৫৮ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২১ মে, ২০২১ / ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
প্রয়াত কমরেড জ্যোৎস্না বসু
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের প্রবীণ নেত্রী কমরেড জ্যোৎস্না বসুর জীবনাবসান হয়েছে গত ১৬ মে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। জীবনভর লড়াই করা কমরেড জ্যোৎস্না বসু করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ছিলেন। এদিন সকাল ৮টায় বেলেঘাটায় একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির লক্ষ্যে তিনি মরনোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে গিয়েছেন।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। কেন্দ্রীয় সরকারি পেনশনার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং কেন্দ্রীয় সরকারি কো-অর্ডিনেশন কমিটির পক্ষ থেকেও গভীর শোকপ্রকাশ করে কমরেড জ্যোৎস্না বসুর পরিবার পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। বিএসএনএল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি অনিমেষ মিত্র এবং কে জি বসু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দিলীপ দাসও শোকজ্ঞাপন করেছেন প্রবীণ নেত্রীর প্রয়াণে।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা প্রয়াত কমরেড মনি বসুর স্ত্রী জ্যোৎস্না বসু। শৈশব থেকে ঝড়ের মধ্যে লড়াই করে বড় হয়ে ওঠা এবং তারপরে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া কমরেড জ্যোৎস্না বসুর জীবন বর্ণময়, সংগ্রামী। তাঁর মামা ফকির সেন ছিলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অংশগ্রহণকারী। জ্যোৎস্না বসুর বাবা ছিলেন চিকিৎসক, রেঙ্গুনে কাজ করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি জ্যোৎস্না বসু ও তাঁর দিদিকে এদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, অতি শৈশবে প্রথমে চন্দননগরে একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তাঁরা। পরে দমদমে এবং তারপরে কলকাতায় চলে আসেন। যুদ্ধ আর রোগে বিধ্বস্ত রেঙ্গুন ছেড়ে তাঁর বাবাও কলকাতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পথেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান, তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই শৈশবের স্কুল ফাইনাল শেষ করে আইএ পরীক্ষা দেওয়ার সময় জ্যোৎস্না বসু ব্রিটিশ সরকারের টেলিফোন বিভাগে চাকরি পান। ১৯৪৬ সালে তিনি চাকরিতে যোগ দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই জুলাই মাসে শুরু হয় ঐতিহাসিক ডাক ও তার ধর্মঘট। সদ্য কাজে যোগ দিয়েই জ্যোৎস্না বসু ঝাঁপিয়ে পড়েন সেই আন্দোলনে। সেই শুরু গণআন্দোলনের নেত্রীর সংগ্রামী পর্বের।
স্বাধীনতার পরে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন তিনি, আজীবন সিপিআই(এম)’র সদস্য ছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য বারে বারে তিনি ও তাঁর পরিবার আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯৫৭ সালে তাঁকে ধরতে বাড়িতে পুলিশ এলে তিনি পাঁচিল টপকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সাতের দশকে বাড়িতে লুকিয়ে রাখা কমরেডদের রক্ষা করতে, বাড়িতে কংগ্রেসের দুষ্কৃতীদের আক্রমণ রুখতে তিনি একাধিকবার চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বেলেঘাটা থেকে ঘরছাড়াও হতে হয়েছিল তাঁকে। এই লড়াইয়ের সাহস তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত দেখিয়ে গেছেন। ২০১৫ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনের সময় বেলেঘাটায় একটি বুথে তিনি পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সবার শ্রদ্ধেয় এই প্রবীণাকেও সেদিন তৃণমূলের বাহিনী বুথে বসতে দেয়নি। জ্যোৎস্না বসু সেদিনও প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি, বুথের সামনেই লাঠিতে ভর দিয়ে বসেছিলেন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।
টেলিকম কর্মীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কর্মচারী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ন্যাশনাল ফেডারেশন অব পোস্ট অ্যান্ড টেলিকম এমপ্লয়িজ’র নেতৃত্ব দিয়েছেন কমরেড জ্যোৎস্না বসু। টেলিকমে কর্মরত মহিলা কর্মচারীদের সংগঠিত করতে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারি কো-অর্ডিনেশন কমিটিরও তিনি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন। অবসর গ্রহণের পরে তিনি পেনশনার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও এলাকায় সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কাজ করতেন। সিপিআই(এম)’র রাজ্য দপ্তর মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনে যখন টেলিফোনের বোর্ড ইপিএবিএক্স বসানো হয় তখনও তিনি প্রশিক্ষণ সাহায্য দিয়েছিলেন পার্টি কর্মীদের। কমরেড জ্যোৎস্না বসুর এক পুত্র ও এক কন্যা রয়েছেন, তাঁরা যথাক্রমে ডাঃ গৌতম বসু এবং সুস্মিতা বসু। তাঁর জামাতা নীলোৎপল বসু সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরোর সদস্য।