৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০
বিভেদকামী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন দিল বিজেপি
অনন্ত রায় (মহারাজ)
পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার শূন্য পদে ভারতীয় জনতা পার্টি কোচবিহার জেলার দ্য গ্রেটার কোচবিহার পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশনের নেতা, স্বঘোষিত মহারাজ অনন্ত রায়কে মনোনীত করেছে। অনন্ত রায় (মহারাজ) নগেন্দ্র রায় নামে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। এই নামে কোচবিহারের মানুষ তাঁকে জানেন না। তিনি যখন এই সংগঠন করার কাজ শুরু করেন তখন গ্রামে-গ্রামে ঘুরে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষদের ডেকে সন্ধ্যের সময় কারো বাড়িতে বসতেন। প্রথম দিকে শিবচণ্ডী পূজার আয়োজন করে কীর্তনের আসর বসাতেন। কীর্তনের আসরে শিবচণ্ডীর নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হতো। রায় সাহেব পঞ্চাননকে নিয়ে ও তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে সেই আসরে আলোচনা করতেন এবং রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আবেগ তৈরি করতেন। তিনি ভণ্ড তপস্বীর মতো ধান্দার রাজনীতির স্বার্থে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কোচবিহারের রাজ পরিবারের নাম ব্যবহার করেন। কোচবিহারের মহারাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণের কোচবিহার রাজ্য ভারত ভুক্তির চুক্তির বিষয় নিয়ে কোচবিহারের সহজ সরল মানুষদের নগেন্দ্র রায় ওরফে অনন্ত মহারাজ বিভ্রান্ত করেন। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। কোচবিহার রাসমেলার মাঠে এক শীতের সকালে বিরাট জনসভায় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ওই সভায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্য সচিব সুকুমার সেন এবং কোচবিহারের তৎকালীন চিফ কমিশনার ভি আই নানজাপ্পা উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোচবিহারের মহারাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ প্রজাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশে নিম্নরূপ শুভেচ্ছা ও বিদায় বাণী ঘোষণা করেছিলেনঃ
‘‘On this solemn occasion which marks the end of ling and happy association, my mother and I send you our very best wishes, my beloved people.
Whenever we may be, we shall never forget you, your loyalty, and your devotion, we hope you will always maintain the peace, goodwill and harmony which has been our common heritage.
We shall always watch with keen interest your moral and material welfare and always pray for your happiness and prosperity.
May God Almighty bless you.
Jagaddipendra Narayan.
ভারত সরকার সমস্ত দিক বিচার বিবেচনা করেই কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু দ্য গ্রেটার কোচবিহার পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন সংগঠনটি কোচবিহারকে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত একটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করছে, তা সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন, ১৯৫৬ অনুযায়ী খারিজ হয়ে গেছে।
গ্রেটার কোচবিহারের দাবিওয়ালারা কোচবিহার রাজ্যের ভারত ভুক্তির চুক্তির বিষয়গুলি সংবিধানের ৩৬২ নং ধারায় উল্লেখ করা আছে বলে প্রচার করছে। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২৬তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশীয় রাজাদের রাজন্য ভাতা সহ সুখ-সুবিধা সম্মিলিত সংবিধানের ৩৬২ নং ধারাটি বাতিল করা হয়েছে। এটা তাদের ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। বিভেদকামী শক্তি কোচবিহার সহ উত্তরবঙ্গে উতজাস, আকসু, কেপিপি প্রভৃতি নাম দিয়ে বিভেদকামী আন্দোলন শুরু করে। রাজবংশী মানুষের মধ্যে ভাবাবেগ তৈরির উদ্দেশে ভাষার নামে এবং পরবর্তী সময়ে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিতে প্রচার সংগঠিত করে।
বাস্তবিক সত্য হলো যে, মানুষের ঐক্য সংহতি ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহৃত কামতাপুরী, গোর্খাল্যান্ড, গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের মাথাগুলি - অনন্ত মহারাজ, বংশী বদন, বিমল গুরুং, অতুল রায়, জীবন সিংহ সহ সকলেই আসলে দাবার ঘুঁটি।
অনন্ত রায়ের সামাজিক পরিচিতি সে অর্থে নেই। কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার গোসানীমারী এলাকায় তাঁর বাড়ি। একটা সময় তিনি আসামের একটি তেল কোম্পানিতে কাজ করতেন। জানা যায় যে, এই কাজে যোগদানেরও একটা গল্প আছে। ওই পদে কাজের জন্য অনন্তর নামের আরেকজনকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু ওই ব্যক্তি চাকরিতে যোগদানের খবর সময় মতো পাননি। এই সুযোগে অনন্ত রায় (নগেন্দ্র রায়) অন্যায়ভাবে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন সেখানে সে চাকুরি করেন। পরবর্তীতে যে অনন্ত রায় ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন চাকুরির জন্য এবং সিলেক্ট হয়েছিলেন সে তেল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, পরে অনন্ত রায় (নগেন্দ্র রায়)-এর চাকুরি বাতিল হয়। তাঁর নামে বেআইনিভাবে জমি দখল, বেআইনিভাবে অর্থ উপার্জন সহ একটি ধর্ষণের মামলা রুজু করা রয়েছে। তিনি কোচবিহারের রাজবাড়ির আদলে চকচকায় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি বিরাট অট্টালিকা তৈরি করেছেন। একটা সময় তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তিনি আসামে অনেকদিন গা ঢাকা দিয়ে পালিয়েছিলেন।
কোচবিহারের রাজবংশী মানুষের আবেগ কোচবিহারের বীর চিলা রায়, শুক্ল ধ্বজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাঁর জন্মজয়ন্তীকে সুকৌশলে ব্যবহার করে কোচবিহারের বানেশ্বর অঞ্চলের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের নিকটে মঞ্চ তৈরি করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আবার বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিককে একই মঞ্চে আমন্ত্রণ করে জমায়েত করেন। প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন, তিনি চলে গেলে নিশীথ প্রামাণিক উপস্থিত হন এবং তিনিও বক্তব্য রাখেন। এটা দ্বিচারিতার রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। নগেন্দ্র রায় (অনন্ত) একজন ভ্রষ্টাচারী ব্যক্তি ও ভোট ব্যবসায়ী। যখন তিনি আসামে গা ঢাকা দিয়ে থাকতেন,তখন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোচবিহারে এলে প্রথমে আসামে চলে যেতেন তাঁর সাথে দেখা করতে। আবার তৃণমূল দল তাঁর জন্মদিনে মুখ্যমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বার্তা নিয়ে জেলার তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষেরা নানা উপঢৌকন নিয়ে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হতেন। রাজবংশী ভোট কোন দলের পক্ষে থাকবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে না বিজেপি’র পক্ষে - এ নিয়ে দড়ি টানাটানি করে একজন ভ্রষ্টাচারী ব্যক্তিকে এরা ‘মহারাজ’ বানিয়ে তুলেছেন।
আমরা দেখেছি, তৃণমূল কংগ্রেস দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বংশী বদনকে ব্যবহার করে রাজবংশী বেকার যুবদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে নারায়ণী ব্যাটেলিয়ন গঠন করে চাকুরির ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রচার করেছে। আবার অনন্ত মহারাজ কোচবিহার আলাদা রাজ্য হবে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হবে - এই প্রচার করে আবেগ তৈরি করার অপচেষ্টা করেছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক ও অনন্ত মহারাজ কেন্দ্রের সরকার নারায়ণী সেনা গঠন করবে এবং এতে রাজবংশী ও তপশিলি জনজাতির যুবরা চাকুরি পাবেন - এই প্রচার করেছে। তবে এতে খুব একটা সুবিধা হবে না। আমরা অতীতে দেখেছি বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করার লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেস স্লোগান তুলেছিল যে - ‘উত্তরে কামতা-দক্ষিণে মমতা’। বিজেপি দল অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভার সাংসদ করার দিবা স্বপ্ন দেখছে এবং এর মধ্য দিয়ে সমস্ত রাজবংশীয়, তপশিলি মানুষের ভোটব্যাংক মজবুত করতে চাইছে। কিন্তু তা বাস্তবে সফল হবে না। কারণ যাকে তারা সাংসদ করার স্বপ্ন দেখছে, তিনি কোচবিহার তথা উত্তরবঙ্গের রাজবংশী মানুষের সকলের নেতা নন। তিনি একজন কুচক্রী, ভণ্ড তপস্বী ও ভোট ব্যবসায়ী। তিনি কখনো তৃণমূলের পাশে, আবার কখনো বিজেপি’র থেকে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করেছেন এবং এখনো করে চলেছেন। তাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নেই,অচিরেই তাঁর মুখোশ খুলে যাবে। আমরা কমিউনিস্টরা দীর্ঘদিন ধরে বিভেদকামী শক্তি ও সম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে চলেছি, আমরা সফল হবই। আমাদের মতাদর্শই সে পথ সুগম করবে।