৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০
এবারের লড়াই, আগামীর প্রেরণা
অমিয় পাত্র
পঞ্চায়েত ভোটের দিন সন্ত্রাস ও ভোট লুটের প্রতিবাদে বারাসতে বামফ্রন্টের মিছিল।
পঞ্চায়েতের পরম্পরা
ভারতীয় উপমহাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পাঁচ জনের (গ্রামস্থ পঞ্চজন) পরিষদ বা কমিটি গঠনের রেওয়াজ ছিল। গ্রামের সাধারণ সভা থেকে প্রবীণ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই পাঁচ জনের পরিষদে দায়িত্ব দেওয়া হতো। একজন মোড়ল বা মুখিয়ার নিদান অপেক্ষা পাঁচজনের সমষ্টিগত সিদ্ধান্তকেই অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক মনে করা হতো। এই পঞ্চজনের কাজ ছিল স্বেচ্ছামূলক এবং সমাজসেবার কাজের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। এই পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়ায় কারচুপির অভিযোগ ছিল না। গ্রাম্যসভায় শামিল জনগণ ধ্বনি ভোটে বা হাত তুলে তাদের সম্মতি ব্যক্ত করতেন। এটাও এক ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি। এই প্রথা থেকেই সরপঞ্চ বা পঞ্চায়েত শব্দটার উৎপত্তি। সামন্তযুগে বা তার পরবর্তীতে সমাজে আধিপত্যকারী শ্রেণি ছিল জমিদার, মহাজন বা ধনী কৃষক। স্বভাবতই সেযুগে গ্রামের গরিব, মহিলা বা নিম্নবর্গের মানুষের নাম এই পঞ্চজনের তালিকায় ভাবা যেত না। পঞ্চায়েত বর্তমানে লুঠপাট ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। সেকারণেই নির্বাচন প্রক্রিয়া কলুষিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের আগে পর্যন্ত চারস্তরীয় পঞ্চায়েতে বা তৎপূর্বের ইউনিয়ন বোর্ড ব্যবস্থায় মহিলা, গ্রামের গরিব এবং তপশিলি জাতি, আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল নামমাত্র। সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণ ছাড়া পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সফল হতে পারে না - এই বিশ্বাস নিয়েই ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার পথ চলা শুরু হয়। সঠিক দিশায় রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অগ্রসর হচ্ছিল। দেশ বিদেশের বহু সরকার বিশেষত গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের মধ্যদিয়ে বাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশে চালু হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, গত এক দশকে বাংলার পঞ্চায়েত লুঠের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কেবলমাত্র দুর্নীতির কারণে একটার পর একটা কেন্দ্রীয় প্রকল্প বন্ধ হয়েছে। বাম জমানার পঞ্চায়েতের সেই খ্যাতি, সেই গৌরব, সেই সাফল্য এখন অতীত।
২০২৩: বিতর্কিত পঞ্চায়েত নির্বাচন
কার্যভার গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার রাজ্যে দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা করেন। ৯ জুন থেকে মনোনয়ন পর্ব শুরু হয়। ১১ জুলাই ভোট গণনার দিন পর্যন্ত রাজ্যে এক অসম লড়াই প্রত্যক্ষ করল বাংলার জনগণ। একদিকে রাজ্য সরকার, রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশ, সমাজবিরোধী, মিডিয়ার সিংহভাগ এবং বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রভাব; অন্যদিকে এই সরকারের অত্যাচার অপশাসন ও সীমাহীন দুর্নীতির প্রতিবাদে জাগ্রত জনগণের এক অসম লড়াই। এ লড়াই ছিল স্মরণাতীত কালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গ্রামে গ্রামে মানুষের প্রতিবাদী, প্রতিরোধী ভূমিকা শাসকের উদ্বেগের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। চুরিতে হাত পাকানো শাসকদল আগামী পাঁচ বছর লুটপাটের অধিকার কায়েম রাখতে সব ধরনের অসদুপায় গ্রহণের পাশাপাশি ভোট চুরি করে পরিত্রাণ পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের এরূপ কু-নজির ভূ-ভারতে আগে কখনও দেখা যায়নি। নির্বাচনে কে জয়ী হবে, কীভাবে জয়ী হবে সেটা জনগণ নয়, শাসক ঠিক করবে - এটাই ছিল এই নির্বাচনের মূল কথা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তৃণমূল কংগ্রেস দল এই নির্বাচনে সব ধরনের অসদুপায় অবলম্বন করতে পুলিশ, আমলা সহ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত বেশিরভাগ কর্মী ও আধিকারিকদের শামিল করেছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই জল মাপার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। সাগরদিঘি নির্বাচনের পর শাসকের উপর চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ৮ জুলাই নির্বাচনের দিন স্থির হয় এবং জালিয়াতি ও কারচুপির মাধ্যমে জনমতের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। নির্বাচনের যে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে তা আদৌ জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন নয়। এই ফলাফল থেকেও এটা স্পষ্ট যে, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র প্রতি মানুষের সমর্থন কমেছে, বামপন্থী ও সহযোগীদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ বেড়েছে। এ কৃতিত্বের দাবিদার গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ। রাজ্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, এই ঘোষণা করলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এই বিতর্কিত নির্বাচনের নানান অভিযোগ এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে পরিবর্তন ঘটে গেছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের। তৃণমূল কংগ্রেস দিশাহীন একটা দল যার নীতি বা আদর্শগত কোনো ভিত্তি নেই। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই লুঠ, জরিমানা আদায়, জীবন জীবিকার উপর জুলুমবাজির ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের একটা অংশ ছিল এলাকার চিহ্নিত গুন্ডা ও সমাজবিরোধী। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ঠিকাদার, প্রমোটার, মাফিয়া ও অসৎ ব্যবসায়ী। বাম আমলে অবদমিত থাকা নব্যধনীরা এই সুযোগে গ্রামাঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেস দলের কর্ণধারে পরিণত হয়। শুরু হয় সর্বত্র সরকারি প্রকল্পের অর্থে ব্যাপক দুর্নীতি। দল ও সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের মদতেই এই দুর্নীতির রমরমা চলছে। দল পরিচালনায় ও নির্বাচনে ব্যয়িত বিপুল অর্থের উৎস এই দুর্নীতি। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দেখা গেল যাদের জোগান দেওয়া অর্থে দল চলছে, সেই সমস্ত ঠিকাদার, প্রমোটার, মাফিয়া, সুপারভাইজার এবং নব্য ধনীরা নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্বে রয়েছেন। ক্ষমতা ধরে রাখার সঙ্গে এদের উপার্জনের বিষয়টি সরাসরি যুক্ত। ফলে নির্বাচনে জয়ের জন্য যা করণীয় সে সব পন্থা ও পদক্ষেপ এরা অবলম্বন করেছে। বলাই বাহুল্য পুলিশ ও প্রশাসন সঙ্গে থাকলে হিংসা, বুধ দখল, ছাপ্পা ভোট, গণনায় কারচুপি - কোনো কাজই অসম্ভব নয়। এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না, কেন এরা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিলেন।
টার্গেট শ্রেণির মানুষ
সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল শ্রমজীবীদের ঐক্যকে দুর্বল করা এবং তাদের বিভ্রান্ত করে দলীয় ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করা। নির্বাচনের প্রচার পর্বে দেখা গেছে প্রায় প্রতিটি গরিবের পাড়া তাদের টার্গেট। এখানেই লালঝান্ডার পাশাপাশি অন্য দলগুলির দেওয়াল লিখন, পোস্টারিং, পতাকা ও ফেস্টুন টাঙানোর তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রায় প্রতিটি দেওয়ালে একাধিক দলের প্রার্থীর নাম ও প্রতীক আঁকার হিড়িক দেখা গেছে। জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় এবং পরিচিতিকে ভিত্তি করে বিভাজনের রাজনীতি ছাড়াও ভীতি প্রদর্শন ও নানা প্রলোভনের প্রতিশ্রুতি ফেরি করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের উপভোক্তা হিসাবে নগদ টাকা পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই ভোটারদের জন্য বলা হয়েছে - ‘ভোট দিলে আর পাবে, না দিলে এটাও যাবে’। শ্রেণির মানুষকে ভোটার হিসেবে দেখার প্রক্রিয়া আগেই শুরু হয়েছিল, এবার শুরু হলো ভোটারকে ভোক্তায় পরিণত করার চেষ্টা। নির্বাচনের ৩-৪ দিন আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় ভোজের ব্যবস্থা করা এবং নগদ টাকার বিনিময়ে ভোট কেনার ব্যবস্থা ছিল শাসকের নয়া কৌশল। এছাড়াও কম বয়সি ছেলেদের ক্লাবঘর নির্মাণ ও রঙিন টিভি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার উপর যে আঘাত এসেছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ঘটেছে, বালি, কয়লা, গোরু পাচারের ঘটনা বা বিভিন্ন প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনা যেভাবে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত অংশকে ভাবিয়ে তুলেছে গরিব অংশের মধ্যে এই ইসুগুলি সেভাবে নাড়া দিতে পারেনি। তাই তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মতো দলগুলি তাদের ভোট বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই অংশকেই বেছে নিয়েছে। একটা সময় খাদ্য, কাজ, মজুরি, জমি, পানীয় জল ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে যে শ্রেণিঐক্য গড়ে উঠেছিল তা ক্রমাগত দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। নির্বাচনেও তার কিছুটা প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শোষকের প্রতি ক্রোধ বা ঘৃণার প্রকাশ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিরোধের লড়াই আগামীর দিক্নির্দেশ
এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামগঞ্জের লড়াকু মানুষ সম্ভাব্য সব বাধা চূর্ণ করে আগামী সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছেন। এ লড়াই জনসমক্ষে স্পষ্ট করেছে, রাজ্যে নিরপেক্ষ প্রশাসন বলে কিছু নেই। রাজ্যের মানুষের নিরাপত্তা, মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার সমূহ এ জমানায় বিপন্ন। ন্যায় ও সুরক্ষার জন্য মানুষ আদালতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সুস্থ ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন কোনো মানুষ এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারেন না। হিংসা, ছাপ্পাভোট, গণনার নামে প্রহসন এবং তার পরবর্তীতে উন্মোচিত তথ্য শাসকদল ও নির্বাচন কমিশনকে বে-আব্রু করে দিয়েছে। প্রতিরোধী মানুষের সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিতেই এই সত্য জনসমক্ষে এসেছে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এই সংগ্রামকে প্রসারিত করাই আমাদের প্রধান কাজ। প্রতিটি পদক্ষেপ লড়াই করেই অগ্রসর হতে হবে। লড়াই হবে - কাজের জন্য, মজুরির জন্য, শিক্ষা স্বাস্থ্যের অধিকার অর্জনের জন্য, টিকে থাকার জন্য, নিরাপত্তার জন্য, নায্য পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য, এই ক্লেদাক্ত সমাজকে বাসযোগ্য করার জন্য। লড়াই হবে বিরামহীন।