৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮
অসাম্যের বিস্ফোরণ, হিন্দুত্বের জিগির
শান্তনু দে
এখন ভোট আসলে আগে ধর্ম আসে।
কাশী বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধনের দিন, উচ্চারণ না করেও, প্রধানমন্ত্রী তাই জানিয়ে দেন, অযোধ্যায় যে স্লোগান দিয়েছিল করসেবকরা, ‘ইয়ে সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা আভি বাকি হ্যায়!’ ভোট মানে সংখ্যা। সংখ্যাগুরুর আবেগ। আর সংখ্যাগুরুর এই আবেগ উসকে দেওয়ার সহজ রাস্তা ধর্মের ধুয়ো।
হরিদ্বারে ‘ধর্ম সংসদে’ সাম্প্রদায়িক উসকানি। তীব্র ঘৃণাভাষণ! ফ্যাসিস্তসুলভ হিংসার ডাক! হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির একের পর এক নেতার গলায় ‘মুসলিমদের গণহত্যার’ ডাক। কেউ প্রকাশ্যেই ‘হত্যা’র হুঙ্কার দেন। কেউ বলেন ‘সাফাই অভিযান’ চালাতে। আবার কেউ সওয়াল করেন ‘নাথুরাম গডসে’র মতো হতে।
কোনো রাখঢাক না রেখে তথাকথিত প্রবোধানন্দ গুরু বলেন, ‘মুসলিমদের হত্যা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বার্মার মতো দেশের পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সেনাবাহিনী এবং প্রত্যেক হিন্দুর উচিত অস্ত্র তুলে নিয়ে সাফাই অভিযান করা।’ সাধ্বী অন্নপূর্ণা ওরফে পূজা শাকুন পান্ডা সুর আরও চড়িয়ে বলেন, ‘অস্ত্র ছাড়া কিছু সম্ভব নয়। যদি ওদের নির্মূল করতে চান তো ওদের খুন করুন। খুন করে জেলে যাওয়ার জন্য তৈরি হোন। আমাদের ১০০ জন যদি ওদের ২০ লক্ষকে খুন করার জন্য তৈরি হয়, তবে আমরা বিজয়ী হব।... গডসের মতো আমি কুৎসার মুখে পড়তে রাজি, কিন্তু হিন্দুত্বকে দানবের হাত থেকে রক্ষা করতে আমি অস্ত্র তুলে নেব।’ ২০১৯, সাভারকরের জন্মদিনে নাবালকদের মধ্যে ছুরি বিলি করেছিলেন এই পূজা। গান্ধীজির কুশপুতুলে গুলি করেছিলেন।
একমাস পরেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কাউকে না। প্রথম এফআইআর-এ ছিল মাত্র একজনের নাম। পরে আরেকটি এফআইআর-এ যুক্ত করা হয় আরও চারজনের নাম। বারো দিন বাদে উত্তরাখণ্ড পুলিশ ঘোষণা করে বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট’ গঠনের কথা। গ্রেপ্তার করা হবে কি না, প্রশ্নের জবাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বলেন, তথ্য-প্রমাণ মিললে তবে গ্রেপ্তার। অথচ, তথ্য-প্রমাণের সবই রয়েছে পাবলিক ডোমেইনে। অনুষ্ঠানটির হয় সরাসরি সম্প্রচার। এমনকি তার ভিডিয়ো পর্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়।
লক্ষ্য আসলে প্রবল মেরুকরণ। ক’দিন বাদেই উত্তরপ্রদেশসহ পাঁচ-রাজ্যে বিধানসভা ভোট। মোদির জন্য সেমিফাইনাল। চব্বিশে মহারণ। লোকসভা ভোট। প্রকাশ্যে গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়া হলেও চুপ সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র। এখানেই আশঙ্কা। কে না জানেন, গ্যাস চেম্বার দিয়ে হিটলারের জার্মানি শুরু করেনি, শুরু করেছিল জাতিবিদ্বেষী ঘৃণার ভাষণ দিয়ে, শেষ হয়েছিল গ্যাস চেম্বারে।
‘আব্বাজান’ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে মেরুকরণের হাওয়া উসকে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। আর মথুরায় মন্দির তৈরির ডাক দিয়ে সেই হাওয়াতে আরও বাতাস দিয়েছেন যোগীর উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্য।কাশী বিশ্বনাথ মন্দির করিডর উদ্বোধনে এসে মোদি সেকারণে শুনিয়েছেন ‘হর হর মহাদেব’! ‘ঔরঙ্গজেব কাশী এলে রুখে দাঁড়াতেন শিবাজী’ - তুলনা টেনেছেন তিনি। বলেছেন, ‘কাশী অনেক উত্থানপতনের সাক্ষী থেকেছে। অনেক সুলতান এসেছে, চলে গিয়েছে। কিন্তু কাশী রয়েছে। ঔরঙ্গজেবের অত্যাচার ইতিহাস জানে। কিন্তু তাঁর পালটা শিবাজীও ছিলেন।’
স্বাভাবিক। নীতি আয়োগের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সূচকে দেশের মধ্যে শেষ সারিতে উত্তরপ্রদেশ। যে নীতি আয়োগের অধ্যক্ষ প্রধানমন্ত্রী নিজে! এবং বরাবরের মতো কেরালা একেবারে শীর্ষে, প্রথম স্থানে। দারিদ্র্য সূচকে তিন-নম্বরে যোগীর রাজ্য। একে নীতীশ-বিজেপি জোটের বিহার, দুইয়ে ঝাড়খণ্ড, আর চারে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ। ক’দিন আগে বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থার সমীক্ষায় বড়ো রাজ্যগুলিতে অপশাসনের যে ক্রম প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সবার শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। আর এই তালিকায় সবার শেষে কেরালা। মানে সুশাসনের তালিকায় কেরালা প্রথম। ২০২০, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র হিসেবে খুনের সংখ্যার নিরিখে প্রথম স্থানে উত্তরপ্রদেশ। আর ধর্ষণে দ্বিতীয়।
মোদি-যোগীর ‘ডবল ইঞ্জিন’! তবু এই চেহারা। ভরসা তাই হিন্দুত্ব-তাস। জনসভায় বক্তৃতায় সেকারণে উগ্র হিন্দুত্বের বান।
স্বাভাবিক। ‘বিশ্ব অসাম্য রিপোর্ট ২০২২’-এ অসহায় আর্তনাদঃ ভারত এখন এক ‘চরম অসাম্যের দেশ’!
আয়ের দিক থেকে নিচের সারির অর্ধেক মানুষের গড় বার্ষিক আয় যেখানে মাত্র ৫৩,৬১০ টাকা, সেখানে উপরের সারির ধনীতম ১০ শতাংশের আয় তার প্রায় ২২-গুণ! ১১,৬৬,৫২০ টাকা!
লিঙ্গ বৈষম্যও চরমে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে মোট আয়ে শ্রমজীবী মহিলাদের ভাগ মাত্র ১৮ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার চেয়ে সামান্য উপরে, যেখানে এই হার গোটা বিশ্বের মধ্যেই নিম্নতম। যেখানে অধিকাংশ দেশেই রয়েছে ধর্মীয় স্বৈরতান্ত্রিক জমানা। চীন বাদ দিয়ে এশিয়ার দেশগুলিতে এর হার ২১ শতাংশ। এই সূচক হলো সমাজে মহিলাদের ক্ষমতায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।
মোদির বিলিওনেয়ার-রাজ ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ-রাজকে!
ব্রিটিশ জমানায় ভারতে আয়ের অসাম্য চরমে ছিল। ১০ শতাংশ ধনীতম মানুষের ঝোলায় চলে যেত দেশের মোট আয়ের অর্ধেক। এখন সেখানে ৫৭ শতাংশ। ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার ৭৫-বছর পরেও!
ঘটনা হলো, স্বাধীনতার পরে সমাজতন্ত্রের অনুপ্রেরণায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে অসাম্য কমে। ধনীতম ১০ শতাংশ মানুষের আয় ৩৫-৪০ শতাংশে নেমে আসে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া, উদারীকরণ শুরুর পরে বিশ্বের মধ্যে ভারতে আয়-সম্পদের অসাম্য প্রবলভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী জমানায় উপরের সারির ১ শতাংশ মানুষ এই আর্থিক সংস্কারের ফায়দা সবচেয়ে বেশি তুলেছেন। ধনীতম ১ শতাংশ পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ২৪ লক্ষ টাকার বেশি। যেখানে নিচুতলার ৫০ শতাংশ পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৬৬,২৮০ টাকা।
২০২১, দেশের মোট আয়ের পাঁচভাগের একভাগই গিয়েছে দেশের উপরের সারির এক শতাংশ মানুষের হাতে। অথচ নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষকে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ নিয়েই দিন গুজরান করেন।
প্যারিস স্কুল অব ইকনমিকসের ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব’-র এই রিপোর্ট তৈরিতে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি। রিপোর্টের মুখবন্ধে নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার ডুফলো লিখেছেন, বিশ্বের যে সব দেশে অসাম্য চরমে, ভারত এখন তার মধ্যে পড়ছে।
শুধু ভারতে অসাম্যের ছবি তুলে ধরা নয়, সেই অসাম্য কতটা গভীরে, তা বুঝতে নরেন্দ্র মোদি জমানায় সরকারি পরিসংখ্যানের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘গত তিন বছরে অসাম্য নিয়ে সরকার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তার গুণগত মান গুরুতরভাবে খারাপ হয়েছে। ফলে অসাম্যের ছবিটা সম্প্রতি কতটা বদলেছে, তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১। বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ভারতের চেয়ে এগিয়ে। অক্সফ্যামের ‘ইনইকোয়ালিটি ভাইরাস রিপোর্টে’, লকডাউনের সময় ভারতের বিলিওনেয়ারদের সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ! মহামারীর সময় মুকেশ আম্বানির প্রতি ঘণ্টায় আয় ছিল ৯০ কোটি টাকা! যেখানে দেশের ২৪ শতাংশের মাসিক আয় ৩ হাজার টাকারও কম!
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের হিসেব বলছে, মহামারীর কারণে নতুন করে ১৫-২০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যে তলিয়ে যাবেন। যার অর্থ দারিদ্র্য বাড়বে ১৫-২০ শতাংশ।
একদিকে বিষাক্ত হিন্দুত্ব। অন্যদিকে অসাম্যের বিস্ফোরণ।
কর্পোরেটের স্বার্থকে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের স্বার্থের সঙ্গে। এই মিলিয়ে দেওয়াই হলো মোদি সরকারের আগমার্কা কাজ। এই মিলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যই কর্পোরেট শক্তি এবং হিন্দুত্ববাদের মধ্যেকার আঁতাত। এটাই মোদির আসল কৃতিত্ব। এরই জোরে নিজেকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন।
কর্পোরেটদের হাতে অর্থের ভাঁড়ার থাকায় নির্বাচনী যুদ্ধ জয়ে আর্থিক সাহায্যের জন্য তাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা আবশ্যিক। যার বিনিময়ে কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষা করার দায়টুকুও স্বীকার করতে হয়। আর পণ্যায়িত রাজনীতির যুগে কর্পোরেটদের থেকে পাওয়া অর্থের যথাযথ জোগানের জোরে একটি সাম্প্রদায়িক বিভাজনকামী রাজনৈতিক শক্তি গোটা ব্যবস্থার উপরে সহজেই কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে। যেমন বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক।
অন্যদিকে এহেন গাঁটছড়া থেকে বেশ ভালোই ফায়দা তুলছে কর্পোরেটরা - কিন্তু তাদের মধ্যেও একটি অংশ, বলা চলে ভুঁইফোড় কর্পোরেটরা - অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি গুছিয়ে নিচ্ছে। ‘ফ্যাসিজম অ্যান্ড বিগ বিজনেস’ বইতে ড্যানিয়েল গুয়েরিন দেখিয়েছেন, ১৯৩০ সাল নাগাদ জার্মানিতে নাৎসিদের সাথে নিজেদের সম্পর্কের জোরে কীভাবে টেক্সটাইল এবং অন্যান্য পণ্যোৎপাদনকারী সাবেক কর্পোরেটদের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হয়েছিল যুদ্ধাস্ত্র এবং উৎপাদনশিল্পে প্রয়োজন হয় এমন যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কর্পোরেটরা। জাপানেও ১৯৩১ নাগাদ যে ফ্যসিস্ত-ধাঁচের সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তাদের সাথে সুসম্পর্কের জেরে মিৎস্যুই-এর মতো সাবেকি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে পিছনে ফেলে অনেকটাই উপরে উঠে এসেছিল শিনকো জাইবাৎস্যু’র মতো আনকোরা প্রতিষ্ঠান।
এটা ঠিক, আজকের ভারতের পরিস্থিতি ১৯৩০-এর জার্মানি কিংবা জাপানের তুলনায় অনেকটা আলাদা হলেও ভারতীয় কর্পোরেটদের মধ্যে আদানি-আম্বানিদের মতো গোষ্ঠীদের একই কায়দায় সরকারের তরফে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।