৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের রাজ্য সম্মেলন
নিরাপদ সরদার
বক্তব্য রাখছেন দেবলীনা হেমব্রম। মঞ্চে জীতেন চৌধুরী, রামচন্দ্র ডোম, পুলিন বিহারী বাস্কে, রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম, শের বাহাদুর।
পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের রাজ্য সম্মেলন গত ১৫-১৬ অক্টোবর জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা আদিবাসী কলা চর্চা কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়।
১৫ অক্টোবর বেলা ১টা ৩০ মিনিটে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই সম্মেলন। পতাকা উত্তোলন করেন আদিবাসী অধিকার মঞ্চের রাজ্য সভাপতি রামলাল মুর্মু। শহিদ বেদিতে মালা দেন দলিত শোষণ মুক্তি মঞ্চের সর্বভারতীয় নেতা রামচন্দ্র ডোম, সামাজিক ন্যায় মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক অলকেশ দাস, দেবলীনা হেমব্রম, পুলিন বিহারী বাস্কে, নিরাপদ সরদার, রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম, উপেন কিস্কু সহ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের নেতৃত্ব ও গণ আন্দোলনের নেতৃত্বগণ।
সম্মেলন পরিচালনার জন্য রামলাল মুর্মু, উপেন কিসকু, সুখমইত ওঁরাও, নিরাপদ সরদার, নরেশ হেমব্রম,সুরেন হেমব্রমকে নিয়ে সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয়।
সম্মেলন উদ্বোধন করেন দেবলীনা হেমব্রম।
১৯টি জেলার ২৫৬ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। আলোচনায় অংশ নেন ৩৩ জন প্রতিনিধি।
৬ জন মহিলা প্রতিনিধি সহ ১৬ জন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নেন। অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ১৭ জন সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা করেন।
সম্মেলন প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য ৪ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করে। প্রথম দিনের অধিবেশনে ২৩ জন প্রতিনিধি ৩ ঘণ্টা আলোচনা করেন।
আলোচনার সময় প্রতিনিধিরা গণ আন্দোলনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিজেপি এবং তৃণমূল তাঁদের উপর কীভাবে আক্রমণ করছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ তুলে ধরেন।
চা বাগান এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী মানুষেরা তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন,ভূমিহীনদের পাট্টা নেই, নিজস্ব বাড়ি ঘর নেই। চা বাগানের মালিকের দয়ায় বেঁচে আছে। থাকার জন্য ছোটোছোটো ঘর করে দিয়েছে চা বাগানের মালিক। জল, আলো, রেশন ও সামান্য চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও, নেই রাস্তা ঘাট, নেই শিক্ষার সুযোগ। মালিকের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারা যায় না,পাছে বাস্তুহারা হয়ে যেতে হয়। এই ভয় কাজ করে।
বীরভূমের প্রতিনিধিরা বলেন - দেউচা পাঁচামির খোলা মুখ কয়লা খনি আদিবাসীদের বাস্তুহারা করে দেবে, ভূমিহীন হয়ে যাবে। তিলাবনী পাহাড় বিক্রি হয়ে গেছে। যে সম্পদের উপর ভর করে আদিবাসীদের জীবন জীবিকা গড়ে উঠেছে তা আজ করপোরেটদের হাতে। তিলাবনী পাহাড় ধ্বংসের পথে।
বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা বলেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কুসংস্কারের দিকে যাচ্ছে আদিবাসী সমাজ, আদিবাসীদের হিন্দুত্বে ধর্মান্তরিত করার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। ওঝা, গুণীনদের রমরমা, এমনকী ডাইনি অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে খুন করার মতো ঘটনা বাড়ছে।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের বিষয়টি উঠে আসে। তাঁরা বলেন, আদিবাসীদের ধর্ম আলাদা,তাঁরা হিন্দু নন, বনবাসী নন,তাঁরা আদিবাসী,তাঁরা পৃথক। তাঁরা প্রকৃতির পূজা করে। সারি ও সার্না তাদের ধর্ম। এই পরিচিতি যাতে সর্বত্র লিখতে পারে তার দাবিও ওঠে।
সাদরি, মুন্ডারি ও কুড়ুক ভাষার দাবি তোলেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, সাঁওতালি ভাষায় শিক্ষার উপর সরকারের প্রচণ্ড অবহেলা, অনীহা। তাঁরা বলেন, আমাদের উপরে শারীরিক, মানসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অত্যাচার যেমন চলছে, তেমনি ভাষা সংস্কৃতির উপর আক্রমণ বাড়ছে।
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার প্রতিনিধি জ্যোতিষ সরদার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচারের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে শারীরিক অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, মাথায় পলিথিন চাপিয়ে ছবি তোলা, সাদা কাগজে সই করে নিয়ে কাজ কেড়ে নেওয়া হয়। ঘরবাড়ি ভাঙচুর, তাঁর স্ত্রীর উপরেও নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। তাঁর কাজ নেই, তবুও তাকে তৃণমূল আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
বীরভূমের প্রতিনিধি বিপদতারণ সরেন বলেন, তৃণমূলের অত্যাচারী কুখ্যাত অনুব্রত মণ্ডল জেলের ভাত খাচ্ছে। এলাকার আদিবাসীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এভাবেই একের পর এক রাজ্যের প্রতিনিধিরা বিজেপি এবং তৃণমূলের অত্যাচারের ঘটনা তুলে ধরেন।
এছাড়াও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আলিপুরদুয়ারের জয়ন্ত চিক বরাইক,অর্জুন হাঁসদা, কোচবিহারের ধনঞ্জয় রাভা, জলপাইগুড়ির মনু ওরাঁও, কৃষ্ণ ওরাঁও, ভরত বড়ুয়া, দার্জিলিংয়ের প্রতাপ কুজুর, উত্তর দিনাজপুরের খেলা মুর্মু, দক্ষিণ দিনাজপুরের বিকাশ কিসকু, মালদার সরকার টুডু, মুর্শিদাবাদের পল্টন হাঁসদা, বীরভূমের পল্টু কোড়া, পূর্ব বর্ধমানের জগন্নাথ ওরাঁও, সুরভী টুডু, পশ্চিম বর্ধমানের বাইসি মান্ডি, লখিরাম মুর্মু, হুগলীর তারাপদ মুর্মু, বিপ্লব বাস্কে, নদীয়ার কালি সরদার, কল্পনা সরদার, উত্তর চব্বিশ পরগনার জ্যোতিষ সরদার, রবীন্দ্রনাথ মাহাতো, রেনুকা সরদার। কলকাতার বিজয় সিং, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিমল বাস্কে, বিরসা সরেন, ঝাড়গ্রামের হাঁড়িরাম সিং, সম্মতি সরেন, বাঁকুড়ার সঞ্জয় মান্ডি, কুনামি, বাস্কে, পুরুলিয়ার লক্ষ্মণ সরেন, পদ্মাবতী সিং সরদার।
প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে আসে আদিবাসী অধিকার মঞ্চের গুরুত্ব। তাঁরা বলেন, অন্যান্য আদিবাসী সংগঠন জাতিসত্তার রাজনীতি করে। আলাদা রাজ্যের দাবি করে। আদিবাসীদের শ্রেণিচ্যুত করে। আমরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষকে শ্রেণির মধ্যে এনে দাবি আদায়ের লড়াইয়ে যুক্ত করতে চাই। সংবিধান লিপিবদ্ধ আইন ও সামাজিক অধিকার আদায় করতে হলে শ্রেণি আন্দোলন ছাড়া সম্ভব নয়।
বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা নিজের নিজের ভাষা সংস্কৃতি নাচ গানের মধ্যে সম্মেলনকে জমজমাট করে তুলেছিলেন। তাঁরা আলোচনা ও নাচ গানের মধ্যে দিয়ে বিজেপি এবং তৃণমূলের আসল স্বরূপ তুলে ধরেছেন। জল, জঙ্গল, জমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বাসস্থান, সংরক্ষণ, কর্মসংস্থান ও কাজের দাবিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সম্মেলন প্রাঙ্গণ।
সম্মেলনে সর্বজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন হাঁড়িরাম সিং (৭৯ বছর) ও সর্ব কনিষ্ঠ মানটি ওরাঁও (১৭ বছর)।
আদিবাসী অধিকার মঞ্চের রাজ্য সম্মেলন থেকে ৫৫ জনের রাজ্য কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ জনকে নিয়ে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন রামলাল মুর্মু, কার্যকরী সভাপতি রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম, সম্পাদক পুলিন বিহারী বাস্কে এবং কোষাধ্যক্ষ হন মানিক সরেন।
১৬ অক্টোবর বেলা ৩টায় চা বাগানের শত শত আদিবাসী পুরুষ, মহিলা বর্ণাঢ্য মিছিল করে আসেন কলা চর্চা কেন্দ্রের মাঠে। আদিবাসীদের নাচ-গানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ, মাদলের বোলের তরঙ্গ যেন পৌঁছে যায় পাহাড়ের চূড়ায়। এখানে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পুলিন বিহারী বাস্কে, রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম, শের বাহাদুর, দেবলীনা হেমব্রম, জীতেন চৌধুরী ও রামচন্দ্র ডোম। সভাপতিত্ব করেন রামলাল মুর্মু।
সভায় বক্তারা বলেন, সম্মেলনে যা আলোচনা হলো এবং যা দাবি উঠেছে তা আদায় হবে তখনই, যখন বিজেপি এবং তৃণমূলকে পরাস্ত করা যাবে। সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন।