৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮
কেমন আছে বাংলার পঞ্চায়েত
সুপ্রতীপ রায়
দেখতে দেখতে এক দশক অতিক্রম করেছে রাজ্যে তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকারের। মিডিয়ার প্রচার আর সরকারি বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হবে স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলী জমানায় গ্রাম আর শহরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রকল্পের পর প্রকল্পের ঘোষণা হয়ে চলেছে। কিন্তু আসলে উন্নয়ন ঠিক কতটা হলো? পশ্চিমবাংলা গ্রাম প্রধান। গ্রামীণ উন্নয়ন কতটা হলো? গ্রামীণ মানুষের নিজস্ব সরকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার হাল কী?
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে গ্রামীণ উন্নয়নও্ ভেঙে পড়বে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬৫শতাংশ ও কর্মীবাহিনীর ৭০ শতাংশ বাস করেন গ্রামে। জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রাম ভারতের অবদান ৪৬ শতাংশের কাছাকাছি। পশ্চিমবাংলার অর্থনীতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চায়েত আসলে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
গণতান্ত্রিক ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত সঠিকভাবে পরিচালিত হলে গ্রামগুলির অর্থনৈতিক, গোষ্ঠীগত ও সামাজিক বিকাশ সম্ভব হয়। আমাদের দেশের সংবিধানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার দু’টি উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। একটি হলো আর্থিক উন্নয়ন, অপরটি সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা। ১৯৯২ সালে ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনীর মধ্যদিয়ে ভারতের সর্বত্র পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা কায়েম হয়। যদিও আমাদের রাজ্যে ১৯৭৮ সালে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনিক নীতির তিনটি দিক ছিল - ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাহ্রাস, জনগণের প্রশাসনে অংশগ্রহণ। বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দু’টি উদ্দেশ্য ছিল - ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে শ্রেণি সম্পর্কের পরিবর্তন। বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে প্রশাসন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণকে যুক্ত করতে পেরেছিল। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে গ্রামের পশ্চাৎপদ মানুষের উন্নয়ন করেছিল। উন্নয়নের নামে চমক নয়, স্থায়ী গ্রামীণ উন্নয়ন সুচিত হয়েছিল বাম আমলে।
মুখ্যমন্ত্রী কথার কথায় বলেন, বাম আমলে কোনো উন্নয়ন হয়নি। যদিও এ অভিযোগ মিথ্যা। বাম আমলে গ্রামীণ উন্নয়ন সকলকে ছুঁয়ে গিয়েছিল এবং মানব উন্নয়ন হয়েছিল। গ্রামীণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারী ও শিশু উন্নয়ন হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার মানুষের অধিকার বোধ জাগ্রত করতে পেরেছিল। এই অধিকার থেকে তৈরি হয়েছিল সক্ষমতা। বামফ্রন্ট সরকারগুলির পঞ্চায়েতি নীতির ফলে মর্যাদাজনক সামাজিক জীবনযাপনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। বলা বাহুল্য, উন্নয়ন প্রক্রিয়া আসলে মানুষের সক্ষমতা প্রসারের প্রক্রিয়া।
বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামীণ উন্নয়নে গুরুত্ব পেয়েছিল ন্যায়বিচার। সামাজিক সুবিচার। উন্নয়ন হয়েছিল সুষম। উন্নয়নের প্রক্রিয়াতে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। উদারীকরণের ফলে গত কয়েক দশকে বেড়েছে চাষের সাজসরঞ্জামের খরচ, আবার অনুদানও কমেছে। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের নীতির ফলে উৎপাদন বাড়িয়েছিল, চাষি হয়েছিলেন সচেতন এবং পঞ্চায়েতের নেতৃত্বের পরিবর্তন পরিস্থিতির পরিবর্তনে বিশেষ সাহায্য করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নের নীতির ফলেই দারিদ্র্য প্রশমন ও মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটেছিল।
তৃণমূলের আমলে গ্রামসভাগুলির কোনো অস্তিত্ব নেই। বামফ্রন্ট সরকারের সময় গ্রামের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সাধারণ নাগরিকদের মতামত জানানোর সুযোগ করে দিয়েছিল গ্রামসভা। গ্রামসভার মঞ্চে গ্রামবাসীরা নিজেদের সমস্যা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানাতে পারতেন।
তৃণমূলের জমানায় নিয়মিত গ্রামসভার বৈঠক ডাকা হয় না, আছে স্বচ্ছতার অভাব। তৃণমূলের দাপটের কারণে গ্রামবাসীরা নিজেদের মতামত খোলাখুলি জানাতে পারেন না। তৃণমূলী পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা, বিশেষত তৃণমূলী ভৈরববাহিনী নিজেদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে; ফলে গ্রামবাসীরা তাদের কাজকর্মের সমালোচনা করতে সাহস পান না। গ্রামসভা স্থানীয় গণতান্ত্রিক প্রশাসনের এক কার্যকর মঞ্চ হয়ে ওঠার বদলে তৃণমূলের আমলে গ্রামসভাগুলির অপমৃত্যু ঘটেছে।
বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে মানব উন্নয়ন যুক্ত। বিকেন্দ্রীকরণ ত্বরান্বিত করে ক্ষমতায়ন। গত এক দশকে পশ্চিমবাংলায় রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের বদলে কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। গণতন্ত্রের বদলে ঘটেছে আমলাতন্ত্রীকরণ। পঞ্চায়েতের কাজে গণউদ্যোগ থাকছে না। পঞ্চায়েত এখন আর জনগণের নিজের প্রতিষ্ঠান নয়। জনগণের প্রতি সংবেদনশীলতা নেই। জনগণ আস্থা হারাচ্ছে পঞ্চায়েতের উপর। এটি উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার।
গ্রামীণ উন্নয়ন এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ পরস্পর সম্পৃক্ত। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গণতন্ত্র বিকশিত না হলে গ্রামীণ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব হতো না। ‘পভার্টি ইরাডিকেশান ইন ইন্ডিয়া বাই ২০১৫, রুরাল হাউস হোল্ড সেন্টার্ড স্ট্র্যাটেজি পেপার’ শীর্ষক কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে দারিদ্র্যতা কমেছিল। ১৯৭৩-৭৪ সালে এই রাজ্যের গ্রামবাসীদের মধ্যে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৬ হাজার জন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। ২০০৫ এর মার্চ-এ এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৩ লক্ষ ২২ হাজার।
বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে স্থায়ীভাবে গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়ন করেছিল। এক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ভূমিসংস্কার। ভূমিহীন কৃষকদের পাট্টা দেওয়া হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ ৪ হাজার ৯১ একরের বেশি জমি খাস হয়েছিল। অধ্যাপক প্রভাত দত্তের ভাষায় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ‘‘অবদমিত মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেছিল’’।
তৃণমূল ক্ষমতায় এসে উল্টো পথে হাঁটতে থাকে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ভূমিহীন মানুষেরা যে জমির অধিকার পেয়েছিল, তৃণমূল তা কেড়ে নেয়। গরিব মানুষ জমিচ্যুত হচ্ছেন, প্রমোটাররা জমি দখল করছে। তৃণমূলের আমলে অনেক জমির মালিকের নাম পালটে গেছে। প্রকৃত মালিকের নাম মুছে অন্যজনের নাম বসানো হয়েছে। পাশাপাশি পালটে দেওয়া হয়েছে জমির চরিত্র। ব্লক ভূমি দপ্তরগুলি হয়েছে দুর্নীতিবাজদের আড্ডাখানা। বহু পাট্টাদার,বর্গাদারকে উচ্ছেদ করে গরিবের জমি দখল করেছে শাসকদলের কর্মীরা।
গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের তত্ত্ব অনুযায়ী, আঞ্চলিক বিষয়সমূহের পরিচালনায় যত বেশি সংখ্যক মানুষ শামিল হবেন ততই সরকারি পরিষেবার মান উন্নততর হবে। তৃণমূলের আমলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় মানুষকে বিযুক্ত রেখে কাজ হচ্ছে। রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির আওতায় থাকা এলাকায় সার্বিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সুনিশ্চিত হচ্ছে না। গত ১০ বছরে রাজ্যে পঞ্চায়েত পরিচালনায় যে ত্রুটিগুলি নজরে আসছে সেগুলি হলো - পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষজনকে যুক্ত করা হচ্ছে না, স্থানীয়ভাবে লভ্য সম্পদগুলির চিহ্নিত করা ও চাহিদা অনুযায়ী সেগুলিকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। স্থানীয় অঞ্চলে জনপরিষেবা প্রদানে দক্ষতার বৃদ্ধি করা হয়নি, স্থানীয় স্তরের প্রশাসনে দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে।
গ্রামস্তরে গণতন্ত্র এবং সাধারণের নেতৃত্বে উন্নয়নের কাজে গতি আনতে রাজ্য সরকারের কোনো প্রয়াস নেই। গ্রামীণ এলাকায় বহু মানুষের নিজেদের হাতে জমির মালিকানা সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ পেতে অসুবিধায় পড়েন। তারা বাধ্য হচ্ছেন মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করতে। এক্ষেত্রে পঞ্চায়েত বিপদাপন্ন গ্রামীণ মানুষের অনুকূলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সারদা, রোজভ্যালি বিদায় নিয়েছে কিন্তু বিভিন্ন নামে মাইক্রোফিনান্স সংস্থা গজিয়ে উঠেছে। চড়া সুদে গ্রামীণ মানুষের একটি বড়ো অংশ এদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এইসব মাইক্রোফিনান্স সংস্থার সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা যুক্ত।
তৃণমূল আমলে গ্রামীণ বাংলার মানুষ যাতে নিজেদের সম্পত্তিকে আর্থিক সম্পদ হিসাবে কাজে লাগাতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়নি। গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন পরিকল্পনার জন্য জমিজমার নির্ভুল নথিপত্র তৈরি করা হয়নি। পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলের সম্পত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার আইনসিদ্ধ সমাধানের সুসংহত ব্যবস্থাপনা করা হয়নি, জমি সংক্রান্ত বিবাদ হ্রাসের উদ্যোগ নেই, সম্পত্তি কর নির্ধারণের সহায়তা করা হয় না। ফলে পঞ্চায়েতের কাছ থেকে গ্রামীণ মানুষের যে সহায়তা পাওয়ার কথা তা তারা পাচ্ছেন না।
তৃণমূলী শাসনে পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে দলতন্ত্র ও আমলাতন্ত্র গ্রাস করেছে। ফলে প্রতিটি মানুষ উন্নয়ন সম্পর্কে নিজস্ব বক্তব্য রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগের শক্তিশালী সেতুবন্ধন গড়ে তোলা হয়নি। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বৈঠকে বসে এলাকার নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনার যে সংস্কৃতি বামফ্রন্ট পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি গড়ে তুলেছিল তৃণমূল সেই সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী ও দপ্তরগুলির মধ্যে মজবুত যোগসূত্র না থাকার কারণে জনগণ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
তৃণমূল আমলে পঞ্চায়েতগুলি দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত হয়েছে। পঞ্চায়েতে দুর্নীতির বিস্তারও গভীর। গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব পশ্চিমবাংলাতে নেই। গ্রামীণ উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রাম সংসদে বসে ঠিক হয় না - ঠিক হয় তৃণমূলী মাতব্বরদের বাড়িতে বসে। বিরোধীদের কোনো মর্যাদা নেই। আর বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত হওয়ার ফলে অডিট রিপোর্ট দেখানোর কোনো দায় নেই। কৃষি ঋণ থেকে সরকারি ঘর - সবেতেই ঘুষ দিতে হয় তৃণমূলী সদস্য বা সদস্যাকে। মানুষ পঞ্চায়েত সদস্যকে ঘুষ দেবে, অথচ পঞ্চায়েতকে ‘আমার সরকার’ মনে করবে এ কখনো হতে পারে না। সার্বিক বিচারে আর্থিক ক্ষতির চাইতেও গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে গ্রামের সমাজে।
গত দশ বছরে রাজ্যে পঞ্চায়েতে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খরচের দক্ষতার অভাব। পঞ্চায়েতে দুর্নীতির সঙ্গে অদক্ষতার কারণে গ্রামবাসী অনেক টাকা হারিয়েছেন। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাতে তৃণমূল দলের একদলীয় স্বৈরাচার কায়েম হয়েছে। বিপন্ন গণতান্ত্রিক পরিবেশ। পশ্চিমবাংলায় প্রায় সবকটি গ্রামপঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য। উন্নয়ন প্রকল্পের সার্থকতার সঙ্গে বিরোধীদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন প্রকল্পগুলির যথাযথ রূপায়ণে পঞ্চায়েতে বিরোধীদের উপস্থিতি তৎপরতা বাড়ায়, অনুদানের বণ্টনে সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করে।
গ্রামাঞ্চলে যে সরকারি প্রকল্পগুলির সুবিধা বিতরণ করা হয়েছে, তাতে গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না, সব সময়েই স্থানীয় তৃণমূলী দালালরা তাতে মধ্যস্থতা করে। সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের আগে স্থানীয় প্রভাবশালী তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে স্থির হয়ে যায়। তৃণমূল পার্টির মধ্যস্থতার ফলে ‘পার্টিসিপেটারি গভর্নেন্স’-এর যে ধারণা, যা মনে করে যে, প্রশাসনে মানুষের অংশগ্রহণ সমাজে এবং রাজনীতিতে ক্ষমতার বৈষম্য দূর করবে, বাস্তবে তার উলটোটাই ঘটছে। পঞ্চায়েতে দুর্বলতর বর্গের প্রতিনিধিরা কাজ করতে পারছে না।
আসলে তৃণমূলের আমলে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। শাসকদলের সংকীর্ণ রাজনীতির জন্য মানুষ বাদ পড়ছেন উন্নয়নের সুযোগ থেকে। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় বর্তমান সময়ে বিকেন্দ্রীকরণের বদলে দলতন্ত্রীকরণের ফলে গ্রামীণ শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক পরিষেবা গোটা রাজ্যেই খারাপ।
বামফ্রন্ট সরকারই তৈরি করেছিল গ্রামের মানুষের নিজস্ব সরকার - ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা। পঞ্চায়েত অফিসগুলি গ্রামের মানুষের নিজস্ব দপ্তরে পরিণত হয়েছিল। তৃণমূল আসার পর শুরু করলো প্রশাসনিক জনসভা। সরকারি সভা। মানুষ আনা হচ্ছে গাড়ি করে, গাড়ি ভাড়া দিচ্ছে সরকার। গাড়িতে তৃণমূলের ঝান্ডা বাঁধা। প্রশাসনিক সভা পরিণত হয়ে উঠছে দলীয় সভায়।
তূণমূল দুর্নীতিকে সামাজিক বৈধতা দিতে সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে শিকেয় তুলে তৃণমূলের বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত প্রয়োজন। গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বিপুল অঙ্কের টাকা লুটের জন্য চাই বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত। এই লক্ষ্যেই ২০১৩, ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে মধ্যযুগীয় বর্বরতা নামিয়ে আনা হয়েছিল। তৃণমূল-আমলার যৌথ উদ্যোগে দুর্নীতি, যেখানে গরিবের জন্য সরকারি অনুদানের বিপুল টাকা আত্মসাৎ করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্ষোভকে চাপা দেওয়ার জন্যই সন্ত্রাসের বাতাবরণ প্রয়োজন। ফলে তৃণমূলের সন্ত্রাস তৈরি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বলা বাহুল্য রাজনৈতিক সন্ত্রাস অর্থনৈতিক শোষণের উলটো পিঠ।
গ্রামের প্রতিনিধি নির্বাচনে গ্রামবাসীর স্বাধীন মতামত কাজ করেনি। ফলে যে প্রতিনিধিরা মানুষের ভোটে নির্বাচিত হননি, তাঁরা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষার পরোয়া করবেন, উন্নয়নের কাজে গ্রামবাসীর পরামর্শ নেবেন - এমন ধারণা করা ঠিক নয়। বলা হয় গ্রাম সংসদে লোক পাওয়া যায় না, গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের নামও মানুষ জানেন না। কিন্তু কেন? আসলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতে জনগণের অংশগ্রহণ করার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সন্ত্রাস বাড়াচ্ছে কারণ তৃণমূলের প্রতি জনসমর্থন কমছে। যতদিন যাচ্ছে তত সমর্থন আর সন্ত্রাসের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে সন্ত্রাস করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে তৃণমূল।
তৃণমূল পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। অনেক প্রধান কার্যত রাবার স্ট্যাম্প। আসল নিয়ন্ত্রণ তৃণমূল মাফিয়াদের হাতে। তৃণমূল গ্রামবাসীদের কাছ থেকে স্বাধীন চিন্তা, স্বতঃস্ফূর্ত সক্রিয়তা কেড়ে নিয়েছে। বাম আমলের উন্নয়নমূলক, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির বদলে স্থান নিয়েছে অনুদান নির্ভর রাজনীতি। গ্রামীণ উন্নয়নে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নেই।
পঞ্চায়েতকে মেরে ফেলার যে আয়োজন চলছে তাকে রুখতে হবেই। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায়, ‘‘গ্রামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভারতের ভবিষ্যৎ’’।