E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২১ মে, ২০২১ / ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

স্বল্পচর্চিত জার্মান প্রতিবাদী সোফি স্কল

তপন মিশ্র


প্রতিবাদী তরুণী সোফি স্কল (Sophia Magdalena Scholl) জার্মানির নাজিবিরোধী আন্দোলনের এক স্বল্পচর্চিত নাম। এমাসে সোফি স্কলের জন্মের ১০০ বছর পালিত হচ্ছে জার্মানির বেশ কয়েকটি স্থানে। অল্প কথায় বললে দাঁড়ায় যে, নাজি জার্মানির চ্যান্সেলর আডলফ হিটলারের একসময় চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সোফি। ফলে মাত্র ২১ বছর বয়সে তরুণী সোফিকে গিলেটিনে প্রাণ দিতে হয়। ১৯২১ সালে জার্মানির এক ছোট শহর ফরস্টেনবুর্গে (Forchtenburg) জন্মায় সোফি। তাঁদের পরিবার ছিল সচ্ছল এবং বাবা ছিলেন ওই শহরের মেয়র। পরে ওঁদের পরিবার জার্মানির এক সম্ভ্রান্ত এবং প্রাচীন শহর উল্ম (Ulm)-এ চলে আসে।

সোফির বাবা ছিলেন ঘোর হিটলার বিরোধী। ১৯৩৩ সালে যখন হিটলার ক্ষমতায় আসে তখন নাজিদের ইহুদি বিরোধিতা ছিল সোফির বাবার চক্ষুশুল। ১৯৩৩ সালের পর ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত হিটলারের নেতৃত্বে নাজিদের শাসনকে তৃতীয় সাম্রাজ্য (Third Reich বা Greater German Reich) হিসাবে ওরা দাবি করেন। নাজিদের মতে ৮০০ সাল থেকে ১৮০৬ সাল পর্যন্ত পবিত্র রোমান শাসন বা প্রথম রেইখ, ১৮৭১ থেকে ১৯১৮ ছিল পবিত্র জার্মান শাসন বা দ্বিতীয় রেইখ এবং তারপরই পবিত্র একনায়ক হিটলারের শাসন।

সোফির পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সোফি এবং তাঁর দাদা হান্স স্কল কিশোর বয়সেই নাজিদের National Socialist Party-র সমর্থক হয়ে ওঠেন। হান্স সেই সময়কার অন্যান্য অনেক কিশোরদের মতোই নাজিদের যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। সোফি যোগ দেয়  লিগ অফ জার্মান গার্লস (‘League of German Girls’) নামে আরেক নাজিবাদি সংগঠনের সঙ্গে। বাবার সঙ্গে এ নিয়ে  তাঁর বারবার বাগবিতণ্ডা  হয়।

সোফির মোহভঙ্গ

কিছুদিনের মধ্যেই ওঁদের মোহভঙ্গ হয়। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিনে কড়া শীত পড়ার ঠিক আগে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে। তখন সদ্য যৌবনা সোফি তাঁর দাদার সঙ্গে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে (Ludwig Maximilian University) চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে আসেন। একদিকে ইহুদি কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীদের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন  এবং অন্যদিকে পোল্যান্ডের নাগরিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার এই ভাইবোনদের প্রতিবাদী করে তোলে।  তরতাজা যুবকদের যাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। এটও ছিল একধরনের নির্যাতন। সোফির বাগদত্তা ফ্রিজ (Fritz Hartnagel)-কেও জোর করে সৈন্যবাহিনীতে যুক্ত করা হয়। সোফি বলত “I can’t understand how some people continuously risk other people’s lives. I will never understand it and I think it’s terrible. Don’t tell me it’s for the Fatherland.” অর্থাৎ এ আমার পিতৃ ভূমি নয়। এখানে কিছু মানুষ অন্যদের জীবন নিয়ে খেলা করে। এ এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা।

শুভ্র গোলাপের দল

১৯৪১ সালে ‘হোয়াইট রোজ’ বা শুভ্র গোলাপ নামে একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি হয়। হান্স এবং আরও বেশ কয়েকজন ছাত্রের নেতৃত্বে এই দল প্রথম আত্মপ্রকাশ করে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। পরে সোফিও এই দলে যুক্ত হয়। ১৯৮২ সালে ‘দি হোয়াইট রোজ’ (Die Weiße Rose বা The White Rose) নামে একটি তথ্য চিত্র তৈরি হয়। সেই তথ্যচিত্র থেকে হোয়াইট রোজ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। শুরুতে এই গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৬। পরে এই গোষ্ঠীর শাখা বিস্তৃত হয় হামবুর্গ, ফ্রেইবুর্গ, বের্লিন, ভিয়েনা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে। ওদের আদর্শ ছিল অহিংসা, গণতন্ত্র এবং নাজিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সোফি সহ প্রত্যেকেই ছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পারদর্শী। এঁরা ছিলেন অনেকটাই চার্চ ঘেঁষা। গা ঢাকা দেওয়ার কৌশল হিসাবে তাঁদের  চার্চের সান্নিধ্য  দরকার ছিল। কিন্তু গোপনে চলে টাইপ রাইটার এবং কপিয়ার জোগাড় করার কাজ। তৈরি হয় প্রচারপত্র। প্রথম প্রচারপত্রটির নাম ছিল ‘We won’t be silenced’ অর্থাৎ আমাদের নীরব করানো যাবে না।

এভাবেই ৫টি প্রচারপত্র প্রকাশ করার পর বিপত্তি আসে ষষ্ঠ প্রচারপত্রে। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মান সৈন্যবাহিনী রাশিয়ার স্তালিনগ্রাড দখল করে এবং অসংখ্য সাধারণ রাশিয়াবাসীকে হত্যা করে। স্কল ভাইবোন এর প্রতিবাদ করার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে এক প্রচারপত্র বিলি শুরু করে। এখানে মিউনিখের ছাত্র ও যুব সমাজকে এর প্রতিবাদ করার আবেদন করা হয় এবং জার্মান শ্রমিকদের উদ্দেশে আবেদন করা হয়, জার্মানির সমস্ত অস্ত্র কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। ১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সোফি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল ভবনের দোতালার বিশালাকার ল্যান্ডিঙের অলিন্দ থেকে প্রচারপত্র ছোঁড়ার সময় দ্বাররক্ষীর নজরে পড়ে যায়। এই দ্বাররক্ষী গেস্টাপোর (জার্নাম গোয়েন্দা পুলিশ) কাছে খবর দেয়। তারপরই সোফি এবং তাঁর দাদা হান্সকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক কুর্ট হুবারকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

মাত্র সাত দিনের মধ্যে জেরা করে হিটলারের নিযুক্ত বিচারপতি রোনাল্ড ফ্রেইস্লার হান্স, সোফি এবং ক্রিস্তফ প্রোবস্ত নামে এক ছাত্রকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। সোফিকে বিচারের সময় বলা হয় যে, বিচার শেষ হওয়ার ৯৯ দিনের পর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর  করা হবে। আসলে ঠিক তার পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, স্কলকে গিলেটিনে হত্যা করা হয়। মিউনিখ শহরের স্টাডেলহেম বন্দিশালায় (Stadelheim Prison) সন্ধ্যা ৫টার সময় তিনজনের হত্যালীলা সাঙ্গ করা হয়। পরের মাসে আরও বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আমাদের প্রেরণা

গিলেটিনে যাওয়ার আগে সোফি বলে,  “Such a fine, sunny day, and I have to go... What does my death matter, if through us, thousands of people are awakened and stirred to action?” সেদিন ছিল এক সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। জার্মানিতে ফেব্রুয়ারি মাসে রোদ খুব কমই দেখা যায়। হত্যার কয়েক মিনিট আগে সোফির আহ্বান ছিল, আমাদের মৃত্যু যেন অনেকের মধ্যে প্রতিবাদের ভাষার উদ্রেক করে। শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে সোফিকে মনে রেখে এবছর জার্মান সরকার সোফির ছবি সহ এক মুদ্রা প্রকাশ করেছে। অনেক জার্মানবাসি এখনও মনে করে যে, সোফি ওদের প্রেরণা নাজিবিরোধী আন্দোলনে।