ষ্ণৌয়ে। তাঁর আসল নাম ব্রিজমোহন নাথ মিশ্র। সংগীত ও নৃত্যের দীর্ঘ পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক এই পরিবার। এই ঐতিহ্যের মশাল তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বনামধন্য শিল্পী। তাঁর ঠাকুর্দা কাকলাপ্রসাদ এবং ঠাকুর্দার ভাই বিন্দাদিন মহারাজ দু’জনেই ছিলেন লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ’র রাজসভার নৃত্যশিল্পী ও ঠুংরি গায়ক। তাঁরা সংগীত ও নৃত্যে পারদর্শীতার জন্য ‘মহারাজ’ উপাধি পেয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাকলা-বিন্দাদিন লক্ষ্ণৌ ঘরানা। বিরজু মহারাজের বাবা জগন্নাথ মহারাজও ছিলেন প্রখ্যাত কত্থক শিল্পী, অচ্চন মহারাজ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাছেই শৈশবে কত্থকে হাতেখড়ি হয়েছিল বিরজু মহারাজের। তাঁর দুই কাকা শম্ভু মহারাজ ও লাচু মহারাজও ছিলেন বিখ্যাত কত্থক শিল্পী। তাঁদের কাছেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিরজু মহারাজ।
মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা-কাকাদের হাত ধরে তাঁর মঞ্চে আত্মপ্রকাশ। তারপর বাবার সঙ্গেই তিনি কানপুর, এলাহাবাদ, গোরক্ষপুর, কলকাতা ও মুম্বাইয়ে নৃত্য প্রদর্শন করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবার অকাল প্রয়াণে পারিবারিক আর্থিক দায়িত্ব পালনে তিনি চলে আসেন দিল্লিতে। ওই বয়স থেকেই সংগীত ভারতীতে কত্থক শেখাতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর আপন নৃত্যচর্চা। এভাবেই ক্রমশ তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটতে থাকে। দেশে-বিদেশে একের পর এক অনুষ্ঠানে কত্থকের আঙিনায় নিজের দক্ষতার পরিচয় তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে তিনি নিরলসভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কত্থক শিল্পী তৈরিতে মগ্ন হন। লক্ষ্ণৌয়ের পারিবারিক আবাসস্থলে তৈরি হয়েছে কত্থক মিউজিয়াম।
বিরজু মহারাজ এক সময়ে দিল্লিতে ভারতীয় কলাকেন্দ্রে কত্থকের শিক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি সংগীত নাটক আকাদেমির কত্থক কেন্দ্রে অধিকর্তার পদে যোগ দেন। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে অবসরগ্রহণ করলেও থামেনি তাঁর নৃত্যচর্চা। দিল্লিতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর নিজের নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কলাশ্রম। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শুধু কত্থক নয়, সমান পারদর্শী ছিলেন তবলা ও হারমোনিয়মে। এছাড়া অসাধারণ ঠুংরি গাইতেন তিনি। কত্থকের আঙ্গিকে তিনি বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যান থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’-এর নৃত্যায়ন অপরূপ দক্ষতায় মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার উৎকর্ষ ছুঁয়েও শিল্পের অন্যান্য আঙ্গিকেও তাঁর ছিল সাবলীল যাতায়াত। সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র সূত্রেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর প্রথম সংযোগ। এই চলচ্চিত্রে একটি গান গাওয়া ছাড়াও নাচের কোরিওগ্রাফার ছিলেন তিনি। এই সূত্রেই পরবর্তীকালে মুম্বাই চলচ্চিত্রে ‘দেবদাস’, ‘বাজিরাও মস্তানি’ সহ অনেক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে নৃত্যপরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।
বিরজু মহারাজ তাঁর অনন্যসাধারণ কীর্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, পদ্মবিভূষণ, নৃত্য ছন্দোমণি পুরস্কার এবং দু’বার শ্রেষ্ঠ নৃত্যপরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তাঁর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থেই এক বর্ণময় শিল্পীর জীবন পরিক্রমা থেমে গেল। তবুও তাঁর ছন্দোময় জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি অগণিত অনুরাগীর হৃদয়ে সজীব থাকবে অনন্তকাল।