E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৩ সংখ্যা / ২১ জানুয়ারি, ২০২২ / ৭ মাঘ, ১৪২৮

জনসমক্ষে ধর্ষিতা গণতন্ত্র

অম্বিকেশ মহাপাত্র


ইয়োরোপীয় নবজাগরণের পথে বঙ্গপ্রদেশে নবজাগরণ। পথ প্রদর্শক রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ,... প্রমুখ। বঙ্গপ্রদেশ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। ১৯০৫ সাল, বঙ্গভঙ্গ আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের চেষ্টা। রাস্তায় নেমে মানুষের তীব্র বিরোধিতা। রবিঠাকুর প্রমুখ দেশপ্রেমিকেরাও রাস্তায়। রাখীবন্ধন উৎসব, দেশাত্মবোধক গানের অভিঘাত তরঙ্গাকারে রাস্তায় আছড়ে পড়ে। তার দোলা লাগে প্রতিটি গৃহকোণে। ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ আইন রদ করতে বাধ্য করে। কিন্তু দেরি করেনি ব্রিটিশ শাসকরা, ১৯১১ সালে ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থে‍‌কে দিল্লিতে স্থানান্তর করে। অপরদিকে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, সুকান্ত, সলিল, হেমন্ত, হেমাঙ্গ, সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, উৎপল দত্ত, শম্ভু ভট্টাচার্য,... প্রমুখদের অবদানে কলকাতা ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-কুসংস্কার বিরোধী গণআন্দোলনের পৃষ্ঠভূমি কলকাতা। সেই পথে মহামতি গোখলের ঐতিহাসিক মন্তব্য - ‘What Bengal thinks today India thinks tomorrow.’

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করা গেলেও, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ রদ করা গেল না। দাঙ্গার পথে স্বাধীনতা লাভের চুক্তির মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত এবং ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি বিশ্বের মানচিত্রে। পাকিস্তানের দু’টি পৃথক ভূখণ্ড বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তান এবং উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তান। মধ্যিখানে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ভারত ভূখণ্ড! তখন কিন্তু ইন্টারনেট পরিষেবা ছিল না। থাকার কথাও নয়। এমনকী টিভিও ছিল না। দুই ভূখণ্ডের মধ্যে যোগাযোগ কার্যত অসম্ভব। অপরদিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মায়ের অপমান মানবে কেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মাতৃমুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ। শেষমেশ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ আত্মপ্রকাশ করে, বিশ্বের মানচিত্রে। বিশ্বে প্রথম রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রের মাতৃভাষাই রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ ‘বাংলা’, এমনকী দেশের নামও মাতৃভাষার নামে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ’!

একদা ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ব্রিটিশ বিরোধী, কুসংস্কার বিরোধী গণআন্দোলন তথা শিক্ষা প্রসারের পীঠস্থানও ছিল কলকাতা। সেই কলকাতা মহানগরের মহানাগরিক তথা মেয়র ছিলেন দেশপ্রেমিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, তাঁর যোগ্য শিষ্য তথা উত্তরাধিকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও, এমনকী বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্র রায়,... প্রমুখ। আজ একবিংশ শতাব্দীতে তথা ইলেকট্রনিক বিশ্বে, আমরা এমন তিনজন মহানাগরিক তথা মেয়র পেলাম, নেট দুনিয়ার কল্যাণে যাঁদের টিভির পর্দায় দেখা গেল, টাকার বাণ্ডিল ঘুষ হিসেবে নিতে!

এই প্রেক্ষিতে আমার কিছু অভিজ্ঞতা। রাজ্য নির্বাচন কমিশন, হাইকোর্ট, হলফনামা, কলকাতা পুলিশই দক্ষ, প্রতি বুথে সিসিটিভি ক্যামেরা, মডেল কোড অব কন্ডাক্ট, সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া ভোট নাহ,... বহু বহু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতির পর, অনেক টালবাহানার পর, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১, কলকাতা পুর নিগমের নির্বাচন। সকলই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য, সাংবিধানিক অধিকার তথা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য। আসুন, নির্বাচনী ফলাফলে এক ঝলক। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে আনুমানিক ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিলেন। কিন্তু ভোট পড়ল ৬৪.৫০ শতাংশ! তার মধ্যে শাসকদল ৭২.১৩ শতাংশ ভোট পেলেন! ১৩৪নং ওয়ার্ডে শাসকদলের প্রার্থী তথাকথিত প্রাপ্ত ভোটের ৯৭.২৬ শতাংশ ভোট নিয়ে জয় হাসিল করলেন! ৬৬ এবং ১০৯নং ওয়ার্ডে শাসকদলের প্রার্থী যথাক্রমে ৬২,০৪৫ এবং ৩৭,৬২৪ ভোটের ব্যবধানে জয় নিলেন! উল্লেখ্য, ১০৯ নং ওয়ার্ডে আমি বসবাস করি। ৭টি ওয়ার্ডে ৯০ শতাংশের বেশি, ২৮টি ওয়ার্ডে ৮০ শতাংশের বেশি এবং ৪৩টি ওয়ার্ডে ৭০ শতাংশের বেশি ভোট নিয়ে শাসকদলের প্রার্থীরা জিতলেন! শত শত বুথে বিরোধীপক্ষ শূন্য থেকে ১ অঙ্কের ভোট পেলেন! এই রকমের কত মণিমুক্তো ছড়ানো চতুর্দিকে।

আমি এবং আমার পরিবার কলকাতা পুরনিগমের ১০৯নং ওয়ার্ডে গত কুড়ি বছর বসবাস করছি। বরাবর নিউ গড়িয়া পোলিং স্টেশনের একটি বুথে ভোট দিই। এবার সকাল সকাল আমাদের পরিবারের ৪ জন নিজের ভোট নিজে দিয়েছি। কোনো বাধা পাইনি। পরে সরাসরি যা শুনেছি, তার কয়েকটি তুলে ধরছি।

(১) জনৈক সহ-নাগরিক - ‘ভোট দিতে যাইনি, ভোট দিয়ে কী হবে? ফল কী হবে, সে তো জানা!’

(২) কোনো কোনো সহ-নাগরিক বললেন - ‘ভোট দিতে গিয়ে দেখি, আমাদের ভোট পড়ে গেছে! তবে আমাদের ভোট দিতে দিয়েছে, কিছু একটা ব্যবস্থা করে।’

সারণি-১ নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত, ‘নিউ গড়িয়া’ পোলিং স্টেশনের ৩টি বুথের ফলাফল -

বুথ নং টিএমসি বিজেপি সিপিআই(এম) মার্জিন
১৪৩ ৬২৫ ৫১ ৮০ ৫৪৫
১৪৪ ৫৯০ ৪৪ ১২৩ ৪৬৭
১৪৫ ৫১৬ ৩২ ৮৩ ৪৩৩

(৩) প্রাতঃভ্রমণে জনৈক প্রাতঃভ্রমণকারী আমাকে দাঁড় করিয়ে - ‘বুধেরহাট বুথে ভোট দিতে গেলাম, আঙুলে কালি দেওয়ার পর, পাড়ার একজন দাদা বললেন, বাড়ি চলে যাও, তোমার ভোট আমরা দিয়ে দেব, কী আর করব? কিছু করার ছিল না। চলে এলাম।’

সারণি-২ নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত, ‘বুধেরহাট’ পোলিং স্টেশনের ৪টি বুথের ফলাফল -

বুথ নং টিএমসি বিজেপি সিপিআই(এম) মার্জিন
১৩১ ৬৩৩ ৬২৪
১৩২ ৬৬৬ ২৩ ৩১ ৬৩৫
১৩৩ ৫৭৫ ১৩ ১৯ ৫৫৬
১৩৪ ৬৭৬ ২৬ ২৮ ৬৪৮

(৪) প্রাতঃভ্রমণকারীদের জন্য কিছু সবজি বিক্রেতা ভ্যান রিকশা করে সবজি বিক্রি করেন। প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফেরার পথে প্রয়োজনমতো সবজি কিনি। ভোটের পরে একদিন, একজন সবজি বিক্রেতার কাছে সবজি কিনছি। এই কথা সেই কথার মধ্যে জিজ্ঞেস করি - ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ সলজ্জ হাসি হেসে বলেন - ‘কাছেই থাকি’। জানতে চাইলাম - ‘কোথায় থাকেন?’ বললেন - ‘শহিদ স্মৃতি’। হঠাৎ বলে উঠলাম - ‘ও, সেই বিখ্যাত জায়গা, যেখানে ভোটলুটের ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে?’ শুনে শুধু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলাম - ‘আপনি কী ভোটলুটে মদত দিয়েছ্নে?’ লাজুক হাসি হাসলেন এবং বললেন - ‘কি করব? অন্য উপায় নেই’। স্বল্প কথায় বললাম - ‘ভবিষ্যতে বলবেন না, আমার অধিকার আক্রান্ত। নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অধিকার; অনেক লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন, রক্ত, ঘাম, জেলজীবন,... পর অর্জিত হয়েছে। সেই অধিকার লুট করছেন? আমি বলব না, আপনি অমুক পার্টিকে ভোট দিন, তমুক পার্টিকে ভোট দেবেন না। বরং বলব আপনার যাকে পছন্দ তাকেই ভোট দিন, কিন্তু নিজের ভোট নিজেকে দিতে দিন’। প্রসঙ্গক্রমে বললাম - ‘দক্ষিণ আফ্রিকা বলে একটা দেশ আছে। সেই দেশে দুই ধরনের মানুষ আছেন। এক ধরনের মানুষ গায়ের রঙ সাদা, তাদের শ্বেতাঙ্গ বলে, এরা সংখ্যায় কম। অপর ধরনের মানুষ গায়ের রঙ কালো, তাদের কৃষ্ণাঙ্গ বলে, কৃষ্ণাঙ্গরাই সংখ্যায় বেশি। ওই দেশে কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদের ভোট দেওয়ার, নির্বাচিত হওয়ার, প্রশাসন পরিচালনার অধিকার ছিল। আর সংখ্যায় বেশি কৃষ্ণাঙ্গদের এসব কিছুরই অধিকার ছিল না, গায়ের রঙ কালো বলে। যেমন আপনার গায়ের রঙ কালো। তারজন্য আপনি কী দায়ী? সে যাইহোক, কৃষ্ণাঙ্গরা জোটবদ্ধ হয়ে, দল গড়ে, ভোটের অধিকার চেয়ে আন্দোলন করেন। সেকারণে তাঁদের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে টানা ২৭ বছর জেল খাটতে হয়েছিল। নেলসন ম্যান্ডেলার জেলজীবন যখন ২৫ বছর, তখন বিশ্বজুড়ে তাঁর মুক্তির দাবিতে মিছিল হয়েছিল। কলকাতাতেও মিছিল হয়েছিল। তখন আমি কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্র, মিছিলে হেঁটে ছিলাম। সারা বিশ্বের মানুষের চাপে, ২৭ বছর পরে, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বাধ্য হয়েছিল, নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিতে। শুধু মুক্তি নয়, কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের অধিকারও দিয়েছিল। সেই ভোটে কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা এখন মারা গেছেন। যখন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। জ্যোতি বসুর সরকারের উদ্যোগে, সেই নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল কলকাতার ইডেন গার্ডেনে।’ কালো চামড়ার সবজি বিক্রেতা মন দিয়ে শুনলেন। মনে হলো কিছু বুঝেছেন।

সারণি-৩ নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত, ‘শহিদ স্মৃতি’ পোলিং স্টেশনের ৪টি বুথের ফলাফল -

বুথ নং টিএমসি বিজেপি সিপিআই(এম) মার্জিন
১৩৯ ১০০৯ ১০০৯
১৪০ ১১৬৮ ১১৬৭
১৪১ ৯৬৫ ৯৬৪
১৪২ ৯০০ ৮৯৮

সারণি-৪ নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত, ১৬টি পোলিং স্টেশনের ৫৬টি বুথের ফলাফল -

টিএমসি বিজেপি সিপিআই(এম) মার্জিন
৪০,৪৫৮ ২,১৬৮ ২,৮৩৫ ৩৭,৬২৩
(তথাকথিত প্রাপ্ত ভোটের ৮৮.৫২%) (৪.৭৪%) (৬.২০%)

আমাদের স্বাধীন দেশের চরিত্র প্রজাতান্ত্রিক। প্রজাতান্ত্রিক দেশের প্রত্যেক দেশবাসীই দেশের মালিক। দেশের সংবিধান অনুযায়ী, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রত্যেক নাগরিক নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেবেন। নির্বাচিত প্রার্থী সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে সমাজের কল্যাণে দেশবাসীর জীবন ও জীবিকার জন্য কাজ করবেন। সমাজের অপরাধীরা যাতে অপরাধ সংঘটিত করতে না পারেন, তার জন্য সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া সকল প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করবেন। অবশ্যই মানবিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ। এই প্রেক্ষিতে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী, নবজাগরণের বাংলার রাজধানী, কলকাতার পুরনিগমের নির্বাচনে মানুষের অধিাকর লুট হয়ে গেল সকলকে সাক্ষী রেখে! প্রশাসনিক প্রধান, সাংবিধানিক প্রধান, সংবাদ জগৎ,... সকলকে সাক্ষী রেখে জনসমক্ষে নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে এবং সহযোগিতায়! এই ঘটনা সামান্য বিচ্যুতি নয়। এই ঘটনা, সাংবিধানিকদের সাক্ষী রেখে, দিনে-দুপুরে গণধর্ষিতা হলেন সাংস্কৃতিক মনন, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মানুষের অধিকার, সংবিধান মায় গণতন্ত্র। পুনরুদ্ধারে আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের লড়াইয়ের প্রস্তুতি দরকার। সেই লড়াইয়ে শামিল হউন, চুপ থাকবেন না। চুপ থাকা অন্যায় - যখন রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায়।