৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯
কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতাঃ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব না আর্থিক সংকট
প্রণব চট্টোপাধ্যায়
বর্তমানে রাজ্য রাজনীতিতে রাজ্য সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষক মহাশয়দের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়াকে কেন্দ্র করে মহাবিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায় এই বিতর্কে যুক্ত করেছে এক নতুন মাত্রা। এই রায়ে বলা হয়েছে, রাজ্য কর্মচারিদের বকেয়া মহার্ঘভাতা তিন মাসের মধ্যে প্রদান করতে হবে। গত ২০ মে মহামান্য হাইকোর্ট এই রায় দিয়েছে। সর্বশেষ রায় সহ এই প্রশ্নে ৫টি রায় প্রকাশিত হলো। রাজ্য সরকার এই প্রশ্নে আর্থিক সংকটের প্রসঙ্গ তুলে তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। অথচ রাজ্যের খেলা-মেলা-উৎসব প্রভৃতির জন্য টাকার অভাব হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, বর্তমানে রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের মহার্ঘভাতা বকেয়ার পরিমাণ ৩৫ শতাংশ। ভারতের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে বকেয়া মহার্ঘভাতার পরিমাণ এই রাজ্যেই সর্বাধিক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এই রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট বা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্য সরকারি কর্মচারিরা কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা পেতেন। ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়া হয়। এই যুক্তফ্রন্ট সরকার নয় মাস স্থায়ী ছিল। যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের পর রাজ্য সরকারি কর্মচারিরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সরকারের আমলে প্রতিশ্রুতি মতো কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের প্রদান করে। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটলে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা অপসৃত হয়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সরকার প্রতিশ্রুতি মতো ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা প্রদান করে। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনে গড়ে প্রতিবছর দুই কিস্তি করে মহার্ঘভাতা রাজ্য সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষক মহাশয়দের দেওয়া হতো। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষতমাচ্যুত হয়, তখন রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের দুই কিস্তিতে ১৫ শতাংশ মহার্ঘভাতা বাকি ছিল। এর মধ্যে এক কিস্তি মহার্ঘভাতার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান বাজেটে করা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনে কার্যত মাত্র ১০ শতাংশ মহার্ঘভাতা বাকি ছিল। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ১১ বছরের শাসনে বকেয়া মহার্ঘভাতার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশ। আর্থিক সংকট বামফ্রন্ট সরকারেরও ছিল, কিন্তু তাকে অজুহাত করে কর্মচারি-শিক্ষক মহাশয়দের মহার্ঘভাতা আটকানো হয়নি।
২০১১ সালে নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রাজ্য সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষকমহাশয়দের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়া হবে। নির্বাচনে জয়ী হবার পর এই প্রতিশ্রুতি তারা ভুলে যায়। শুধু তাই নয়, এই সময়কালে গঠিত বেতন কমিশনগুলিতে বেতন কাঠামো নির্ধারণের প্রশ্নে বকেয়া মহার্ঘভাতাকে হিসাবের মধ্যে আনা হয়নি। অথচ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গঠিত প্রতিটি বেতন কমিশনে তারা পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়া হয়। এই রাজ্যগুলির ঋণের পরিমাণ কম নয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ঋণের পরিমাণ সর্বোচ্চ হলো পাঞ্জাবে। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়া হয়।
মহার্ঘভাতার অর্থ হলো মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে বেতনের যে ক্ষয় হয়, তা পূরণ করা। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এখন এই সংজ্ঞাকে পালটে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, মহার্ঘভাতা দয়ার দান এবং তা সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়ে রাজ্য সরকারের এই বক্তব্যকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৩৫ শতাংশ মহার্ঘভাতা না পাওয়ার জন্য প্রতি মাসে রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের কয়েক হাজার টাকা করে লোকসান হচ্ছে। রাজ্যের আর্থিক সংকটকে অজুহাত করে যেখানে মহার্ঘভাতা দেওয়া হচ্ছে না, সেখানে এই সংকটের কারণে মন্ত্রী, সচিব পর্যায়ের অফিসারদের কোনো কিছুই আটকাচ্ছে না। সুতরাং প্রশ্ন উঠেছে যে, আর্থিক সংকটই মহার্ঘভাতা না পাওয়ার কারণ, না রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা।
মহার্ঘভাতার আর্থিক দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে বহন করতে হবে - এই দাবিতে সারা ভারত রাজ্য সরকারি কর্মচারি ফেডারেশন দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে চলেছে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল এই দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মচারিরা একদিনের দেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করেছিলেন। এই আন্দোলনের মুখে দাঁড়িয়ে ষষ্ঠ অর্থ কমিশন মহার্ঘভাতা বাবদ রাজ্য সরকারকে ১০২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বরাদ্দকৃত এই অর্থ মহার্ঘভাতা বাবদ ব্যয় না করে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের যে ধর্মঘট-আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেস দল তার বিরোধিতা করেছে।
মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় বলেন যে, আমি তো কর্মচারিদের বেতন বন্ধ করিনি, পয়লা তারিখই কর্মচারিরা বেতন পান। এই মন্তব্যের পিছনে এক গভীর ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করছে কর্মচারিসমাজ। তাঁদের আশঙ্কা যে, পরে পেনশন, মহার্ঘভাতা বা বাড়িভাড়া ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই কলকাতা কর্পোরেশন সহ বেশকিছু কর্পোরেশন এবং মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারিদের পেনশন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে বকেয়া মহার্ঘভাতা প্রদানের দাবিতে সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষক মহাশয়দের তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।