E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০

ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান সন্ধিক্ষণে বামপন্থীদের ভূমিকা

সূর্য মিশ্র


[সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা কমিটি আয়োজিত প্রমোদ দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতার নির্বাচিত পরিমার্জিত অংশ]

ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান সন্ধিক্ষণে বামপন্থীদের ভূমিকা - এই আলোচ্য বিষয়টি তিনভাগে ভাগ করা যায়। এখানে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত নয়, বলা হয়েছে সন্ধিক্ষণ। বর্তমান সন্ধিক্ষণ কিসের, এই সন্ধিক্ষণ শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ। তারপর সন্ধিক্ষণে বামপন্থীদের ভূমিকা। ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হবে ভারতীয় রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিশেষ করে সিপিআই(এম)’র আন্তর্জাতিকতাবাদী ভূমিকার কথা। যখন চীনের পার্টির সঙ্গে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই, তখনও আমরা আন্তর্জাতিকতার পতাকা ছেড়ে দিইনি। এটা আমাদের চিরকাল গর্ব করবার মতো বিষয়। মতাদর্শগত বিতর্ক বজায় রেখেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিকতার প্রতি আমাদের আনুগত্য ছিল।

আন্তর্জাতিক বিষয়বস্তুতে খুব একটা যাব না। বর্তমান সন্ধিক্ষণ নিয়ে দু-একটা কথা বলতে হবে। বলতে হবে বামপন্থীদের ভূমিকা সম্পর্কে। সেটা বলা মুশকিল, তার কারণ বামপন্থী বলতে আমরা কী বুঝি এবং তাতে সমস্যা কী, সম্ভাবনা কী - দুটোই আমাদের বুঝতে হবে। সেখানে তাদের ভূমিকা, তাদের কাজ এবং এখন এই সন্ধিক্ষণে আমাদের কাজ, বামপন্থীদের কাজ - এই সবটা বুঝতে হবে।

প্রথমে, বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কেন এটা একটা সন্ধিক্ষণ। বিশ্ব রাজনীতি আর স্থানীয় রাজনীতিকে মার্কসবাদীরা আলাদা করে দেখে না। রাজনীতি মানে অর্থনীতি, রাজনীতি মানে দর্শন, রাজনীতি মানে সংগ্রাম, রাজনীতি মানে সংগঠন - এই সবটা। চারটে কথা আমরা সাধারণত বলে থাকি, বারবার বলি, বারংবার বলি। ১) মতাদর্শ, ২) রাজনীতি, ৩) সংগ্রাম, ৪) সংগঠন। এই চারটিকে বাদ দিয়ে কোনো বিষয়, পরিস্থিতি, প্রেক্ষিত এখনকার চ্যালেঞ্জ বা এই সন্ধিক্ষণ সেটা বোঝার চেষ্টা করা ঠিক না।

মার্কসের ফয়েরবাখ সম্পর্কে থিসিস- তার মধ্যে যে বাক্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, বহু উচ্চারিত সেটা হলো ‘ফিলজফারস হ্যাভ ইন্টারপ্রিটেড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ভেরিয়াস ওয়েস; দ্য পয়েন্ট, হাউএভার ইজ টু চেঞ্জ ইট’। অর্থাৎ দার্শনিকরা নানাভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে মার্কসের অবদান কী?’ অর্থাৎ বিষয়টা হচ্ছে এই, বদলাতে হবে এই পরিস্থিতিটা। পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্যই মার্কসবাদের মতাদর্শ। মার্কসবাদের মতাদর্শ মানে হচ্ছে মার্কস-এঙ্গেলস দুজনের, এদের আলাদা করা যায় না। আমরা বলছি অবিচ্ছেদ্য। যারা এই দু’জনের পার্থক্যের কথা বলতেন লেনিন তাঁদের বলতেন, এসবে যেও না। পৃথিবীর ইতিহাস দেখ, যত যা পুরাণ আছে খুঁজে ফেলো, দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের এরকম একটা দৃষ্টান্ত নেই। মার্কসবাদ এঙ্গেলসকে বাদ দিয়ে নয়। আমরা যখন বলি, তখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বলি। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি যেমন বলেছিল, ‘সাম্রাজ্যবাদের যুগের মার্কসবাদ হলো লেনিনবাদ’, - আমরা তা বলি না। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে লেনিন যা লিখেছেন, তা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা দেখেছেন মার্কসকে বাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের যুগের ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু লেনিন এই যুগের ব্যাখ্যা করেছিলেন পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর হিসাবে এবং তিনি এর ভিত্তিতেই রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমরা সেইজন্য ‘মার্কসবাদ লেনিনবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করি।

রাজনীতি যখন আমরা আলোচনা করি তখন মৌলিক বিষয়গুলো আমরা বাদ দিতে পারি না। সাধারণভাবে আমাদের বোঝাপড়ায় ভারতীয় রাজনীতি বুঝতে হবে বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান যে প্রেক্ষাপট সেই সামগ্রিকতার বিচারে। এটা একটা সন্ধিক্ষণ এই কারণে বলা হচ্ছে যে, বিশ্ব রাজনীতিতে বর্তমান অর্থনীতি যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেখানে কোনও দেশ বাদ নেই। খোদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও সংকট নেমে এসেছে। আমরা বলতে পারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদ যেটা সাম্রাজ্যবাদের সবচাইতে স্বৈরাচারী রূপ, এখন তার পুনরুত্থান ঘটেছে। সেই পুনরুত্থান আগেকার মতো ওই তিনটে বা চারটে দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সবাই জানে ফ্যাসিবাদ শব্দটা এসেছিল ইতালি থেকে। এই শব্দবন্ধ যারা ব্যবহার করেছিলেন, মুসোলিনি তার অন্যতম নায়ক। জুলিয়াস ইভোলা ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা ছিলেন। তিনি পরে ইতালি ও জার্মান ফ্যাসিবাদকে যথেষ্ট মনে করেন নি। তাঁকে সেইজন্য এখনকার নয়া ফ্যাসিবাদের জনক বলে অনেকে চিহ্নিত করেছেন।

ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, নাৎসি বা ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি তৈরি হবার আগেই ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়। হিটলারের যখন উত্থান হচ্ছে তখন মুসোলিনি এবং ফ্যাসিবাদের পড়ন্ত বেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তিতে ইতালি জার্মানি ছাড়া জাপান ছিল। জাপান যদিও এই ফর্মুলায় পড়ে না, কিন্তু স্পেনে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল সেটা মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের মতো একটা দেশ যেখানে ‘ম্যাজিনো লাইন’ বলে একটা দুর্ভেদ্য সামরিক লাইন ছিল, ওরা বলতো হিটলার এই লাইন ভাঙতে পারবে না। আর সেই ‘ম্যাজিনো লাইন’ ফ্যাসিস্টরা আক্রমণের ৭ দিনের মধ্যে ভেঙে দেয়। তার একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে, ফ্রান্সের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ফ্যাসিবাদের সমর্থক একদল লোক যারা ফ্রান্সের প্যারিস শহরের পতনের পর সেখানে ক্ষমতা দখল করেছিল হিটলারের আনুকূল্যে।

তখনকার এবং এখনকার এইসব প্রেক্ষাপট যদি আপনি বিচার করেন তাহলে একটা বড়ো পার্থক্য হচ্ছে এই যে, এখন এটা আরও বিস্তৃত। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে এখন সবটা আপনি মেলাতে পারবেন না। যার জন্য নয়া ফ্যাসিবাদ, নিও ফ্যাসিজম ইত্যাদি শব্দবন্ধ চালু হয়েছে, কারণ এটা ইয়োরোপ জুড়ে প্রায় সব জায়গায় অনেক বেশি বিস্তৃত। এটা এখন কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তুরস্কের এরদোগান, ব্রাজিলের বোলসোনারো, ভারতে মোদি এই দেশগুলিকে তো সাম্রাজ্যবাদী দেশ বলতে পারি না। সবগুলি যে সাম্রাজ্যবাদী দেশ হবে সেরকম নয় এখন। এটা কোনো অংশে কম আগ্রাসী নয়। নয়া ফ্যাসিবাদের নতুন চরিত্র যদি কেউ বুঝতে চায় তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। সব জায়গায় ধর্ম-কর্ম দিয়ে আর হচ্ছে না। তখনকার ফ্যাসিবাদের সঙ্গে চার্চের বিরোধ ছিল, যা ওরা মিটিয়ে নিয়েছিল। তাতে বিশাল কিছু সমাধান হয়নি। ইগোলা বলতেন, তিনি এসব ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যে নেই। বিভিন্ন জায়গায় ওর লেখা বই দেখলে দেখা যায় অনেক জায়গায় ওর নাম জুলিয়াস সিজার ইভোলা অর্থাৎ ওর কাছে হিরো হচ্ছে সিজার। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্বের ব্যাপার। দিমিত্রভ থিসিস, সপ্তম কংগ্রেস ইত্যাদি যখন হয়েছিল তখন আন্তর্জাতিকের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ছিল, পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির কাজ হচ্ছে সেই দেশের ফ্যাসিবাদের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করা এবং তার মোকাবিলার কৌশল কী হবে সেটা ঠিক করা। সব পার্টিই সেটা করেছিল। আমাদের ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বিতর্কের পরে ‘দত্ত-ব্র্যাডলি থিসিস’ গৃহীত হয়। তখন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিজিবি) পরিস্থিতির মূল্যায়নের সমাধান করতে সাহায্য করেছে আমাদের।

চীনের পার্টির চৌ এন লাই তাদেরও একটা মূল্যায়ন ছিল। ওখানে তখন চিয়াঙ কাই শেকের সরকার চলছিল, আর একদিকে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন। কমিউনিস্টদের চিয়াঙ কাই শেক এবং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। তার আগে ও পরে চিয়াঙ কাই শেক-এর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং কমিউনিস্টরা কি অবস্থান নেবে সে সম্পর্কে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন রয়েছে।

সুতরাং, ভারতের বর্তমান ফ্যাসিবাদের চরিত্র কী তা বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব আমাদের। তা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। আমি সেখান থেকে তিন-চারটে কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। ভারত থেকে প্রথম যিনি মুসোলিনির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, ওখানে গিয়ে ব্ল্যাক শার্ট বাহিনীর ট্রেনিং ইত্যাদি যিনি দেখেছেন তিনি হচ্ছেন বি এস মুঞ্জে। আরএসএস তখন তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু দেশে ফিরে তাদের ট্রেনিংয়ের পথপ্রদর্শক হন মুঞ্জে। পরে হিটলারের উত্থান হতেই আরএসএস হিটলারের পথ ধরে। অর্থাৎ এখানে ফ্যাসিবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ওই সময় থেকে (১৯২৫ সালে আরএসএস’র প্রতিষ্ঠা) আরএসএস-কে সেইভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয় যা এখনো চালু আছে।

দুই, ভারতের মতো একটা এত জাতি, এত ভাষার একটা দেশে সংস্কৃতির মধ্যে নানা পার্থক্য সবকিছু নিয়ে (ইংরেজিতে এখন যাকে প্লুরিন্যাশনাল বলে) এতরকম বৈচিত্রের সমাবেশ। এটা ইতালি বা জার্মানি নয়। আর যেসব দেশগুলোতে নয়া ফ্যাসিবাদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তার তুলনায় ভারতের বৈশিষ্ট্য আলাদা।

এখন বিজেপি দক্ষিণে যেতে পারছে না। বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক হাতছাড়া হয়ে গেছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে গিয়ে ‘আর্যরা প্রথম এসেছিল’ এসব বললে সুবিধে হবে না। কারণ আফ্রিকা থেকে দ্রাবিড়রা প্রথম এসেছিল এটা প্রমাণিত। সেখান থেকে আন্দামান অবধি তারা পৌঁছে যায়। তখন সমুদ্রপথে হাঁটাও যেত তা এখনকার যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে তার মধ্যদিয়ে আমরা জানি। কিন্তু কি করে তাহলে কর্নাটকে করতে পারলো আর কি করেই বা পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা রাজ্যে বিজেপি এটা করতে পারল! আমাদের সময়ে যে বিজেপি’র প্রায় একটাও এমএলএ থাকত না, তারা এখন এখানে প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। এসম্পর্কে জ্যোতি বসু বলতেন, ‘মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বড়ো অপরাধ তিনি বিজেপি-কে এই রাজ্যে নিয়ে এসেছেন’।

২০১১ সালে বিধানসভায় আমরা ১০০টা সিটের ধারে কাছেও যেতে পারি নি। ২০১৩ সালে যখন পঞ্চায়েতের নির্বাচন হলো তখন দুটো জেলা পরিষদে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলাম, যা পরে জোর করে দখল করল তৃণমূল। ২০১৪ সালে মোদি সরকার এলো। ২০১৪-পরবর্তী সবগুলি ভোটের তুলনায় এবারের ২০২৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে যত রকম আক্রমণ সন্ত্রাস হোক না কেন, ফলাফল বিশ্লেষণের মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি, যে পরিমাণ আসন, সমর্থন, ভোটের শতাংশ ইত্যাদি বেড়েছে, তা এই সময়ে একটা রেকর্ড। আমাদের সাফল্যগুলো ছোটো করে দেখলে আমাদের দুর্বলতাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন না। এই পর্বে আমাদের শক্তি সংহত করতে সময় লাগছিল।

ভারতে এখনও উচ্চবর্ণ বা ব্রাহ্মণ এসব বিষয় একাংশের মানুষের মনের ভেতরে একটা সুড়সুড়ি দেয়। যা আমাদের অনেকেই ছাড়তে পারছেন না। পরিস্থিতি অনুযায়ী এখানে নিও ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য হলো, আরএসএস এখন লাইন বদলাচ্ছে। মোহন ভাগবত মাস দু’য়েক আগে বললেন, জাতি ধর্মগত পশ্চাৎপদ যাঁরা, তাঁদের সম্পর্কে পন্ডিতেরা যা লিখেছিলেন সেটা ঠিক নয়। এর ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করা যায় না ইত্যাদি। ভুল লিখেছিলেন সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু উৎসটা কোথায়। গীতায় অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘চতুর্বর্ণ ম্বয়া সৃষ্ট’। অর্থাৎ চতুর্বর্ণ আমি সৃষ্টি করেছি। কিন্তু আপনাকে এখন বলতে হবে, শ্রীকৃষ্ণ গীতা বা গীতা যিনি লিখেছেন বা তার আগে মনু- এসব এদের মধ্যে দৃঢ়ভাবেই আছে, এরা এখন কায়দা করছে। যাকে আমরা গত লোকসভা নির্বাচনের সময় ‘মাইক্রো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলেছিলাম, যে প্রযুক্তি এখন মণিপুর এবং জঙ্গলমহলে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে মত, মন আদান-প্রদান না করলে, বিতর্ক ইত্যাদি না করলে মুশকিল আছে। এটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ, খেয়াল রাখতে হবে।

২০১১ পরবর্তী সময়ে ওঁদের আক্রমণ বাড়ছিল আর আমাদের ভোট কমছিল। ২০১৪ সালে রাজ্যে কংগ্রেস বেরিয়ে গেল তৃণমূলের সরকার থেকে এবং তারপর ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করলাম। তার আগে ২০১৪ সালে আমাদের দু’জন সাংসদ ছিলেন আর তারপর ২০১৬ সাল থেকে আমাদের সমর্থন কমছিল। কিন্তু গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে কমতে কমতে যেখানে গিয়ে দাঁড়ালো সেইখান থেকে আবার ২০২৩-র ভোটে উত্থান। তৃণমূল চায় যে কোনোভাবে বিজেপি’কে দ্বিতীয় দল হিসেবে বিধানসভা সহ এখানে রাখতে হবে। বিজেপি-ও চায়, তৃণমূলকে লোকসভার আসনের হিসেবে এখানে দ্বিতীয় দল থাকুক। কে কাকে কতগুলো পার্লামেন্টের সিট ছাড়বে সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাগপুরে ঠিক হবে। এই বিষয়গুলি হচ্ছে বিশেষ চরিত্র বা বিশেষ সমস্যা, যা ফ্যাসিবাদ এবং নয়া ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যা লেখা হচ্ছে তার থেকে ভিন্ন।

সংঘ পরিবারের সদস্য কারা তা আপনি জানতে পারবেন না, কোনও লিস্ট দিতে পারবেন না। ওদের তহবিলের উৎস কী তা পাওয়া যায় না। ওদের এসব দরকার নেই! সংঘ পরিবারের অনেকগুলি সংগঠনের মধ্যে একটা হচ্ছে বিজেপি। এদের যতগুলো গণসংগঠন আছে, তারা কেউ বিজেপি’র নয়, সব আরএসএস’র সদস্য ও সংগঠন। হিটলার মুসোলিনি বা ট্রাম্প - কোনও মডেল দিয়ে এই হিসেব আপনি মেলাতে পারবেন না।

যুক্ত সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি অংশগ্রহণ করে শ্রেণি ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য। তা কতখানি হচ্ছে সেটা বোঝার দরকার আছে, কারণ এর মোকাবিলা আমাদের সামনে সবচেয়ে বডড়ো মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ। মতাদর্শের লড়াই মস্তিকের লড়াই, গায়ের জোরের নয়। তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনী আছে এদের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে লড়াই করাটা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। বিজেপি ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণাগুলি ফিরিয়ে আনছে, দেশের পুরো ইতিহাসটাকে বদলে দিচ্ছে। আবার আমাদের কারও কারও মগজে, মনে সংখ্যালঘু, তপশিলি জাতি,উপজাতি, আদিবাসী, ওবিসি, যারা রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব আছে। পার্টি নেতাদের ব্যক্তিগত আচরণ, জীবনচর্যা কেমন, মহিলাদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, বিজেপি-আরএসএস থেকে কিভাবে ভিন্ন, এগুলো দেখতে হবে। এটা হচ্ছে রোজকার জীবনে, পরিবারে, ঘরে চ্যালেঞ্জ। মানসিক পশ্চাৎপদতা যদি আপনি মন থেকে তাড়াতে না পারেন তাহলে আপনি বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন না। আর তা না পারলে তার ফায়দা নেবে তৃণমূল। তাই আমাদের কথা মানুষকে বারবার বলতে হবে, তাঁদের কথা শুনতে হবে, বিরোধীদের কথাও শুনতে হবে।

কোঝিকোড়ে পার্টির ২০তম কংগ্রেসে আমাদের মতাদর্শগত দলিল যেটা গ্রহণ করেছি সেটা পড়তে হবে, আত্মস্থ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র, মানবজাতির অস্ত্বিত্বের সংকট, পরিবেশের সংকট ইত্যদির বিরুদ্ধে একবিংশ শতাব্দির সমাজতান্ত্রিক পথনির্দেশ রয়েছে ওই দলিলে। পরিবেশের প্রশ্নে আপনি আগামীদিনে পানীয় জল একফোঁটা পাবেন কি পাবেন না, এমনকী মানবজাতির অস্তিত্ব থাকবে কিনা এসবই আমাদের লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ। সেই জন্যই এটা সন্ধিক্ষণ। ভারত সম্পর্কে ধারণা থেকে স্বাধীনতার যেটুকু সুফল আমরা পেয়েছিলাম তা সব ভেঙে গেছে। আর এক বছরের কম সময় বাকি আছে। যদি মোদি এবারে নির্বাচনে ফিরে আসে তাহলে ভারত, বাংলা বলে যা জানি সেটা থাকবে না। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির সন্ধিক্ষণে এটাই চ্যালেঞ্জ।

পার্টি যারা করেন তারা তো জানেন কি করতে হবে। ২৩তম পার্টি কংগ্রেস তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। সারাদেশে বিজেপি’কে বিচ্ছিন্ন করো এবং পরাস্ত করো। বিচ্ছিন্ন করো মানে ওদের ডানদিকে বাঁদিকে যারা আছে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে আনো। ওদের মধ্যে ন্যূনতম বিরোধকে ব্যবহার করো। এইটা করতে গেলে সারা ভারতে যেখানে যার শক্তি আছে তাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। আমাদের এখানে লড়াই খুব পরিষ্কার, তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধে বাকি সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এদের এখান থেকে পরাস্ত করতে হবে। বৃহত্তম মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। ফ্যাসিবাদ যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন ছুতমার্গ করে কিছু হবে না। সারাদেশে একরকম বোঝাপড়া হবে না। রাজ্যে রাজ্যে আলাদা হবে। কেরালায় কি কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া হতে পারে? কখনো হবে না। কেরালায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আমরা লড়ব। পশ্চিমবাংলায় অন্যরকম। একটা ফর্মুলা সারা দেশের জন্য করা যায় না। আমরা সারা দেশে বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। বামদল কিন্তু বামফ্রন্টের অন্তর্গত নয় এদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। এটা আমাদের লাইন, চিরকালের লাইন।

এখানে ঐক্যবদ্ধভাবে পঞ্চায়েতেও কিছু লড়াই হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়েছে। আইএসএফ’র সঙ্গে বোঝাপড়া হয়েছে।

এই ব্যাপকতম সমাবেশ ও ঐক্যবদ্ধ করার যে লাইন আমাদের আছে তা আয়ত্ত করতে হবে এবং মাঠে প্রয়োগ করতে হবে। অনেক মানুষ আছেন যারা কোনো পার্টি করেন না, বাইরে আছেন। এমনকী তৃণমূল বিজেপি’র সমর্থকদের মধ্যে অনেক সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ আছেন। আপনি কি ভাবছেন তৃণমূল যারা করে তারা সবাই তৃণমূলের এসব ব্যাপারকে সমর্থন করছে? ওদের প্রার্থী কান্নাকাটি করে বলছে পঞ্চায়েত ভোটে আমি এইভাবে জিততে চাইনি! আপনি কি বলবেন নাটক করছে? আপনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাকে সমান বলবেন?

কমরেড বিনয় চৌধুরী আমাদের দশম কংগ্রেসের বোঝাপড়া থেকে বারবার বলতেন, একটা বুর্জোয়া পার্টি তার সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, রাজ্য নেতৃত্ব, জেলা নেতৃত্ব এবং স্থানীয় নেতৃত্ব - এদেরকে একভাবে দেখা যায় না এবং তাদের সাধারণ সমর্থক তাদেরও একভাবে দেখা যায় না। তৃণমূল বিজেপি’র সমর্থন যে বাড়লো সেগুলো কোথা থেকে এলো? তারা আমাদের সমর্থক ছিলেন। তারা ওখানে গেছেন এটা ভুলবেন না কখনো। আগে আমাদের নিজস্ব শক্তিকে সংহত করো, তারপরে দোদুল্যমান শক্তিকে টেনে আনো, তারপর শত্রু শিবির ভাঙতে পারো কিনা দেখো। অনেক লোক আছেন দোদুল্যমান। এটা বোঝার পর সেই লোককে কেন টানতে পারছি না?

এবার সংগ্রামের বিষয়। সংগ্রাম হচ্ছে যুক্ত সংগ্রাম যা আমরা করি। বামপন্থা বলতে আমরা জলন্ধর কংগ্রেসে যে জায়গায় পৌঁছেছি তা হলো বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বলে যে ধারণাটা সেটা জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলবার যে আমাদের কর্মসূচি আছে সেই লক্ষ্যে এগোনোর একটা অন্তর্বর্তী পর্যায়। বিপ্লবের জন্য কৌশলগত নির্যাস হচ্ছে রণনীতি বিপ্লবের স্তর পর্যন্ত যা বদলায় না। কর্মসূচি আমরা সময়োপযোগী করেছি কিন্তু নীতি বলতে যা বোঝায় সেটা বদলাই নি। বিপ্লবের স্তর কী, জনগণতান্ত্রিক কী, তাদের কাজ কী, তার মিত্র হবে কারা, কারা দোদুল্যমান মিত্র হবে, কে স্থায়ী মিত্র হবে, এসব বলা আছে দলিলে। রণকৌশল হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে যা করতে হবে। বাম বলতে কী বোঝায় তার তিনটে মাপকাঠির কথা বলা হয়েছে, ১) সে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, ২) সে সামন্ততন্ত্র বিরোধী ৩) সে একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে। আমরা যেটা বৃহৎ পুঁজি বলি। গণতান্ত্রিক কথাটা বলা আছে কারণ এইসব ছেড়ে দিলেও আরও কিছু শক্তি আছে। এই কথাটার মানে আরও কিছু লোক আছে, তাদের আমরা কিভাবে নিয়ে আসতে পারি। যুক্ত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে নিয়ে আসতে পারি। এই স্লোগান থেকে আমরা সরিনি।

নির্বাচন রাজনৈতিক সংগ্রাম। নিরন্তর গণসংগ্রাম ও শ্রেণিসংগ্রামে জনজীবনের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলিতে ব্যাপকতম মানুষের সমাবেশ না ঘটলে রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় না। সংগ্রাম ও সংগঠনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পার্টি সংগঠন সংগ্রামের মধ্যদিয়েই শক্তিশালী হয়। এগুলি হলো মতাদর্শ ও রাজনীতি প্রয়োগের প্রধান হাতিয়ার। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তা এক্ষেত্রে নতুন নতুন সম্ভাবনার সূচক। আমাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে, এগুলির ওপর ভিত্তি করে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে এবং আসন্ন লোকসভার নির্বাচনে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারব। এই সব কিছুই নির্ভর করে আমাদের পার্টির নিজস্ব মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সমস্ত ফ্রন্টে স্বাধীন সংগ্রাম ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর।