৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০
চন্দ্রায়ন-৩: বিজ্ঞানের ভাবনা ও দুর্ভাবনা
শ্যামল চক্রবর্তী
চাঁদের বুকে প্রথম মহকাশযান অবতরণের কৃতিত্ব সোভিয়েত দেশের। ১৯৫৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সোভিয়েতের মহাকাশযান লুনা-২ প্রথম চাঁদের বুকে নেমেছে। এর আগে অন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে কারও কোনো মহাকাশযান অবতরণ করেনি। প্রধানত দুটো কারণে চাঁদের দিকে নজর পড়েছে বিজ্ঞানীদের। প্রথমত, চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। দ্বিতীয়ত, যে কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের তুলনায় চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব মাত্র ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার।
এর এক দশক পর ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই প্রথম মানুষ চাঁদের বুকে নেমেছিল। প্রথম যিনি এই গৌরবের অধিকারী হয়েছিলেন তাঁর নাম নিল আর্মস্ট্রং। যে মহাকাশযানে চড়ে আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে নেমেছিলেন তার নাম অ্যাপোলো-১১। এক দশক আগে ২০১২ সালে বিরাশি বছর বয়সে আর্মস্ট্রং প্রয়াত হয়েছেন।
চন্দ্রাভিযানে এখন পর্যন্ত যোগ দিয়েছে পৃথিবীর চারটি দেশ। সোভিয়েত দেশ, আমেরিকা, ভারত ও চীন। জাপান চাঁদের কক্ষপথে ১৯৯০ সালে একটি উপগ্রহ পাঠিয়েছিল। তবে সেটি বেশিদিন খবরাখবর পাঠাতে পারেনি। ২০০৭ সালে জাপান আরও একটি উপগ্রহ পাঠিয়েছে। সে দিব্যি কাজ করে চলেছে। তার পাঠানো খবরাখবর নিয়ে জাপানের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নিয়মিত গবেষণাপত্র লিখে চলেছে।
ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ২০০৪ সালে একটি মহাকাশযান পাঠিয়েছিল। ২০০৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের পর এর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
চন্দ্রাভিযান নিশ্চয়ই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসামান্য অবদান নির্দেশ করে। কিন্তু সূচনাপর্ব থেকেই বৃহৎ শক্তির রাজনীতি সেখানে সক্রিয় থেকেছে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি যখন কংগ্রেসে প্রতিনিধিদের কাছে এই অভিযান পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন তখনই সোভিয়েত দেশের কৃতিত্ব ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিলাষ প্রকাশিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে সেদেশে নাসা-র প্রধান ছিলেন এক সামরিক আধিকারিক যার নাম জিম ব্রিডেনস্টাইন। চন্দ্রাভিযান নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এ আসলে এক রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিযোগিতা। অর্থনৈতিক মতাদর্শের প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিগত আধিপত্যের প্রতিযোগিতা। বৃহৎ শক্তির এই বৃহৎ প্রতিযোগিতায় মার্কিন দেশ জয়লাভের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিল।’ সোভিয়েতের পতনের পর নিশ্চয়ই চিত্রের বদল ঘটেছে। তাই ২০১৮ সালের নভেম্বরে ব্রিডেনস্টাইনকেই বলতে শোনা যায়, ‘চাঁদের পিঠে নিয়মিত আসা যাওয়া যেন করা যায়, আমেরিকা তেমন পরিকাঠামো গড়ে তুলছে। অনেক রাঘব বোয়াল মাঠে নেমে পড়েছেন। এদের মধ্যে এলন মাস্ক আছেন। নিজের কোম্পানি তৈরি করেছেন যার নাম ‘স্পেসেক্স’। মহাকাশ অভিযাত্রীদের নিয়ে যাতায়াত শুরু করেছে এই কোম্পানি। পরীক্ষাপর্ব হয়তো শেষ হয়নি, তবে শেষের মুখে।
চীন তুলনায় অনেকটা পরে চন্দ্রাভিযানে যোগ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এক অসাধ্য সাধন করেছে। চাঁদের যে পিঠ সবসময় পৃথিবীর উলটোদিকে থাকে, যে পিঠ সূর্যের আলো পায় না বলে পুরোপুরি অন্ধকার, সেই পিঠে তাদের মহাকাশযান নামিয়েছে। এই মহাকাশযান ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি চাঁদে নেমেছিল। সে খবর পাঠিয়েছে, কোথাও কোথাও চাঁদের বারো মিটার গভীরে ধুলো রয়েছে। চাঁদের পিঠের সম্পদ দখলের উদগ্র প্রতিযোগিতা এখনও না দেখা গেলেও তার নানা ইঙ্গিত মিলছে। চীন অবিশ্যি তার অভিপ্রায় গোপন করেনি। পৃথিবীর শক্তিসংকট সমাধানের জন্য চীন চাঁদের হিলিয়াম-৩ গ্যাসের অনুসন্ধান করবে বলে জানায়।
ভারতের কথায় আমরা আসতে চাই এবার। স্বাধীনতার পর ভারত বিজ্ঞানের যে তিনটি ক্ষেত্রে গর্ব করার মতো অগ্রগতি ঘটিয়েছে সেগুলি হলো কৃষি, পারমাণবিক শক্তি ও মহাকাশ বিজ্ঞান। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকেই, বিশেষত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণের পর এই ক্ষেত্রগুলিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বলতে দ্বিধা নেই তার সুফল পেয়েছি আমরা। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম হাল ধরেছিলেন বিক্রম সারাভাই। ১৯৭১ সালে মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটে। তারপর এই গবেষণাক্ষেত্রের হাল ধরেছিলেন সতীশ ধাওয়ান। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বা ইসরো’র দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর স্মৃতিতেই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় মহাকাশ উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের নামকরণ হয়েছে।
যাইহোক, ভারতের এ পর্যন্ত চন্দ্রাভিযানের সংখ্যা তিন। এদের নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা যথাক্রমে চন্দ্রায়ন-১, চন্দ্রায়ন-২ ও চন্দ্রায়ন-৩।
আমাদের শুরুর অভিযান চন্দ্রায়ন-১, এককথায় বলা যায়, সত্যিই সার্থকতা লাভ করেছে। ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর মহাকাশযানটি চাঁদের উদ্দেশে সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে পাঠানো হয়েছিল। ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর এটি চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। ১৪ নভেম্বর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে থিতু হয়। সে অংশটুকুই মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে যার ভেতরে রয়েছে নানারকমের পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। সকলেই জানেন, অটলবিহারী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর যে জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিগুলি নেমেছিল, ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সে জায়গার নামকরণ করেছিলেন ‘জওহর পয়েন্ট’। ১৪ নভেম্বর জওহরলালের জন্মদিন। সেকথা ভেবে নামকরণ হয়েছে। এখনকার প্রধানমন্ত্রী নানা আকারে-প্রকারে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। রাজনীতির এমন কদর্য অধঃপতন দেড়দশক আগে দেখা যায়নি। মাত্র ৩৮৬ কোটি টাকায় ভারতের মাহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই অভিযান সফল করেছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশ এত কম খরচে এই মহাযজ্ঞ সাধন করতে পারেনি। নিশ্চয়ই আমাদের বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব।
গোড়ায় ঠিক ছিল, দু’বছর টানা যন্ত্রপাতি কাজ করবে। বিজ্ঞানীরা ফলাফল যাচাই করবেন। ২০০৯ সালের ২৮ আগস্টের পর যন্ত্র আর কাজ করছিল না। ৩১২ দিনের মাথায় সব গুটিয়ে নিতে হলো। এই অভিযানের সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার, চাঁদের পিঠে যে জল আছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া। নাসার বিজ্ঞানীরাও আগে এমন অনুমান করেছিলেন। সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল। প্রশ্ন মনে জাগল অনেকেরই, তবে তো চাঁদে ঘরবাড়ি তৈরি করে মানুষ থাকতে পারবে। হতদরিদ্র মানুষ নিশ্চয়ই সেখানে পৌঁছবে না। যারা পৌঁছবে, ব্রিডেনস্টাইনের ভাষাতে বলতে পারা যায়, রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় শামিল হবে না তো? কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিকে সত্যি প্রমাণ করে দখলদারির যুদ্ধে লিপ্ত হবে কি মানুষ?
কল্পনার পাখা দীর্ঘতর করে আপাতত লাভ নেই। আমরা যাই এবার চন্দ্রায়ন-২-এর কথায়। যে সব রহস্য উদ্ধারের আশায় ঘটেছিল চন্দ্রায়ন-১ অভিযান, একই অভিপ্রায়ে গড়ে উঠল চন্দ্রায়ন-২-এর কর্মকাণ্ড। সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে এই মহাকাশযান রওয়ানা দেয় ২০১৯ সালের ২২ জুলাই। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছোয় ২০ আগস্ট। সব ঠিক থাকলে ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার যন্ত্রপাতিগুলি চাঁদে নামত। চন্দ্রায়ন-২ এর অনুমোদন হয়েছে যখন দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হয়েছে। ডঃ মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও নানা অনিবার্য কারণে পিছিয়ে দিতে হয়। সব ঠিকই ছিল, চাঁদের পিঠে নামতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে। সব জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যায়। ‘অভিযান’ শব্দের মধ্যেই তো ব্যর্থতা ও সাফল্য লুকিয়ে আছে। নানা দেশে তার নজিরও আছে। প্রাথমিক বিষণ্ণতা কাটিয়ে বিজ্ঞানীরা পরের অভিযানের প্রস্তুতি নেন। এই অভিযানের নাম চন্দ্রায়ন-৩। চন্দ্রায়ন-২-এর সময় মোদী দ্বিতীয়বার আসনে বসেছেন। যে কোনো ভারতীয় নাগরিকের সফলতায় দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা শুভেচ্ছা জানাবেন এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। ছোটোখাটো বিবৃতি দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। মনে পড়বে অনেকের, মোদী সে সময় ২৪ মিনিটের নাটকীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কথার ভেতর ‘অনুপ্রেরণা’ ছিল, বিজ্ঞানীদের হতাশ না হওয়ার বার্তা ছিল। বিজ্ঞান-সংস্কৃতি ও ইতিহাস চেতনাকে ধ্বংস করার মন্ত্রে দীক্ষিত সংঘ পরিবারের প্রতিনিধি হলেও পরের চন্দ্রাভিযান পরিকল্পনায় তিনি সম্মতি দিলেন। মুদ্রার দুরকমের পিঠ তাঁকে রক্ষা করে যেতেই হবে। যখন যেমন তখন তেমন মুদ্রার পিঠ তুলে ধরতে হবে।
১৪ জুলাই ২০২৩। চন্দ্রায়ন-২ অভিযানের চার বছর পর সূচনা হলো চন্দ্রায়ন-৩ অভিযানের। দুপুর ২-৩৫ মিনিটে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে যাত্রা শুরু হলো মহাকাশযানের। আমরা কেউই চাই না, চন্দ্রযান-২-এর মতো তার পরিণতি হোক। নির্ভুল অগ্রগমন হলে ২৩ আগস্ট বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে চন্দ্রযান-৩ চাঁদের বুকে নামবে। ইসরো সভাপতি এস সোমনাথ (বেদে সব বিজ্ঞান আছে বলে যিনি বিশ্বাস করেন) জানিয়েছেন। চন্দ্রযান-৩ যেন মসৃণভাবে চাঁদের পিঠে নামতে পারে, তারই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। চন্দ্রযান-৩ যখন নামবে, যেন জোর ধাক্কা না খায়। তার পা-গুলি শক্তপোক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। এই চন্দ্রযানে ইঞ্জিনের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হয়েছে। পাঁচের বদলে চারটি ইঞ্জিন, ফলে জটিলতা কম হবে। এবার এই অভিযানে সহযোগিতা করছে ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি। খরচ যে খুব বেশি বলা যায় না। ইসরোর পূর্বতন সভাপতি কে শিবন জানিয়েছেন, খরচ হবে ৭২১ কোটি টাকার মতো।
দুটো কথা বলে এই লেখা শেষ করব। প্রথম কথা বিজ্ঞানীদের নিয়ে। সংঘ পরিবারের রাজত্বে ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক সুরক্ষা চরম বিপন্ন হলেও বিজ্ঞানীরা সে পথে হাঁটবেন কেন? বাড়িতে তেত্রিশ কোটি বিগ্রহের পুজো যে কেউই করতে পারেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তা কাম্য নয়। দ্বিতীয় কথা, রাঁচির হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের যে প্রযুক্তিবিদেরা উৎক্ষেপণের জায়গাটি তৈরি করেছেন (লঞ্চিং প্যাড) তাঁরা বিগত সতেরো মাস ধরে কোনো মাইনে পাচ্ছেন না। এটি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীদের অভুক্ত রেখে সত্যিকারের অর্থেই কি রাষ্ট্রের ধ্বজা উড্ডীন হবে?
আমরা চাইব, আমাদের বিজ্ঞানীদের এই জয়যাত্রা সফল হোক। আগস্টের সেই দিনটির দিকে আমরা সবাই তাকিয়ে আছি।