৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮
রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক খুন ও খুনের আসামীর পুরস্কার প্রাপ্তি
দেবেশ দাস
২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি, হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র রোহিত ভেমুলা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের একটি ঘরে। রোহিত কী প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন? না। রোহিত কী পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন? না।
হোস্টেলের যে ঘরে রোহিত দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়েছিল, সে ঘর তাঁর নিজের ছিল না, আসলে তাঁর কোনো ঘরই ছিল না, কারণ তাঁকে আগেই হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। রোহিত আত্মহত্যার আগে হোস্টেলের ক্যান্টিনে খেতে পারেননি, কারণ ক্যান্টিনে বলে দেওয়া হয়েছিল যেন তাঁকে খাবার দেওয়া না হয় (যেখানে তাঁর ধারে খাওয়ার সুযোগ ছিল)। রোহিত যখন আত্মহত্যা করেছিলেন তাঁর পকেটে কোনো পয়সা ছিল না, কারণ ৬ মাস ধরে তাঁর প্রাপ্য স্কলারশিপ মাসে ২৫ হাজার টাকা সে পাচ্ছিলেন না। ফলে মাকেও টাকা পাঠাতে পারছিলেন না, এই টাকাতেই তো তাদের সংসার চলে। ২৬ বছরের শক্ত-সমর্থ যুবক যখন তাঁর আজীবন দুঃখী জন্মদাত্রীকে টাকা পাঠাতে পারেন না, তাঁর বাঁচবার ইচ্ছা হয়? আমরা সবাই ‘আত্মহত্যা মহা পাপ’ বলে জ্ঞান দিতে পারি, কিন্তু আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন, পয়সাহীন একজন মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবেন? আশ্রয়-খাদ্য-অর্থ কেড়ে নেওয়ার পর, তাঁর আত্মহত্যা করা ছাড়া কী উপায় ছিল?
আশ্রয়-খাদ্য-অর্থ যে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তার কারণ রোহিত কী সমাজবিরোধী ছিলেন? রোহিতের শত্রুরাও তা বলতে পারবেন না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বিএসসি, এমএসসি, পরে পরীক্ষা দিয়ে হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি’তে ঢোকা, মাসে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ২৫ হাজার টাকা স্কলারশিপ অর্জন। কৃতী ছাত্র ছিলেন রোহিত। গবেষণায় তাঁর বিষয় ছিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজ। জীবনের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক কার্ল সাগনের মতো লেখক হওয়ার।
তাঁর এই অবস্থায় পৌঁছনোর পিছনে আছে নিত্যদিন তিলে তিলে এক লড়াইয়ের ইতিহাস। জন্ম থেকেই তা শুরু। রোহিতের মা রাধিকা ছিলেন এক দলিত দিনমজুর দম্পতির সন্তান, এই দম্পতি অন্য রাজ্যে কাজ করতে এসে ছোটো বয়সে রাধিকাকে ছেড়ে দিয়ে যায় এক পরিবারের কাছে। সেই পরিবারেই সে শিশু শ্রমিক, সেই পরিবার তাঁকে বিয়ে দেয় ১৪ বছর বয়সে। কিন্তু কয়েক বছর বাদে রাধিকা তাঁর তিন সন্তান নিয়ে ফিরে আসে সেই পুরনো পরিবারে, কারণ তাঁর মদ্যপ স্বামী তাঁকে ততদিনে ছেড়ে চলে গেছে। রাধিকা সেই পরিবারের কর্ত্রীকে মা বলে ডাকত, ফলে রোহিত তাঁকে ডাকত দিদিমা, কিন্তু সম্পর্কটা আসলে মনিব ও ভৃত্যের। মা কখনো কাজ না করে উঠতে পারলে, চাকরানির সন্তান হিসাবেই তাদের সে কাজ করে দিতে হতো রোহিতকে। তার মধ্যেই পড়াশুনা করে গেছে রোহিত। নির্মাণ শ্রমিক, ক্যাটারিং বয় হিসাবে পড়াশুনার খরচ জোগাড়, পরে স্কলারশিপ পেয়ে কিছুটা স্বস্তি। একটু দাঁড়িয়ে নিজেদের জন্য একটা আলাদা জায়গায় যায় - একটি এক কামরার ঘরে রাধিকার চারজনের পরিবার। সেখান থেকেই রোহিতের হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে যাওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রোহিত যোগ দেয় আম্বেদকর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামক ছাত্র সংগঠনে। বিজেপি-র ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র এক সদস্য রোহিত সহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে তাকে ওরা মেরেছে। বিশ্ববিদ্যলয়ের কর্তৃপক্ষ এমনিতেই বিজেপি ঘেঁষা, সাথে সাথে তদন্ত শুরু হলো। নানা তদন্ত করেও কিছু পাওয়া গেল না - তদন্ত বললো, রোহিতরা নির্দোষ। সেই এবিভিপি’র সদস্য অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডাঃ অনুপমা রাও জানিয়েছিলেন যে, সেই ছাত্রকে “কেউ মেরেছে এমন কিছু বলা যাচ্ছে না... হাসপাতালের রিপোর্টও তাঁর কোনো বাহ্যিক ও দৃশ্যত আঘাতের কথা উল্লেখ করেনি।” দু-দুবার কর্তৃপক্ষের তদন্তে বের হলো যে, রোহিতরা নির্দোষ।
বিজ্ঞান কংগ্রেসে নরেন্দ্র মোদি পুরষ্কৃত করছেন আপ্পা রাওকে।
এর বেশ কিছুদিন পরে রোহিতের শাস্তির দাবিতে এবিভিপি-র সদস্যরা ধরল স্হানীয় সাংসদ ও তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বঙ্গারু দত্তাত্রেয়কে। বঙ্গারু বারে বারে চিঠি লিখলেন তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে, আর স্মৃতি ইরানিও বারে বারে চিঠি লিখলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে। চাপে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বদলে ফেলল তাদের আগের মত, রোহিত সহ পাঁচজনের শাস্তি ঘোষণা হয়ে গেল আর কোনো তদন্ত ছাড়াই। প্রথমে হোস্টেলে থাকা বন্ধ, তারপরে মেসে খাওয়া বন্ধ, আর শেষে স্কলারশিপ বন্ধ। দু-দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সমাজের এই কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে পাঁচজন দলিত ছাত্রের স্কলারশিপ, হোস্টেলে থাকা ও মেসে খাওয়া বন্ধ করে ধনে-প্রাণে মারতে চেয়ে ওদের সহায়-সম্বলহীন, নির্জীব, প্রতিরোধহীন করে দিয়েছিল, সেটাই রোহিতের আত্মহত্যাকে ডেকে আনলো। রোহিত ছিল এই পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে গরিব।
এটাকে আপনি আত্মহত্যা বলবেন কী করে? এটা কী খুন নয়? তাঁর টাকা বন্ধ না করে দিলে, তাঁর হোস্টেলের মেসে ধারে খাওয়ার সু্যোগ বন্ধ না করে দিলে তাঁকে কী মরতে হতো? কর্তৃপক্ষ তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল – তুমি দলিত, তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী শাসকদলের এক ছাত্র। তাই তোমার বিরুদ্ধে দেশের দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তাঁদের নির্দেশে তোমার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, জীবনধারণের তাই ন্যূনতম সুযোগটুকু তুমি পাবে না। রোহিত বাঁচবে কী করে তাহলে? যদি রোহিত দোষীও হতো, তাঁর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সামগ্রী থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা কী ঠিক? এটা খুন ছাড়া আর কী? প্রতিষ্ঠান কর্তৃক খুন। প্রতিষ্ঠান দায়ী হলে শাস্তি পাওয়া উচিত সেই প্রতিষ্ঠান যাঁরা চালান তাদেরই।
রোহিতের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে হইচইয়ে থানায় পুলিশ কেস রুজু করতে বাধ্য হয়, অভিযোগ করা হয় বঙ্গারু দত্তাত্রেয়, একজন বিধায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাওয়ের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকার উপাচার্যকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। কেন তাঁকে ছুটিতে পাঠাতে হলো? নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছে বলেই ছুটিতে পাঠানো। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নির্দেশে কাজ করেই আপ্পা রাওকে বাধ্যতামূলক ছুটি নিতে বাধ্য করা হলো। নিশ্চয়ই এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের আড়াল করতেই উপাচার্যের উপর কোপ, তাঁকে আসামী সাজানো। তবু যতটুকু সরকার ভূমিকা নিয়েছে এই মৃত্যুর পর, শুধু সেটুকুই আমরা যদি দেখি, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় যে, সরকার বলল ভুল একটা হয়েছে, কিন্তু সেই ভুলটা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রীরা নয়। ভুল সরাসরি স্বীকার করা হলো না, কিন্তু ভুল না হলে রোহিতের মৃত্যুর পর বাকি চারজন ছাত্রের উপর সাসপেনশন উঠে গিয়ে তাঁদের স্কলারশিপ, হোস্টেলে থাকা সব কীভাবে চালু হয়ে গেল? এই ছাত্ররা তাহলে কী সত্যিই দোষী ছিলেন না?
সরকারের কার্যক্রমে ভুলের আসামী সাব্যস্ত হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাও। রোহিতের আত্মহত্যাকে খুন ধরলে, আসলে তিনি হলেন খুনের আসামী। কে এই আপ্পা রাও? বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জানিয়েছেন যে, বিজেপি এবং সরকারের সঙ্গী তেলেগু দেশম পার্টির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার জন্যই তাঁকে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছিল, অনেক আরও যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে। চিরকালই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ করে থাকে, কিন্তু বিজেপি’র আমলে রাজনৈতিক নিয়োগ আরও বেড়েছে, এটা বাস্তব।
দলিত বিরোধী নানা ভূমিকার কথা উপাচার্য আপ্পা রাওয়ের বিরুদ্ধে আগেও শোনা গেছে। ২০০২ সালে তিনি ছিলেন একটি হোস্টেলের প্রধান ওয়ার্ডেন। হোস্টেলের মেসগুলি ছাত্ররাই চালায়, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই সময়ে হোস্টেলের মেস ম্যানেজার ছিলেন এক দলিত ছাত্র। আপ্পা রাও তখন সিদ্ধান্ত নেন যে, আর ছাত্রদের দিয়ে মেসের জিনিষপত্র কেনা হবে না, তিনি কেন্দ্রীয়ভাবে এসব কেনার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু, কার্যত এতে ছাত্রদের হোস্টেল খরচ বেড়ে যায়। ১০জন দলিত ছাত্র তাঁকে এটা নিয়ে অভিযোগ করে, তিনি তাঁদের কথায় কান দেন না, বরং তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাঁদের বহিষ্কার করেন। কয়েক বছর পরে তাঁদের কেউ কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পেতে সমর্থ হন, পরে তাঁদের মধ্যে একজন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবেও নিযুক্ত হয়।
আরেক দলিত গবেষক ছাত্র সেন্থিল কুমার পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি’র জন্য গবেষণা করতে এসেছিলেন তামিলনাডু থেকে। নিয়মানুসারে পিএইচডি’র নিশ্চিতিকরণের জন্য প্রত্যেক ছাত্রকে দুটি পরীক্ষা দিতে হয় - একটি লিখিত, একটি মৌখিক। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই আশ্চর্যজনকভাবে সেন্থিল কুমারের জন্য আরও একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে তার পিএইচডি’র নিশ্চিতিকরণ হওয়া দু-বছর পিছিয়ে যায়। হতাশায় ২০০৮ সালে ২৭ বছরের যুবক সেন্থিল কুমার আত্মহত্যা করে বিষ খেয়ে (রোহিত এক চিঠিতে উপাচার্যকে লিখেছিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত ছাত্রদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তার জন্য ভরতি হওয়ার সময়েই কর্তৃপক্ষ এই ছাত্রদের জন্য বিষ দিয়ে দিতে পারে)। পদার্থবিদ্যা বিভাগের ডিন ছিলেন বিপিন শ্রীবাস্তব, আপ্পা রাওকে ছুটিতে পাঠানোর পর এনাকেই অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছিল, এবং পরে তাঁকেও সরকার বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠাতে বাধ্য হয়।
খুব স্বাভাবিক মনুবাদী বিজেপি-র কাছে আপ্পা রাও, বিপিন শ্রীবাস্তবরা হচ্ছেন আদর্শ শিক্ষক। খুব সঙ্গতকারণেই আপ্পা রাওকে উপাচার্য নিয়োগ করেছিল বিজেপি সরকার। চক্ষুলজ্জার খাতিরে ও বিক্ষোভের চাপে রোহিতের মৃত্যুর পর তাঁকে ছুটিতে পাঠিয়েছিল সরকার ঠিকই, কিন্তু তাঁকে সসম্মানে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। আর কিছুই ঘটে না। বরং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নির্দেশ মানতে গিয়ে তাঁর এই বাধ্যতামূলক ছুটি নেওয়ার যে বিড়ম্বনা তাঁকে সইতে হয়েছিল, তার জন্য তাঁকে পরে পুরস্কৃত করা হয়। পরের বছর ২০১৭-র জানুয়ারিতে বিজ্ঞান কংগ্রেসে দুজন বিজ্ঞানীকে মিলেনিয়াম ফলক সম্মান (millennium plaque of honour) দেওয়া হয় তার মধ্যে একজন ছিলেন এই উপাচার্য। তিনি বিজ্ঞানের গবেষণা করতেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যে এত বড়ো বিজ্ঞানী তা আগে কেউ কোনদিন শোনেনি। অনেকেরই মতো যে তিনি এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা ধরেন না, এমনকী তাঁর পেপারে তিনি অন্যের থেকে লেখা চুরি করেছেন তার প্রমাণ আছে (plagiarism), সেটা তিনি স্বীকারও করেছেন।
কার হাত থেকে আপ্পা রাও এই পুরস্কার নিয়েছিলেন? তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দলিতকে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত করার মহান কর্মে যারা নিয়োজিত মোদী এবং বিজেপি তো তাঁদের পুরস্কৃত করবেই।