৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯
দেশকে বিজেপি’র হাত থেকে রক্ষা করাই প্রাথমিক কাজ
সীতারাম ইয়েচুরি
প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১০৩তম প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন সীতারাম ইয়েচুরি।
মঞ্চে বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম এবং সূর্যকান্ত মিশ্রসহ নেতৃবৃন্দ।
(ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১০৩তম প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণের অনুলিখন।)
১৯২০ সালের ১৭অক্টোবর তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এমএন রায় কলকাতায় কাকাবাবু, বোম্বেতে ডাঙ্গে, তামিলনাড়ুতে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার প্রমুখের কাছে এদেশের মাটিতে কমিনটার্নের নীতির ওপর ভিত্তি করে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে চিঠি লেখেন। পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে কানপুরে কমিউনিস্টদের ঐক্য সম্মেলনের পর এদেশে কমিউনিস্টরা একত্রিত হয়ে কাজ শুরু করে। পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কমিউনিস্টরা একথা বলে এসেছে যে, তাদের লক্ষ্য ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পাশাপাশি দেশের সমস্ত নাগরিকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ভারতবাসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে সাথে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার সংগ্রাম চালাতে হবে। সেই সময় ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎদের স্বপ্ন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ, শোষণমুক্ত দেশ গড়ে তোলা। কিন্তু এখন আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? গত ১০২ বছর ধরে কমিউনিস্টদের লড়াই-সংগ্রামের ফলে তিনটি নির্দিষ্ট বিষয় ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। প্রথম হচ্ছে জমি সংক্রান্ত বিষয়। আপনারা জানেন যে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে তেলেঙ্গানা সশস্ত্র বিদ্রোহ পাঁচ বছর ধরে চলেছিল। ষোল হাজার বর্গ মাইল অঞ্চলে প্রায় তিনহাজার গ্রাম শোষণ থেকে মুক্ত হয়। দশ লক্ষ একর জমি গরিব কৃষক, খেতমজুরদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। বাংলায় তেভাগা আন্দোলন, কেরালায় পুন্নাপ্রা ভায়লারের সংগ্রাম, আসামে সুরমা উপত্যকার সংগ্রাম,মহারাষ্ট্রে ওরলি আদিবাসী বিদ্রোহ ইত্যাদি কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এই সমস্ত সংগ্রামের ফলে ভূমি সংস্কার ও জমিদারি উচ্ছেদ স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অ্যাজেন্ডায় পরিণত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই অ্যাজেন্ডার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় এবং স্বাধীনতার পর জমিদার ও পুঁজিপতিদের মধ্যে সমঝোতা হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নকে সামনে আনা।১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে যখন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি পেশ করা হয়, তখন একথাও সেখানে উল্লেখিত হয় যে, স্বাধীন ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এমএন রায় লেখেন যে, ধর্ম প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় যাকে সুরক্ষিত রাখা হবে, কিন্তু স্বাধীন ভারতে ধর্মের সাথে সরকারের বা রাজনীতির কোনো যোগাযোগ থাকবে না।অর্থাৎ আমাদের দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে প্রথম উত্থাপন করে কমিউনিস্টরাই।
তৃতীয় যে বিষয়ে কমিউনিস্টদের অবদান তা ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন করা। বিশালান্ধ্র আন্দোলন, সংযুক্ত মহারাষ্ট্র কিংবা কেরালা রাজ্য তৈরির মতো ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের এই সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে থেকে শুরু হয় এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত চলে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের মাধ্যমে আধুনিক ভারতের মানচিত্র তৈরিতে কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আজকের ভারতে এই তিনটি বিষয়ের উপরেই আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের চরিত্র কী হবে তা নিয়ে পরাধীন ভারতে তিন ধরনের ভাবনাচিন্তা লক্ষ করা গিয়েছিল। কংগ্রেস গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন ভারত তৈরির কথা ঘোষণা করে। অন্যদিকে কমিউনিস্টরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের দাবি ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে হবে।
আরেকটি মত হলো ধর্মীয় পরিচিতির নিরিখে ভারতবর্ষের চরিত্র নির্দিষ্ট হবে। এই ভাবনার অংশীদার ছিল একদিকে আরএসএস, অন্যদিকে মুসলিম লিগ। আরএসএস হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে এবং মুসলিম লিগ ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করে। আপশোসের কথা এই যে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠিত হয়। তবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কখনই হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কথা বলেনি। তাই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় থেকে এই তিনটি ধারার মধ্যে যে মতাদর্শগত বিতর্ক চলছে তারই প্রতিফলন বর্তমানে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে তার মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে।
স্বাধীন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে ফ্যাসিস্ট, ভয়ঙ্কর অসহিষ্ণু হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য থেকে আরএসএস কখনো সরে আসেনি। এরই ফলস্বরূপ মোদি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমানে ভারতে সংবিধানের সমস্ত স্তম্ভের (অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা) উপরে ভয়াবহ আক্রমণ সংগঠিত করা হচ্ছে। এই চারটি স্তম্ভকেই পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে। অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একথা বলা যায় যে, আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কেবলমাত্র বেসরকারিকরণ হচ্ছে না, জাতীয় সম্পদের লুট চলছে। মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের ধ্রুপদি সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছিলেন যে, এ হলো ব্যবসার সাথে সরকার পরিচালনার একীকরণ। বর্তমানে আমাদের দেশে যে কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মেলবন্ধন লক্ষ করা যাচ্ছে তা একটি ফ্যাসিস্ট প্রবণতা। এ সময় আমাদের দেশের শিল্পপতি আদানি বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। ব্যাঙ্ক থেকে তার জন্য ঢালাও ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার ফলে তার পুঁজি ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে সমুদ্রবন্দর সহ নানা ক্ষেত্রে তার অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার। এই কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মধ্যে গাঁটছড়ার সুবাদে রাজনৈতিক দুর্নীতিকে আইনসম্মত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। ইলেক্টোরাল বন্ড চালু করে এই কাজ করা হচ্ছে যার ৮০ শতাংশ অনুদান পাচ্ছে বিজেপি। এই বিপুল অর্থের অপব্যবহার করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। নির্বাচনে না জিতেও বিভিন্ন রাজ্যে সরকার গঠন করে নিচ্ছে বিজেপি। গোয়া, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে এ ঘটনা লক্ষ করা গেছে। অর্থশক্তির এই অপপ্রয়োগকে বন্ধ করার কোনো চেষ্টা নেই, অথচ নির্বাচন কমিশন সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এ নির্দেশ দিয়েছে যে, তারা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যা দেবে তা কীভাবে বাস্তবায়িত করবে তার আর্থিক সংস্থান সম্পর্কে জানাতে হবে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা জানতে চাইছেনা যে কেন প্রতিদিন গুজরাটে গিয়ে তিনি নানা রকম উপহার দিচ্ছেন। হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়ে গেল অথচ গুজরাটে ঘোষণা হচ্ছে না যাতে এই ধরনের উপহার আরও দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।আর প্রধানমন্ত্রী এই উপহার দিচ্ছেন আমাদের ট্যাক্সের টাকায়। মনে রাখতে হবে যে কেবলমাত্র যারা ইনকাম ট্যাক্স দেন তারাই শুধু ট্যাক্স দিচ্ছেন তা নয়, আমরা প্রত্যেকে যে জিনিস কিনি তখনই তার মধ্যে ট্যাক্স ধরা থাকে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে প্রধানমন্ত্রী এভাবে উপহার দিলেও তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে না। অথচ আমরা যখন বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কথা বলছি, সব যুবর কর্মসংস্থানের কথা বলছি তখন জানতে চাওয়া হচ্ছে যে টাকা কোথা থেকে আসবে!
দেশে যখন কর্পোরেট লুঠ চলছে তখন সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। দেশে এই মুহূর্তে বেকারির হার সবচেয়ে বেশি।২০থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশ বলে অনুমান করা হচ্ছে। এখন দেশের সরকার তথ্য গোপন করে যাচ্ছে, সঠিক তথ্য সরবরাহ করছে না। অসংখ্য মানুষ কাজ খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে দারিদ্র্য বাড়ছে আর জিনিসপত্রের দাম তো অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। দেশজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে। আমাদের দেশের সরকার এই ক্ষুধা সূচক মানতে নারাজ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন সূচক কিংবা সহস্রাব্দের লক্ষ্য পূরণ সংক্রান্ত সূচক সহ সব ক্ষেত্রেই গত আট বছরে ভারত অত্যন্ত পিছিয়ে পড়েছে। এর অর্থ একটাই যে সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক সংকট ঘনিয়ে এসেছে। তাদের রুটি-রুজির উপরে যে আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে মানুষ অবশ্য ক্রমাগত সংগঠিত হচ্ছেন। এক বছর ধরে আমাদের দেশে কৃষক আন্দোলন চলেছে। সাতশোরও বেশি কৃষক শহিদ হয়েছেন। শেষমেষ কেন্দ্রের সরকার বাধ্য হয়েছে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। অন্যদিকে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের চাপে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টাও থমকে আছে। বছরে ২ কোটি কাজের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে কাজের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে দেশের যুবরা। মহিলারা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে রয়েছেন।
একদিকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক আক্রমণ চলছে ভারতে। কেউ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর এই আক্রমণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আক্রমণকে তীব্রতর করার জন্য, কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী মানসিকতাকে আরও উৎসাহিত করতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারগুলি বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করছে। কখনো লাভ জিহাদ, কখনো ধর্মপরিবর্তন সংক্রান্ত আইন তৈরি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে বুলডোজার পলিটিক্স। আমরা হিটলার শাসিত জার্মানিতে দেখেছি যে কীভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে প্রচার চালানো হয়েছিল। তারপর তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল হলোকস্টের সময়। ভারতে ঠিক একইভাবে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচার চালানো হচ্ছে এবং এই ঘৃণার ওপরে ভিত্তি করেই সংঘটিত হচ্ছে হিংসা। বিভিন্ন সশস্ত্র নজরদারি বাহিনী তৈরি করা হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে মুসলমানদের চিহ্নিত করে তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এভাবে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের সংহত করছে।
দেশের সর্বত্র এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটছে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পড়ছে। সংসদের কথাই ধরা যাক। এখানে আলোচনার সময় অত্যন্ত সীমিত হয়ে গিয়েছে। কোনো আলোচনা ছাড়াই আইন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে হাইকোর্টে অনুমোদিত জামিনকে খারিজ করার জন্য ছুটির দিনে পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট বসে যাচ্ছে। অথচ কয়েকবছর ধরে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না। সিএএ প্রণয়ন কিংবা ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার সাংবিধানিক বৈধতা অথবা ইলেক্টোরাল বন্ডের আইনগত বৈধতা ইত্যাদি সম্পর্কিত মামলা নিয়ে বেঞ্চ গঠন হয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো রকম শুনানি শুরু হয়নি।এই সমস্ত দীর্ঘসূত্রিতার জন্য সরকার নিজের খুশিমতো কাজ করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনেরও বিভিন্ন নির্দেশের মধ্যে শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে।
এই সময়ে সামাজিক ন্যায়ের আদর্শ বারেবারে লঙ্ঘিত হচ্ছে। দলিত, আদিবাসী, মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা বাড়ছে।
এছাড়া বিরোধীদেরকে লক্ষ্য করে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে আমাদের দেশে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মিডিয়ার ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ। যার ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তির সমস্ত অপপ্রচার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য যাতে মানুষের কাছে না পৌঁছায় তার জন্য মিডিয়া সদা সক্রিয়। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষের মানসিকতাকে বদলে দেওয়ার ব্যাপক প্রয়াস চলছে।
এর সাথে সাথে আমাদের রাষ্ট্রকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করবার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের উপরে ব্যাপক নজরদারি চালানো হচ্ছে। সেলফোনের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি চলছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপর ইজরায়েল থেকে কিনে আনা পেগাসাস সফটওয়ারের মাধ্যমে নজর রাখা হচ্ছে। সরকারি কর্মীরাও ওই নজরদারির আওতায় আছেন। অতীতে হিটলারের কাছে এ ধরনের প্রযুক্তি ছিল না।তার রাজত্বে ইহুদিদেরকে চিহ্নিত করার জন্য বাড়িতে নির্দিষ্ট চিহ্ন দেওয়া হতো। এখন এহেন পদ্ধতি অবলম্বন করার আর প্রয়োজন পড়বে না। আধার কার্ড, ভোটার লিস্টের তথ্য ব্যবহার করে এজাতীয় কাজ সহজেই করা যায়। এভাবে অর্থবল ব্যবহার, মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শক্তি তার প্রভাব বিস্তার করছে।
দেশজুড়ে নানাবিধ গণসংগ্রাম সত্ত্বেও নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক শক্তির জয় কেন হচ্ছে তা নিয়ে বিভিন্ন রকম চর্চা চলছে। কেউ বলছেন ইভিএমে কারচুপি হচ্ছে। ইভিএম নিয়ে সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় এটাই যে তারা মানুষের মানসিকতাকে ও চেতনার স্তরকে বদলে দেবার জন্য ব্যাপক ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মানুষের মধ্যে যুক্তি-তর্কের চর্চার প্রসার ঘটাতে হবে। গণসংগ্রামের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধের বিকাশ, বৈজ্ঞানিক চিন্তার উন্মেষ ঘটাতে না পারলে পরিস্থিতি বদলানো যাবেনা। অর্থনৈতিক সংগ্রাম এবং যুক্তিবাদী চর্চার মাধ্যমে চেতনার স্তর উন্নত করার সংগ্রাম পাশাপাশি চালাতে হবে। যুক্তিহীনতা প্রচারের উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ যাতে মনে করে যে অদৃষ্টের জন্যই তাদের এই দুর্দশা হচ্ছে। যুক্তিবাদ দুর্বল হলে মানুষ ক্রমশ ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং পৌরাণিক কাহিনি ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী এত রামায়ণ, মহাভারত থেকে উদাহরণ দেন, তার কারণ তিনি বোঝাতে চান যে সেটাই বাস্তব। এই জন্য ওরা ইতিহাসকে নতুনভাবে রচনা করতে চান। ওদের বক্তব্য যে, ১২ হাজার বছর ধরে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র ছিল। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গেলে যুক্তি-তর্ক চর্চাকে আরো প্রসারিত করা আমাদের অন্যতম কাজ।
এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতেই হবে, নয়তো সংবিধানে যে ভারতের কথা আছে তাকে রক্ষা করা যাবে না। আর এই কাজ করা সম্ভব। কেননা দেশের মানুষের মধ্যে এই সরকারকে নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার জন্য যে সমস্ত নীতি দায়ী তা বদল করতে হলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরানোর যে প্রয়াস তাতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এই জন্য আমাদের পার্টি এবং অন্যান্য বামপন্থী পার্টিগুলির শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। বামপন্থীদের মধ্যে ঐক্য জোরদার করতে হবে। কেবলমাত্র বামপন্থী দল নয়, বিভিন্ন বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেমন দলিত আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন ইত্যাদির সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এভাবে বাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যকে আরো মজবুত করতে হবে।
এছাড়া অন্যান্য যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি রয়েছে সেগুলিকে একসাথে নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। প্রাথমিকভাবে রাজ্যস্তরে এই ধরনের সম্প্রদায়িকতা বিরোধী বৃহত্তর মঞ্চ গড়তে হবে। অনেকেই বলেন যে, সর্বভারতীয় স্তরে মোদির কোনো বিকল্প নেই। এই একই কথা ২০০৪ সালেও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সেবার পরাস্ত হয় এবং বিজেপি বিরোধী ইউপিএ সরকার দশবছর চলেছিল। রাজ্যস্তরে বিজেপি বিরোধী শক্তি একত্রিত হলে এই পরিস্থিতি হওয়া সম্ভব। তামিলনাড়ুতে সমস্ত বিজেপি বিরোধী শক্তি একত্রিত হওয়ায় বিজেপি এবং তার সহযোগীরা পরাস্ত হয়েছে। বিহারে এখন নীতীশ কুমার ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সাথে শামিল হওয়ায় বিজেপি ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির পাশে যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি একত্রিত হচ্ছে, হরিয়ানায় যেভাবে বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর ঐক্য সাম্প্রতিককালে লক্ষ করা গিয়েছে তা ইতিবাচক ইঙ্গিত।
এখন পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। শিক্ষক দুর্নীতি নিয়ে আমরা দিল্লিতে কেন্দ্র সরকারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম, কিন্তু গত আট বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার চুপ করেছিল, কেননা এরাজ্যে বিজেপি-কে পা রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেস বাজপেয়ি সরকারের অংশীদার ছিল এবং আরএসএস-কে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস ভূমিকা পালন করেছে। আট বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসকে ছাড় দেওয়া ছিল কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্ত থেকে, এখন দুর্নীতিগ্রস্তদের ধরা পড়াকে অপপ্রয়োগ বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে আমরা পার্টি কংগ্রেসে আলোচনা করেছি যে, এখানে বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী ভোটকে একত্রিত করতে হবে এবং তার জন্য রাজ্যস্তরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
আজকে আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে তা কেবল বৈপ্লবিক আন্দোলনের সামনে চ্যালেঞ্জ নয়, ভারতকে রক্ষা করবার চ্যালেঞ্জ। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে রক্ষা করা যাবে নাকি তাকে ফ্যাসিস্ট হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে তাই আজ সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন। যে ভারতকে আমরা জানি, যে দেশে আমরা জন্মেছি সেই দেশকে রক্ষা করতে হলে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরাতে হবে। ভারতকে রক্ষা করতে পারলে আমরা ভারতকে শোষণমুক্ত দেশে পরিণত করতে পারব।
আর এই কাজ করতে গেলে আমাদের শ্রেণি আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে, নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে হবে, বামপন্থী ঐক্যকে মজবুত করতে হবে, বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐক্যকে জোরদার করতে হবে। নির্বাচনের সময় রাজ্যস্তরে বিজেপি বিরোধী শক্তিকে একত্রিত করতে হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তৃণমূল এবং বিজেপিকে একত্রে পরাস্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর পর জাতীয় স্তরেও বিকল্প গড়ে উঠবে।
১৯৯৬ সালে বিজেপি একক বৃহত্তম পার্টি ছিল, কিন্তু সেই সময় বামপন্থীরা এবং বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দল একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবং তারা সরকার পরিচালনা করে। ১৯৯৮ সালে আবার বিজেপি তার সহযোগী বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে নিয়ে এনডিএ গঠন করে সরকার পরিচালনা করে। ২০০৪ সালে যখন বলা হচ্ছিল বাজপেয়ির কোনো বিকল্প নেই তখন প্রথমে রাজ্যগত বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবং পরে জাতীয় স্তরে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা সম্ভব হয় এবং ইউপিএ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি আমরা প্রত্যেকটা রাজ্যে এইভাবে পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হতে পারি তাহলে সর্বভারতীয় স্তরে বিকল্প প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর এই বিকল্প প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টি এবং অন্যান্য বামপন্থী পার্টিগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।আমাদের প্রথমে ভারতকে রক্ষা করতে হবে এবং তারপর এর বদল ঘটাতে হবে। আর তার জন্য বিজেপিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা আমাদের প্রাথমিক কাজ।১০২ বছর আগে আমাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন এবং সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া। আজকে আমাদের লক্ষ্য ভারতকে রক্ষা করা এবং সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া।আর বাংলাকে বাদ দিয়ে ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন বিকশিত হতে পারেনা। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাংলার অবস্থান ছিল সর্বাগ্রে। একথা এমনি এমনি বলা হতো না যে, আজ বাংলা যা ভাবে তা দেশ ভাবে আগামীকাল। বাংলায় বামফ্রন্ট সরকার ও বামপন্থী বিকল্প শক্তিশালী না হলে অতীতে জাতীয় স্তরে যুক্তফ্রন্ট বা ইউ পি এ গঠন করা সম্ভবপর হতোনা। তাই বাংলাকে ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলন বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এখন বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বড়ো বড়ো জনসমাবেশ হচ্ছে, প্রতিবাদী আন্দোলন হচ্ছে যা সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সারাদেশে এর ফলে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি হচ্ছে। আজ বাংলার কমরেডদের সামনে এক গুরুদায়িত্ব উপস্থিত হয়েছে, যা তাঁরা পালন করার জন্য নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন।