E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০

অভিন্নতা নয় - সমতা চাই

মিনতি ঘোষ


কোঝিকোড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শীর্ষক আলোচনাসভায় বলছেন সীতারাম ইয়েচুরি।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশের মূল সমস্যাগু‍লি থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রস্তাব এনেছে। যা নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। আসন্ন বাদল অধিবেশনে বিগত লোকসভা নির্বাচনে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তিনি বদ্ধ পরিকর। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা Uniform Civil Code যার অন্যতম। যখন সারা দেশে বেকারির সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর, মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, কৃষকের সংকট বাড়ছে ক্রমাগত, সংখ্যালঘু দলিত, মহিলাদের উপর অত্যাচার ক্রমবর্ধমান, তখনই ১৪৩ কোটি মানুষের দেশ ভারতের সকল জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের নাগরিককে তথাকথিত একসূত্রে বেঁধে ফেলার চেষ্টায় ২২তম আইন কমিশন গঠন করে মাত্র একমাসের মধ্যে এই বিষয়ে সবার মতামত জানতে চাইছে।

ভারতে নাগরিকদের ব্যক্তিগত আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আইন সবার জন্য সমান হবে। বর্তমানে যা বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্র দ্বারা মূলত পরিচালিত হয়।

আসল উদ্দেশ্য আরএসএস’র মূল অ্যাজেন্ডা ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ তৈরি করা। প্রবক্তারা ভুলে যাচ্ছেন ভারত একটি বহু জাতির, বহু ধর্মের, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য রচনা করে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।

‘‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।’’

পদে পদে তা আজ লাঞ্ছিত হচ্ছে। বিশ্বের দরবারে সমালোচিত হয়েও মাননীয় নরেন্দ্র মোদি তাঁর লক্ষ্যপূরণে অটল। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান রচিত হয় ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে, গণপরিষদে দীর্ঘ সময় ধরে মতামত সংগ্রহ, আলোচনার পর ঘোষিত হয় ভারত একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মূল কথা হলো দেশের সবার জন্য এক আইন। বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত বিধিসমূহকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। বর্তমানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আইন তাদের ধর্মীয় শাস্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। হিন্দু, মুসলিম, পারসি, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ সহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বনকারীদের নিজস্ব ব্যক্তিগত আইন আছে। আবার সবার জন্য রাষ্ট্র প্রণীত আইনও আছে। এই ব্যক্তিগত আইন ব্রিটিশরা লাগু করে মূলত হিন্দু এবং মুসলিম নাগরিকদের জন্য।

একমাত্র পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা গোয়া, দমন-এ সিভিল কোড এখনও বর্তমান।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বড়ো রক্ষাকবচ সংবিধান আমাদের দিয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ২৫-২৮ অনুচ্ছেদ, ভারতীয় নাগরিকদের ধর্মের স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার দিয়েছে। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে তাদের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় রাখার অধিকার দিলেও সংবিধানকে অমান্য করার প্রবক্তা বিজেপি-আরএসএস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের খেলায় উন্মত্ত। সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের খাদ্যাভ্যাসের প্রতি বিধিনিষেধ, মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা, ভিন্ন জাতিধর্মের মধ্যে বিয়েকে ‘লাভ জিহাদ’-এর নামে অনার কিলিং বা সম্মানরক্ষার নামে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না। মুসলিম, দলিত বিদ্বেষের এই নগ্ন চেহারা আজ বিশ্বের কাছে উন্মোচিত। ধর্মের নামে উন্মত্ততা, হুঙ্কার চলছে সারা দেশে।

এই প্রেক্ষিতে কমন সিভিল কোড নাগ‍‌রিকের স্বাধিকারের উপর চরম আঘাত নামিয়ে আনবে। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলবীর সিংহ চৌহানকে চেয়ারম্যান করে ২১তম আইন কমিশন গঠিত হয়। সেই কমিশন স্পষ্ট ভাষায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা করেছিল। বিস্তৃত আলোচনা, রিসার্চ, সেমিনার সংগঠিত হয়। মতপ্রকাশ করা হয় - এটা যথার্থ সময় নয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, যে ব্যক্তিগত আইন বর্তমান তা সব অংশের মহিলাদেরই বঞ্চিত করে, কমিশনের মতে এটি বৈষম্য এবং বৈষম্য নয় যা বৈষম্যের মূলে রয়েছে। এই কমিশন তাই একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পরিবর্তে বৈষম্যমূলক আইনের সাথে মোকাবিলা করেছে, যা মঞ্চের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। বে‍‌শিরভাগ দেশ এখন ভিন্ন মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সেখানে বৈষম্য নয়, একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়।

তথাপি মোদি সরকার ২০২০ সালে কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ অবস্থির নেতৃত্বে ২২তম আইন কমিশন গঠন করে। এবারে ১৪ জুন তারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে ধর্মীয় সংস্থাসহ জনসাধারণের মতামত চেয়েছে। আবার দেশব্যাপী আলোচনার সুযোগ না দিয়ে মাত্র এক মাস সময়সীমা নির্দিষ্ট করেছে। আরও উল্লেখ্য, ২২তম কমিশনের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট।

এখানেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। এই বিধির জুজু ঝুলিয়ে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌলবাদী হিন্দুদের মন জয় করা এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে ক্ষোভ, উষ্মা, আতঙ্ক তৈরি করা।

২০১৭ সালে মুসলিমদের ‘তিন তালাক’ প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে একটি আইন অনুমোদন করেছে ভারতের পার্লামেন্ট। এই প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

শরিয়তের আইন মেনে তো অনেক ক্ষেত্রেই তালাক দেওয়া হয় না। কিন্তু ফৌজদারি শাস্তির বিধানের কারণে স্বামীর জেল হলে তালাকপ্রাপ্ত মহিলা সন্তানদের নিয়ে দুরবস্থার শিকার হন। ১৯৮৫ সালে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী শাহবানোর ছেচল্লিশ বৎসর স্বামী পরিত্যক্তা থাকার পর যখন তাঁর একাত্তর বছর বয়সে মামলাটি ‘সুপ্রিম কোর্ট’ পর্যন্ত গড়ায়, শরিয়তের আইন না মেনে স্বামী মেহের বাবদ ৩০০০.০০ টাকা যৌতুক দিয়েই তাৎক্ষণিক তালাক দেয়। এর ফলে আমাদের সংগঠন সহ বিশিষ্ট মানুষেরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সংসদে ‘Muslim Women’s Protection Act’ পাস করালেও কটি ক্ষেত্রে তা কার্যকরি হচ্ছে।

হিন্দু মে‌য়েদের ডিভোর্সের পর খোরপোষ পেতে আদালতে ছুটতে হয় দিনের পর দিন। তাও খোরপোষ মেলে না। সংখ্যালঘু অধিকার এবং মহিলাদের অধিকার সমার্থক। হিন্দু মহিলারাও তো ডিভোর্স না পেয়েও স্বামী বিচ্ছিন্ন হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। স্বীকৃতি আর অস্বীকৃতির দোলাচলে দাঁড়িয়ে। সব ধর্মেই প্রভাবশালীদের জন্য একই বিধি, একই সুযোগ। মূল কথা হলো বৈষম্য আর অনাচারের পশ্চাতে লুকিয়ে আছে পিতৃতন্ত্র। যুগ যুগ ধরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অব্যাহত। নারীর বঞ্চনা অনেক বেশি।

ধর্মীয় মেরুকরণের এই বাড়বাড়ন্তের সময় আমরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পরিবর্তে সমতা চাই। সাম্য চাই। পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে ‍গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে, আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকারের সপক্ষে আইন তৈরি হয়েছে। বাস্তবচিত্র ভয়ঙ্কর। বাল্যবিবাহ ক্রমাগত বাড়ছে, পণের শিকার লক্ষ লক্ষ মহিলা। গার্হস্থ্য হিংসা বিরোধী আইনকে পায়ে দলে ঘরে ঘরে হিংসার আগুনে পুড়ছে নারী। সম্পত্তির অধিকার পুত্র-কন্যার। আইন আছে কিন্তু কার্যকরি হয় না। আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার আজ করপোরেটদের দখলে।

বিজেপি শাসিত রাজ্যে মাত্রা অনেক বেশি। নিপীড়ন আর উৎপীড়নের চাপে মানবাধিকার বিদ্ধ। কোন দেওয়ানি বিধি তা থেকে নাগরিককে পূর্ণ মনুষ্যত্বের মর্যাদা দিতে পারবে? যখন মূল্যবৃদ্ধির চাপে সবচেয়ে আক্রান্ত বেশি মহিলারা তখন এ‍‌ই বিধি খাবে না, মাথায় দেবে?

উত্তর-পূর্ব ভারতে ২০০-র বেশি উপজাতি মানুষ আছেন। তাদের ষষ্ঠ তফ‍‌শিলের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের কোন আইনে বাধা যাবে? হিন্দুদের মধ্যেও প্রায় ১৫টি পারিবারিক আইন আছে।

মুসলমানদের স্থান ভেদে বিবাহের আইন ভিন্ন। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বজায় থাক - বরং আমরা সম্মিলিতভাবে দাবি জানাই - অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পরিবর্তে সমস্ত বেকারের কাজ চাই। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। আচ্ছাদনের দাবি সবার জন্য। উন্নতমানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই। পেট ভরে ভাত চাই। সমস্ত জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে উঠুক। ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের অবসান চাই। চাই মুক্ত আলো হাওয়া যুক্ত পরিবেশ। নারীকে অন্তঃপুরে কুকুর, শুকরের মতো না রেখে মানুষের মর্যাদা, সমানাধিকার দিয়ে সকল কাজে শামিল করা হোক। খুব বেশি চাওয়া কী? স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে?