৫৮ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২১ মে, ২০২১ / ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
গোঁড়ামি ভাঙার লড়াইতে ছিলেন ব্রজ রায়
অরুণাভ মিশ্র
মৃত্যুর পরে অঙ্গ কোষকলা ও দেহদান আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, গণদর্পণ সংগঠনের সম্পাদক বজ্র রায় গত ১৩মে, ২০২১ শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনা বিধি মেনে ১৪ই মে আর জি কর মেডিকেল কলেজে তাঁর মরদেহের প্যাথলজিক্যাল ময়নাতদন্ত করা হয়। ভারতে তো বটেই এশিয়ার মধ্যে এই প্রথম কোনো আইনি জটিলতা না থাকা অথচ কোভিডে মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা হলো। এর মাধ্যমে রোগীর ঠিক কী কী কারণে মৃত্যু হয়েছে তা জানা যায়। মৃত্যুর পর রোগের প্রকৃতি বুঝতে এই ধরনের অটোপ্সির দাবি বহু দিন ধরে করে আসছিলেন ব্রজ রায় তাঁর সংগঠন গণদর্পণের মধ্য দিয়ে। তাঁর দেহের পোস্টমর্টেম করার মধ্য দিয়ে সেই দাবি কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পেল।
ব্রজ রায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৩০ নভেম্বর। নীলাঞ্জন ও বঙ্গলক্ষ্মী রায়ের অষ্টম সন্তান ব্রজ। অর্থকষ্টের সংসারে কোনক্রমে পড়াশোনা চলতে থাকে তাঁর শিক্ষকদের অনুগ্রহে। ১৯৫৩ সাল থেকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে ঘোরাঘুরি শুরু হয় তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নাটকের টানে। আইপিটি-এর সংযোগে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ১৯৫৭ সালে, ২১ বছর বয়সে। ওই বছরই ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগে চাকরি হয় তাঁর। সারা ভারত পোস্টাল কর্মীদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে তাঁর চাকরি চলে যায় ১৯৬১ সালে। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তখন নানা আদর্শগত বিষয়ে প্রবল বিতর্ক চলছে। দলের মধ্যে নানা ছোটো ছোটো ভাগ। এর মধ্যে জালালাবাদ খ্যাত বিপ্লবী অনন্ত সিংহের এমএমজি (ম্যান-মানি-গান) গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে ভাবনার মিল হয় ব্রজর। নকশাল আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে ষাটের দশকের শুরুতে এই বিপ্লবী গ্রুপ তৈরি করেছিলেন অনন্ত সিংহ। পরে তা থেকে রেভেলিউশনারি কমিউনিস্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (আরসিসিআই) তৈরি করেন ১৯৬৫-তে। ব্রজ রায় এই দলে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে থেকেই গোপনে চলতে থাকে সশস্ত্র আদর্শে উদ্বুদ্ধ আর সি সি আই-এর কাজ। সঙ্গে চলতে থাকে থিয়েটার ঘিরে যাতায়াত। এভাবেই ব্রজ রায়ের আলাপ হয় তৃপ্তি চৌধুরীর সঙ্গে। তৃপ্তিও চলে আসেন বিপ্লবী কাজে। একসাথে পথ চলা ও যৌথজীবন শুরু হয় তাঁদের ‘বিবাহ’ প্রতিষ্ঠানটিকে অস্বীকার করেই। ১৯৬৮ সালের ১জুলাই অনন্ত সিংহের সঙ্গে পার্ক স্টিটের পোস্ট অফিস ডাকাতি ও ৩.৯৭ লক্ষ টাকা লুঠের ঘটনায় যুক্ত ছিলেন ব্রজ রায়। অনন্ত সিংহের নেতৃত্বে তারপর আলিপুরের ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ও গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্ক এবং পার্ক স্টিটের স্টেট ব্যাঙ্কে ডাকাতির মাধ্যমে ১২ লক্ষ টাকা লুঠ হয়। তাছাড়া পার্সেল বোমা এবং টাইম বোমা বিষ্ফোরণেও দক্ষতা অর্জন করেন ব্রজ সহ দলের কর্মীরা। আমেরিকান লাইব্রেরির জন্য এরকম এক পার্সেল বোমার জিপিও-তে বিষ্ফোরণ ঘটে যায়। এধরনের নানা ঘটনায় পুলিশ আরসিসিআই কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। ১৯৭০-এ ধরা পড়েন অনন্ত সিংহ। ব্রজ রায় এবং তৃপ্তি চৌধুরীও ধরা পড়ে যান রুনু গুহ নিয়োগী এবং তারাপদ চক্রবর্তীর হাতে ১৯৬৯ সিলের ১১ নভেম্বর। সাত মাস পরে তৃপ্তি চৌধুরী ছাড়া পেলেও দীর্ঘ কারাবাস চলে ব্রজ রায়ের। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার এলে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর মুক্তি পান ব্রজ রায়। জেলে থাকার সময় মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। ফলে বেরিয়ে এসেই মানবাধিকারের কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
১৯৭৭ সালেই গণদর্পণ সংগঠন তৈরি হয়েছিল। এই সংগঠনের মাধ্যমে নাট্যচর্চা, মার্ক্সীয় দর্শনচর্চা, এবং অন্যান্য সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালানো হবে স্থির হয় তখন। সম্পাদক ছিলেন তৃপ্তি চৌধুরী। রঞ্জন ঘোষ, অসিত সেনের ছেলে পিন্টু সেন প্রভৃতিরা সঙ্গী ছিলেন। নানা ঘাত প্রতিঘাতে সংগঠনে ভাঙাগড়া খেলা চলে। পরে ১৯৮৫ সালের ৫ নভেম্বর ভারতে প্রথম মরণোত্তর দেহদানকারী জেবিএস হলডেনের ৯৫তম জন্মদিনে তাঁরা স্থির করেন সংগঠনের মুখ্য কাজ হবে মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহদান। এ কাজের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মানুষকে যেমন সাম্প্রদায়িক ‘শেষ কাজ’ থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে তেমনি মৃতদেহের ওপর পরিবারের অধিকারের বদলে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে। সম্পাদক হন ব্রজ রায়। পত্রিকা সম্পাদক তৃপ্তি চৌধুরী। অঙ্গীকারপত্র তৈরি করে ৩৪ জনের ইচ্ছাপত্র জমা দেওয়া হয় বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিনিধি ডাঃ কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্যর হাতে। ১৯৯০ সালে সুকুমার হোমচৌধুরী মারা গেলে ১৮ জানুয়ারি আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে তাঁর দেহ দান করা হয়। এটিই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মরণোত্তর দেহদানের ঘটনা। ক্রমে জ্যোতি বসু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কমল বসু, বিকাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ সহ রাজ্যের বহু গুণী মানুষ ব্রজ রায়ের অনুরোধে দেহদানের ইচ্ছাপত্র পূরণ করলে এই আন্দোলনে গতি আসে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেহ ও অঙ্গদানের প্রচার প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে এবং মরণোত্তর দেহদান আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ব্রজ রায় ও গণদর্পণের উদ্যোগে মস্তিস্কের মৃত্যুর পর ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা এবং পরিবারের অনুমতিক্রমে তার যকৃত, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কর্নিয়া প্রভৃতি অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপিত করে তাকে সুস্থজীবন দেওয়ার দাবি বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সরকার কিছু পরিকাঠামো গড়ে তোলে। আজ এই সব প্রত্যঙ্গ পেয়ে বেঁচে থাকা বহু মানুষ এই আন্দোলনেরই ফসল।
ব্রজ রায় চাইতেন দেহ ব্যবচ্ছেদবিদ্যা ডাক্তারির ছাত্ররা হাতেকলমে শিখুক। তার জন্য মৃত শরীরের প্রয়োজন মেটাবে দেহদান আন্দোলন। মেডিক্যাল এডুকেশান কাউন্সিল এ দাবি অংশত মেনেছে। এই প্রত্যক্ষতা বিজ্ঞান শিক্ষার এক অন্যতম অঙ্গ। কিন্তু তাঁর একটি স্বপ্ন আজও অধরা। সেটি হলো দান করা দেহগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে প্যাথলজিক্যাল ময়নাতদন্ত করা। একাজ চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিঃসন্দেহে এগিয়ে দেবে। তাঁর দেহ অটোপ্সি করার মধ্য দিয়ে এর সূচনা হলো বলা যায়।
অঙ্গ ও দেহদান আন্দোলন এক কুসংস্কার বিরোধী, পরাবৈজ্ঞানিক ও বিপ্লবী আন্দোলন। অঙ্গ ও কোষকলা দান জাত বর্ণ ধর্ম শ্রেণির বিভেদ মুছে দেয়। শবদেহ পোড়ানোর বা কবরস্থ করার মধ্য দিয়ে আত্মার সদ্গতির যুগলালিত ধারণাকে ভাঙতে সাহায্য করে দেহদান। অঙ্গ ও কোষকলা দান মানুষে মানুষে গড়ে তোলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। শরীর ও আত্মা ঘিরে ভাববাদী ভাবনা ভেঙে যুক্তি ও বস্তুবাদী ভাবনাকে পোক্ত করা যায় এ কাজে। দূরে ঠেলা যায় পুনর্জন্মবাদকে। তাই এ কাজ বৈপ্লবিক! এই বৈপ্লবিক কাজের সঙ্গে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতিও জড়িয়ে। সুশ্রুতরা ‘নিঃশ্রেয়স জ্ঞান’ অর্জনের জন্য দেহ ব্যবচ্ছেদ করতে বলতেন। ভাববাদী পরোক্ষ চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে পাওয়া জ্ঞানের বাইরে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদী ভাবনা ছিল এর পেছনে। কলকাতাতেই ১৮৩৬-এ নতুন করে গোঁড়ামি ভেঙে তার সূচনা হয়েছিল মধুসূদন গুপ্তের হাতে। প্যাথলজিক্যাল পোস্টমর্টেমেও কলকাতা ব্রজ রায়ের মাধ্যমে ইতিহাসে জায়গা করে নিল।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, এপিডিআর, উৎস মানুষ, নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, প্রভৃতি নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নিয়মিত লিখতেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের দুটি পত্রিকায়। আকর্ষণীয় বক্তা ছিলেন ব্রজ রায়। স্নেহশীল হলেও বস্তুবাদী ভাবনার বিচ্যুতি দেখলে কঠোর হতেন! মার্কসবাদী ভাবনা আজীবন লালন করেছেন মানুষটি।
আমাদের দেশের দক্ষিণের রাজ্যগুলো দেহ ও অঙ্গদানের ব্যপারে আমাদের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে। অঙ্গ কোষকলা ও দেহদান আন্দোলনকে আরও বিকশিত করে তোলা আজকের সময়ের দাবি। তাকে পূরণ করতে রাজ্যের বিজ্ঞান আন্দোলনের সর্বতোভাবে শামিল হওয়া দরকার। এভাবেই ‘চলতে চলতে পথ’ ব্রজ রায়কে যথাযথভাবে স্মরণ করা যাবে।