৬০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২১ জুলাই, ২০২৩ / ৪ শ্রাবণ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (কুড়ি)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● স্বামী বিবেকানন্দ অদ্বৈতবাদী হলেও অদ্বৈতবাদীদের অলীক বিশ্বজগতের বিপরীতে বাস্তব জগতের ধারণাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে, এই ধারণা তিনি পোষণ করলেও সমাজেরও যে নিজস্ব নিয়ম থাকতে পারে, তিনি ভাবেননি।
● মার্কসবাদীরা তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীদের মতে বস্তুই চেতনাকে নির্ধারণ করে। বিবেকানন্দের বক্তব্য ছিল, চেতনাই বস্তুর নিয়ন্ত্রক। স্পষ্টভাবে তিনি ভাববাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলিষ্ঠতার সাথে ঘোষণা করেছিলেন, ইংল্যান্ড যেমন শিল্পবিপ্লবে বলীয়ান হয়েছে, আধ্যাত্মিক দর্শন তেমনই ভারতবর্ষকে শক্তিশালী করবে। বস্তুগত উৎপাদনের শ্রীবৃদ্ধি মানব উন্নয়নের অন্যতম উপায় বলে তিনি মনে করতেন না। এই কথাকে তিনি স্বীকৃতি দেননি। একথা ঠিকই যে, স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে একটা স্ববিরোধিতা ছিল। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিল। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, সাম্যবাদ বা অন্য কোনো রূপে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর আগামী দিনে শূদ্র জাতির শাসনের পালা আসবে। অথচ এক সময়ে বিবেকানন্দ বর্ণব্যবস্থাকে প্রাকৃতিক নিয়মে বিকশিত এবং তাই ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা বলে দাবি করেছিলেন। আবার তিনি আচার-অনুষ্ঠানকে অর্থহীন বর্ণনা করে এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, একটি শক্তিশালী জাতি গঠনে আপামর জনসাধারণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। লিঙ্গ সমতা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি পুঁজিপতিদের সীমাহীন লোভের তীব্র সমালোচক ছিলেন এবং সকল ধর্মের ঐক্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা প্রচার করতেন।
● ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী শক্তির ধারাবাহিক শোষণ, ঔপনিবেশিক বিকাশধারার জটিলতা এবং ক্রমবর্ধমান কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিতে বিবেকানন্দের দর্শনকে বিশ্লেষণ করতে হবে। ভারতীয় আত্মমর্যাদার প্রচারক হিসাবে দেশের তারুণ্য শক্তিকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন, যা পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের রূপ পেয়েছিল। হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণীগুলি ব্যবহার করা দরকার। এছাড়াও তাঁর রচনাগুলির মধ্যে বহু উপাদান রয়েছে, যা হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামে ব্যবহার করা যেতে পারে। মানুষের উন্নয়নকে বাদ দিয়ে যারা গো-সুরক্ষার কথা বলে, তাদের তিনি তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
● এই সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলি হিন্দুসমাজের কিছু সামাজিক কু-আচারের সংস্কার সাধনে ব্রতী হয়েছিল। তবে এই আন্দোলনগুলি ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাববাদের মৌলিক বিষয়গুলি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। আবার জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথাও এই আন্দোলনগুলি ভাবেনি। ধর্ম ও ঐতিহ্যের আড়ালে জনহিতৈষণার চেষ্টা করেছিল।
আমূল সংস্কার আন্দোলন বা রেনেসাঁ
● জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, আমূল সংস্কার আন্দোলন, এই দেশে সনাতন ধর্ম বা প্রাচীন ঐতিহ্যের সমর্থন ছাড়াই সংগঠিত হয়েছিল। ভারতের বুকে এ ছিল রেনেসাঁ বা নবজাগরণের আন্দোলন। কয়েকজনের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। যেমন জ্যোতিবাও ফুলে, আম্বেদকর, তামিলনাড়ুর পেরিয়ার রামস্বামী, কেরালার নারায়ণ গুরু, আয়াপ্পান ও অয়ঙ্কালি, অন্ধ্রের ভাগ্য রেড্ডি বর্মা, পাঞ্জাবের মঙ্গোরাম ও ছোটুরাম, উত্তর প্রদেশের অচ্যুতানন্দ ও রামচরণ, বাংলার হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, যোগেশ মণ্ডল, আসামের সম্বোধন সেনাপতি (ফাং লো) প্রভৃতি যুগপুরুষদের জাতপাতের এই আমূল সংস্কার আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই রেনেসাঁ পরিচালিত হয়েছিল। তবে এই রেনেসাঁ আন্দোলনে বাংলার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)
● প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের জন্য বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। সমাজকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে বিশেষকরে বাংলার সমাজে শিক্ষার প্রসারে তিনি বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এক উন্নতমানের সংস্কারক ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষাকে সরল ও সহজবোধ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। তৎকালীন হিন্দুসমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে তিনি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ব্যাপারে তৎকালীন বহু প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন।
● নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সাক্ষরতার প্রসার ঘটানো, মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো, কূপমণ্ডুকতা-কুসংস্কারের প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। পশ্চাৎপদ অংশ এবং আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে তিনি জীবনের ১৮ বছর অতিবাহিত করেছেন। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও বুৎপত্তির জন্য তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু কূপমণ্ডুকতা, ধর্মান্ধতা থেকে তিনি ছিলেন মুক্ত। উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন তিনি।
জ্যোতিবাও ফুলে (১৮২৭-১৮৯০)
● ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে সকলের জন্য শিক্ষার অধিকারের দাবি যাঁরা তুলেছিলেন, নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে জ্যোতিবাও ফুলে একজন। দেশ যখন অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত, ব্রিটিশ শাসকরা যখন ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিয়ে ভারতের শিক্ষার কাঠামো তৈরি করতে চাইছে, তেমন একটা সময়ে জ্যোতিবাও ফুলে নারীশিক্ষার প্রসারে এগিয়ে আসেন। প্রথম নারী বিদ্যালয় তিনিই স্থাপন করেন। তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। জাতপাতের ব্যবস্থার তিনি চরম বিরোধী ছিলেন। বর্ণব্যবস্থার অবসান ঘটাতে সারা জীবন লড়াই করেছিলেন।
নারায়ণ গুরু (১৮৫৬-১৯২৮)
● কেরালার রেনেসাঁ আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন নারায়ণ গুরু। তিনি ছিলেন দার্শনিক এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি আদি শঙ্করের অদ্বৈতবাদী দর্শনের একজন অনুসারি হলেও তিনি সামাজিক সমতা ও সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের কথা প্রচার করেছিলেন। সার্বজনীন ধর্মের আহ্বান দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘এই জগৎ একটাই, সব মানুষ এক। ঈশ্বরও একটাই। এক দেশ-এক ধর্ম -’’ এই ছিল নারায়ণ গুরুর স্লোগান। হিন্দুত্ববাদীদের ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি’র বিপক্ষে এর ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্ণব্যবস্থার সম্পূর্ণ ধ্বংসের কথা না বললেও, তিনি বর্ণব্যবস্থা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়ে গেছেন। ব্রাহ্মণদের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি একটি শিবমন্দিরও নির্মাণ করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। শিক্ষার প্রসারে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেরালায় গ্রন্থাগার আন্দোলনের স্রষ্টা ছিলেন তিনি।
হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮)
● তথাকথিত পশ্চাৎপদ অংশের মধ্যে তাঁর জন্ম। এদের নমশূদ্র নামে অভিহিত করা হতো। একজন অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি, যাঁর রয়েছে যাদুবিদ্যায় পারদর্শিতা। অর্থাৎ ঐশ্বরিক ক্ষমতা - এভাবেই এলাকায় তাঁর পরিচিতি ছিল। বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন। তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা, যা বৈষ্ণব হিন্দুদের একটি ধারা। তিনি সন্ন্যাস (ascetism)-এ বিশ্বাস করতেন না। পরিবারে থাকাই ঈশ্বরের বিধান, একথা প্রচার করতেন। ভক্তি আন্দোলনের একটি ধারার তিনি ছিলেন প্রবর্তক। ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়া আর কোনো ঐতিহ্যগত আচার অনুষ্ঠানে তিনি আস্থা রাখতেন না। ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে হলে মানুষের ওপর আস্থা রাখতে হবে। সমস্ত জীব ও প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। ওই সময়ে ভারতীয় সমাজে তথাকথিত উঁচু জাতের মানুষের দ্বারা নিচু জাতের মানুষরা ছিলেন ভয়ঙ্করভাবে অত্যাচারিত। নিচু জাতের মানুষদের প্রায় কোনো অধিকার ছিল না। হরিচাঁদ ঠাকুরের সহজ মতবাদ প্রান্তিক অংশের মানুষদের আকৃষ্ট করেছিল। প্রান্তিক মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সত্য, ভালোবাসা ও সদ্বিবেচনা - এই তিনটি বিষয়ের উপরই তিনি জোর দিয়েছিলেন। সৎ ও উন্নততর জীবনযাপনের জন্য তিনি তাঁর অনুগামীদের কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৬-১৯৩৭)
● তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের সন্তান। তিনিও যাঁদের অস্পৃশ্য বলা হতো, সেই পশ্চাৎপদ অংশের মানুষের উন্নতির জন্য উল্লেখযোগ্য সংস্কারমূলক কাজ করেছেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর মতুয়া সমাজের নেতৃত্বের ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন। বর্ণব্যবস্থার নামে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি জোরদার সংগ্রাম করেছিলেন। দলিত অংশের মানুষের জন্য বহু বিদ্যালয় তিনি স্থাপন করেছিলেন। ভারত উপমহাদেশের দলিত মানুষদের স্বার্থরক্ষার দাবিতে ১৮৭৩ সালে প্রথম সাধারণ ধর্মঘটে তিনি নেতৃত্ব দেন। দলিত মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
ছোটুরাম (১৮৮১-১৯৪৫)
● ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ছোটুরাম ছিলেন এক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তিনি তৎকালীন ভারতে বঞ্চিত, শোষিত সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম (১৮৪৮-১৯১৯)
● কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গমকে আধুনিক তামিল সমাজের অগ্রদূত বলা হয়। সমাজকে আধুনিকভাবেই শুধু নয়, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি আপন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছিলেন। বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। সাথে সাথে পুনর্বিবাহের পর বিধবাদের নিরাপদ দাম্পত্য জীবনের জন্য ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। তাঁর স্ত্রীও এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তিনি সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কার যেমন শুভ-অশুভ লক্ষণ, ভাগ্যগণনা, আত্মা ও অতি-প্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষায় তিনি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকায় তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী প্রবন্ধ প্রকাশ করতেন। অবশ্য একটি সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করতেই হবে, তা হলো বর্ণব্যবস্থাকে তিনি সামনাসামনি চ্যালেঞ্জ করেননি।
(ক্রমশ)