৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০
চাকা ঘুরতে শুরু করেছে
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী
তারকেশ্বরের কেশবচক গ্রামে সিপিআই(এম)’র বিজয় মিছিল।
রাষ্ট্রীয় ভোট লুঠের বিরুদ্ধে জনগণের এক গৌরবোজ্জ্বল লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে থাকল এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন। মিডিয়া, ভাড়াটে গুন্ডা, এসব তো ছিলই, সরকারি আধিকারিক, আমলা, পুলিশ, কেন্দ্রীয়বাহিনী সবাই একজোট হয়েছিল এটা নিশ্চিত করতে যে, এ রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেন কিছুতেই জনগণের মনোভাব প্রতিফলিত না হয়। একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় এরাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। তাই এখন আদালতে আমলা, পুলিশের আধিকারিক, নির্বাচন কমিশনের ডাক পড়ছে। যদিও এই ঘটনা আমাদের রাজনীতির সিলেবাসের বাইরে নয়। আমাদের পার্টি কর্মসূচিগত বোঝাপড়াটা হলো এরকম - ‘‘বুর্জোয়া-জমিদার শাসনে পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রক্ষমতার সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় ঘটেছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের ওপর যা ধনতান্ত্রিক বিকাশের প্রতিফলন। এর ফলে ক্ষমতা উপরতলায় কেন্দ্রীভূত এবং সুবিধাভোগী আমলাদের মাধ্যমে তা প্রয়োগ হয়। এরা জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং শোষকশ্রেণির স্বার্থের অনুগত সেবক। আমলাতন্ত্রের বিপুল আয়তনপ্রাপ্তি, শাসকশ্রেণিগুলির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং আমলাতন্ত্রের অবাধ দুর্নীতি সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেবার উপাদান হিসাবে কাজ করছে।’’ (পার্টি কর্মসূচি, প্যারা ৫.১৪)
নয়া-উদারীকরণের শুরুর জমানায় এরকম একটি কথা বলা হতো যে, সব বাজারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, যেন রাষ্ট্র বলে আর কিছু থাকবে না। এটাও বলা হতো যে, ‘রাষ্ট্র সমস্ত কিছু থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে’। কিন্তু আমাদের (এবং গোটা দুনিয়াতেই) অভিজ্ঞতা হলো যে, নয়া-উদারনীতির জমানায় সম্পদের কেন্দ্রীভবনের হাতিয়ার হয়েছে রাষ্ট্র। পার্টি কর্মসূচির যে অংশটি ওপরে উল্লেখিত হলো সেখানেই বলা হচ্ছে যে, এই ভয়ঙ্কর আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রীভবন আসলে পুঁজিবাদী বিকাশেরই প্রতিফলন। আরও ভাল করে বললে পুঁজির ক্রমাগত কেন্দ্রীভবনের প্রতিফলন।
আসল ব্যাপার হলো যে, এই যে পুঁজির ব্যাপক পরিমাণ বৃদ্ধি হচ্ছে তা শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন সম্পদ তৈরির মধ্য দিয়ে হচ্ছে না। এই বৃদ্ধি হচ্ছে পুঁজির এক দীর্ঘমেয়াদি সংকটের পর্বে। তাই পুঁজির এই কেন্দ্রীভবনের মুখ্য উপাদান হলো জনগণের সম্পদ লুঠ করা। যা আসলে ভুঁইফোড় পুঁজির মালিক তৈরি করছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মিত্র গৌতম আদানি এইরকম ভুঁইফোড় বৃহৎ পুঁজির মালিকানার আইকন। এখানেই কাঠামোগত দুর্নীতির উৎস। অর্থাৎ সরাসরি সরকারি সম্পদ বা জনগোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পদের হস্তান্তর হচ্ছে বেসরকারি মালিকের হাতে। কখনো কখনো তা হচ্ছে সরকারি বৈধতাসহ। আমাদের রাজ্যের ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। গোটা প্রকল্পের মোদ্দা কথা হলো সরকারের টাকা দীর্ঘমেয়াদি কোনো স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর জন্য ব্যবহার করা হবে না। আপনি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করুন, সরকার তার কোষাগার থেকে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের সেই খরচ দেবে। অর্থাৎ জনগণের টাকা বেসরকারি হাতে তুলে দাও। সরকারি খনি, নদী, কারখানা, পেনশন সব ব্যক্তি পুঁজির হাতে তুলে দাও। আজকের ভারত রাষ্ট্রের মুখ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের পার্টি কর্মসূচিতেই বলা হয়েছে - ‘‘সরকারি পদাধিকারী শীর্ষস্থানীয় আমলা এবং বুর্জোয়া রাজনীতিকদের নিয়ে তৈরি হয়েছে দুর্নীতির এক অশুভ চক্র যা আইনের তোয়াক্কা করে না, জনগণের তহবিল লুণ্ঠনে সাহায্য করে। নির্বাচনে অর্থ শক্তির ব্যবহার দারুণভাবে বৃদ্ধি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, বুথ দখল ও রিগিং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামনে এক গুরুতর বিপদস্বরূপ।’’ (পার্টি কর্মসূচি। প্যারা ৫.২১)
অর্থাৎ সম্পদের লুঠ, দুর্নীতি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, নির্বাচনে অর্থশক্তির বিপুল ব্যবহার, বুথ দখল, রিগিং এই সবক’টি আসলে এক সূত্রে গাঁথা। তাই এর বিরুদ্ধে লড়াইও আসলে একসূত্রে গাঁথা। আমাদের রাজ্যের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারব যে, শুধু জাতীয়স্তরে জনগণের সম্পদ লুঠ করে আদানির মতো ভুঁইফোড় পুঁজিপতি তৈরি হয়েছে তাই নয়, গ্রামে গ্রামে এরকম হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধনী ব্যক্তিরা তৈরি হচ্ছেন (রাজ্যের শাসকদলের ছত্রছায়ায়) যাঁরা আঞ্চলিক স্তরে লুঠের ব্যবস্থা কায়েম করেছে। আরও গভীরে গেলে বোঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় জমি থেকে রাইস মিল - সমস্ত কিছুর মালিকানার কেন্দ্রীভবন ঘটছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজির অনুপ্রবেশের ক্যারিয়ার আমাদের রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো গ্রামে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়া এবং একদল ধনী মালিকশ্রেণির বিকাশ যারা সমস্তরকম আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী। যারা লুঠের অর্থনীতির ধারক ও বাহক। যার ফল হল গ্রামে কর্মসংস্থান নিম্নমুখী, গ্রাম ছেড়ে লাখে লাখে পরিযায়ী শ্রমিক বাইরে চলে যাবেন, চাষ ও ফসল কেনাবেচা সহ সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর এই ধনিকশ্রেণির একচ্ছত্র অধিপত্য কায়েম হবে, এবং অসংখ্য মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বেন। যাঁরা পিছিয়ে পড়ছেন তাঁরাই আসলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁদের কাছে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিছক একটা ভোট দেওয়া নয়, এই নির্বাচন তাঁদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্ন। এটা শুধু তাঁরা জানেন এরকমটা নয়, শাসকরাও জানে। আর সেজন্যেই এত মরিয়া আক্রমণ। লুঠের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য গণতন্ত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। আমাদের পার্টি কর্মসূচিতে বলা হয়েছে - ‘‘সংসদীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের বিপদ শ্রমজীবী জনগণ ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টিগুলির কাছ থেকে আসে না। এই বিপদ আসে শোষকশ্রেণির কাছ থেকে। নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার জন্য তারাই সংসদীয় ব্যবস্থাকে একটি হাতিয়ারে পরিণত করে ভেতর ও বাইরে থেকে এই ব্যবস্থাকে খর্ব করে। যখন জনগণ তাদের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণি ও জমিদারদের প্রভাব থেকে দূরে সরে যান, এইসব শ্রেণিগুলি সংসদীয় গণতন্ত্রকে পদদলিত করতে দ্বিধাবোধ করে না।...’’ (পার্টি কর্মসূচি। প্যারা ৫.২৩)
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এত রক্তাক্ত কেন? কারণ এখানে সংসদীয় ব্যবস্থাকে বৃহৎ বুর্জোয়া ও জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার শক্তির অস্তিত্ব আছে। কমিউনিস্টরাই শোষিত শ্রেণিগুলোকে সংগঠিত করে সবচেয়ে কার্যকরিভাবে এই কাজ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা এক ঐতিহাসিক সত্য। আর এজন্যেই বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস আজকে বিজেপি এবং আরএসএস’র স্বাভাবিক মিত্র। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির উদ্ভব ও বিকাশের মেরুদণ্ডই হলো কমিউনিস্ট বিরোধিতা বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সিপিআই(এম) বিরোধিতা। ডিএমকে, টিডিপি, সমাজবাদী পার্টি জাতীয় অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের মৌলিক তফাত এটাই। তৃণমূল তৈরিই করা হয়েছে কমিউনিস্টদের নিকেষ করার জন্য। আর তাই উল্টোটাও সত্যি। আমাদের রাজ্যে এই লড়াইয়ে শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা কমিউনিস্টরাই গ্রহণ করবে।
যদি দেখা যায় যে, গণনাকেন্দ্রে লুঠের এই বিপুল আয়োজন আসলে বামপন্থীদের এবং সিপিআই(এম)-র প্রাপ্ত ভোটকে কমিয়ে দেখানোর জন্যই করা হয়েছে তাতেও খুব আশ্চর্য হওয়ার নেই। আর্থিক, সামাজিক ক্ষমতায়নের সংগ্রামকেই গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। নির্বাচনের সরকারি পরিসংখ্যানে তা মাপা যাবে না। সাইকেলের প্যাডেল প্রথমবার ঘোরাতে বেশি শক্তি ক্ষয় হয়, কিন্তু সাইকেল এগোয় অল্প। প্যাডেল যত ঘুরতে থাকে তত কম শক্তি ক্ষয়ে বেশি দূর যায়। এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা এগোলাম সেই পরিমাণগত মাপটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। চাকা ঘুরতে শুরু করেছে, এই গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।