৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০
বিজেপি’র বিরুদ্ধে ভারতকে জয়ী করতে লড়বে ‘ইন্ডিয়া’
বেঙ্গালুরুতে বিজেপি বিরোধী দলসমূহের বৈঠকে সীতারাম ইয়েচুরি, ডি. রাজা, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গত ১৮ জুলাই দেশের ২৬টি বিজেপি-বিরোধী দল দু'দিনের বৈঠক শেষে 'ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স' বা 'ইন্ডিয়া' নামের জোট গড়ে দেশ রক্ষার লক্ষ্যে এগোনোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ভারতের বৈচিত্র্য, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে লড়বে 'ইন্ডিয়া' এবং এই লড়াইয়ে সংঘ পরিবারকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত 'ইন্ডিয়া'-ই জিতবে। বেঙ্গালুরুর বৈঠক থেকে সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের এটাই সুর। মোদি সরকারের আমলে 'ভারতের ভাবনা' যেভাবে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ভারতীয় সভ্যতার মর্মবস্তু রক্ষা করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাই জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন 'ইউপিএ'-র বদলে 'ইন্ডিয়া' নামের ব্যাপক মঞ্চে শামিল হয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রশ্নে সহমত পোষণ করেছেন ২৬ দলের নেতৃবৃন্দ। 'ইন্ডিয়া' বনাম বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির এই লড়াই নিঃসন্দেহে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে চলেছে।
বৈঠকে গৃহীত যৌথ প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, সংবিধানে বর্ণিত 'ভারতের ভাবনা'কে রক্ষা করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক জটিল সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি আমাদের দেশ। ভারতীয় সংবিধানের মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ন্যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে পরিকল্পিতভাবে খর্ব করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মণিপুরে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা হিংসা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে প্রস্তাবে। এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর আশ্চর্যজনক নীরবতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রস্তাবে 'জাতভিত্তিক জনগণনা' চালুর দাবি জানানো হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মহিলা, দলিত, আদিবাসী এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর ক্রমাগত হামলার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিরোধী নেতারা।
গত মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই বিজেপি বিরোধী নেতৃত্বের চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর ঠিক হয়েছে যে, এই মঞ্চের কার্যকরী ভূমিকা নিশ্চিত করতে ১১ সদস্যের 'সমন্বয় কমিটি' গঠন করা হবে। একইসঙ্গে প্রচার ও অন্যান্য কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্বে থাকবে একটি সম্পাদকমণ্ডলী। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করা হবে। 'ইন্ডিয়া'র পরবর্তী যে বৈঠক মুম্বাইয়ে হবে সেখানে 'সমন্বয় কমিটি'র আহ্বায়ক সহ সদস্যদের নাম এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের নাম ঠিক করা হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিক বৈঠকে বিরোধী দলগুলির নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। বিরোধীদের তরফে প্রধানমন্ত্রীর পদে 'মুখ' হিসাবে কাকে তুলে ধরা হবে, সেই প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, "এই বৈঠকে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধিই আমাদের লক্ষ্য ছিল। দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায় রক্ষার জন্যই এই বৈঠক।" খাড়গে জানিয়ে দেন যে, কংগ্রেস ক্ষমতা কিংবা প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য লালায়িত নয়। বৈঠকের ফাঁকে ওইদিন সকালে সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বিরোধী দলগুলির বৈঠকের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, দেশ এখন তীব্র বহুমুখী আক্রমণের মুখে। দেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অটুট রাখাই এখন দেশের সামনে সবচেয়ে বড়ো কাজ। সেই লক্ষ্যেই বিজেপি-কে সরকার এবং রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে হঠাতে হবে বলে বিরোধীরা মনে করেন। এ কারণেই ২৬ দলের সহমতের ভিত্তিতে গঠন করা হয়েছে 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স' বা 'ইন্ডিয়া'। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, আপ প্রধান কেজরিওয়াল, ডিএমকে প্রধান এমকে স্ট্যালিন, আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিং যাদবের মতো বিভিন্ন বিরোধী নেতৃবৃন্দ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিজেপি'র ধ্বংসাত্মক ও বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইয়ের আহ্বান জানান।
বেঙ্গালুরুর বৈঠকে উপস্থিত ছিল কংগ্রেস, ডিএমকে, জনতা দল (ইউ), সিপিআই(এম), সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই(এমএল), আপ, তৃণমূল, আরজেডি, জেএমএম, এনসিপি, শিবসেনা (ইউবিটি), সমাজবাদী পার্টি, আরএলডি, আপনা দল (কামেরাওয়াদি), ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি, এমডিএমকে, ভিসিকে, কেএমডিকে, এমএমকে, আইইউএমএল, কেরালা কংগ্রেস (মানি) এবং কেরালা কংগ্রেস (জোসেফ) দলের প্রতিনিধিরা।
বিরোধীদের বৈঠকের দিনই দিল্লিতে বৈঠক ডেকেছিল এনডিএ। এতকাল এনডিএ-র নাম উচ্চারণ করেনি মোদি সরকার। দ্বিতীয় দফায় দিল্লির ক্ষমতায় আসার পরে একটিও বৈঠক হয়নি বিজেপি নেতৃত্বাধীন এই জোটের। বিরোধী ঐক্যের নজির দেখে আতঙ্কিত বিজেপি তাদের বশংবদ কয়েকটি দল এবং কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে একত্রিত করে এখন বৈঠক করেছে। এনডিএ তাদের দিল্লির বৈঠকে ৩৮টি দলকে হাজির করার দাবি জানালেও ওই দলগুলির কয়েকটির অস্তিত্ব নিয়ে এদিন প্রশ্ন তোলেন কংগ্রেসের সভাপতি খাড়গে। এদিকে বিরোধী ঐক্যের ফলে বিব্রত মোদি যথারীতি অভিযোগ করেছেন যে, কোনো একটি পরিবারকে রক্ষা করতে নাকি কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছে। যোগ্য জবাব দিয়ে বিরোধী শিবির জানিয়ে দিয়েছে যে, দেশ একটি পরিবার যা ধ্বংস করছে মোদি সরকার, তাই দেশকে বাঁচাতেই এই উদ্যোগ। আসলে ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে বিজেপি’র ও নরেন্দ্র মোদির যে লড়াই এবার জোরদার হতে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিজেপি-কে হঠাতে না পারলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান, গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার রক্ষা করা যে সম্ভব নয় সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, “বিজেপি বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ করাই প্রধান লক্ষ্য। বিরোধী ভোট বিভাজনের সুফল যেন কোনওভাবেই বিজেপি পেয়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্যই বিরোধীদের মধ্যে সহযোগিতা জরুরি। তবে সেই সহযোগিতা বা সমন্বয় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বাস্তবতার নিরিখে গড়ে তুলতে হবে। কারণ রাজ্যে রাজ্যে বাস্তবতা আলাদা।” একথা বলতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, “দলগুলির সমন্বয় কেবল রাজ্যস্তরেই হতে পারে।’’ বিজেপি বিরোধী সমন্বয় সব রাজ্যে এক হবে না সেকথা আগেই উল্লেখ করেছিলেন ইয়েচুরি। সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিন্যাসও একরকম হবে না, তাও স্পষ্ট করে দেন তিনি। বেঙ্গালুরুতে বৈঠক শুরুর দিনই তিনি বলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস লড়বে বিজেপি এবং তৃণমূল - দু’য়ের বিরুদ্ধে। আবার কেরালায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন এলডিএফ। কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিরোধীরা বিজেপি-কে হঠাতে এককাট্টা।
অন্যদিকে কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ও সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধী ঐক্যের প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন যে, এটা নেতা নয়, নীতির লড়াই। এই জোট কোনো নির্বাচনী জোট নয়, ভারতের সমন্বয়ী সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বার্তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাই এই জোটের লক্ষ্য। আর সেপথে সবচেয়ে বড়ো বাধা আরএসএস পরিচালিত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, যারা এক ভাষা, এক ধর্ম, এক খাদ্যাভ্যাসকে জনগণের ওপর আরোপ করে ভারতীয় সভ্যতার মর্মবস্তুতে আঘাত হানছে। এই জোটের সভায় তৃণমূলের মতো দল হাজির হয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি আর অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। যে দল পশ্চিমবঙ্গে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নির্বিচারে হরণ করছে, লুঠ আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, যাদের নেত্রী কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল গড়েই বিজেপি’কে সাথে নিয়ে নির্বাচন লড়েছেন, দীর্ঘদিন এনডিএ-র অংশ ছিলেন, তিনি কতদিন এই জোটের অংশ থাকতে পারবেন তাতে সন্দেহ আছে। এই জোটের অন্যতম কর্মসূচি দেশজোড়া লুঠের বিরুদ্ধে লড়াই। তৃণমূলের মতো আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দলের পক্ষে এই লড়াইয়ের অংশ হওয়া সম্ভব নয়।
বিজেপি- বিরোধীদের রাজনৈতিক রণকৌশল ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হলেও সংঘ পরিবার নামক অক্টোপাসের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করতে তারা অভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তবে সবাই যে শেষ পর্যন্ত এক তরণীর যাত্রী থাকবেনই এমনটা যেমন এখনই বলা যায়না, তেমনই আরও কিছু দলের এই মঞ্চে শামিল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, দেশের মৌলিক কাঠামো রক্ষা এবং আম জনতার স্বার্থে যে মোদি সরকারের পতন জরুরি তা নিয়ে সংশয় ক্রমশ দূরীভূত হচ্ছে।
গত ন’বছরে মোদি সরকার শুধু আদানি-আম্বানিদের মতো করপোরেট মালিকদের স্বার্থ দেখেছে। এই সময়কালে বেকারি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। নোট বাতিল, লকডাউন এবং জিএসটি চাপিয়ে কোটি কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে মোদি সরকার।সাম্প্রদায়িক ও জাতিসত্তাগত বিভাজন ঘটিয়ে সামাজিক বুনট তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তার আমলেই সবচেয়ে বিপন্ন বোধ করছেন আদিবাসী, দলিত, মহিলা, সংখ্যালঘু সহ পিছিয়ে পড়া মানুষজন। দেশ মানে তো একটা মানচিত্র নয়, দেশ মানে দেশের মানুষ আর দীর্ঘকালের সংগ্রাম আর সংশ্লেষের ফলে অর্জিত ঐতিহ্য ও অধিকার। সেই সবকিছু রক্ষা করতেই তৈরি হয়েছে ‘‘ইন্ডিয়া’’ মঞ্চ। সংঘ পরিবার বনাম ভারতের এই লড়াইকে জয়যুক্ত করতে হবে।