৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯
চার্বাক-পূর্ব বস্তুবাদঃ একটি সমীক্ষা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
প্রাচীন ভারতে ভাববাদের পাশাপাশি বস্তুবাদেরও উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল - এ নিয়ে কেউ তর্ক তোলেন না। তবে দুঃখ করে কেউ কেউ বলেন - ভাববাদের এমন শক্তিশালী একটি প্রতিপক্ষ ছিল কিন্তু তার কোনো মৌলিক রচনা আমাদের হাতে এল না, সমস্ত বেমালুম হারিয়ে গেল! কেউ কেউ আবার বলেন, যদিও কোনো প্রমাণ ছাড়াই - চার্বাকদের সব বই পুড়িয়ে বা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে; তার জন্যেই ভারতের বস্তুবাদী ধারার সঙ্গে এখনকার লোকের পরিচয় আক্ষরিক অর্থেই নামমাত্র।
এখানে কয়েকটি ব্যাপার ঠিক মতো বোঝার আছে।
(এক) ভারতে বস্তুবাদের একটিই মাত্র ধারা - ছয়/পাঁচ শতক থেকে +বারো শতক অবধি বহাল ছিল না। বরং যুগে যুগে একাধিক বস্তুবাদী সম্প্রদায় দেখা দিয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় লেখা বইপত্রে তার খবর না-থাকলেও পালি ও প্রাকৃত রচনায় পাওয়া যায়। অজিত কেশকম্বলীকে আদি-বস্তুবাদী (প্রোটো-মেটিরিয়ালিস্ট) বলা হয়েছে। পরলোক নেই, পুনর্জন্ম হয় না, যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দেওয়া বৃথা - এমন অনেক কটি ‘না’ নিয়ে তিনি নিজের মত প্রচার করতেন। ইনি ছিলেন বুদ্ধর সমসাময়িক। বৌদ্ধ সাহিত্যে তাঁর মতকে উচ্ছেদবাদ বলা হয়। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দার্শনিক রচনাতে তাঁর বক্তব্যকেই বস্তুবাদ বলে সনাক্ত করা হয়েছে।
একা অজিত কেশকম্বলীই নন, পরলোক ও পুনর্জন্মে অবিশ্বাসী আরও একজনের কথা বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে পাওয়া যায়। তাঁর নাম পায়াসি বা পএসি। ইনি কোনো ছোটো রাজা বা কোনো অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তিনিও অজিত-এর কথাই বিশ্বাস করতেন (তবে তিনি অজিত-এর নাম করেননি)। নাগার্জুন, চন্দ্রকীর্তি প্রমুখ বৌদ্ধ দার্শনিক পরবর্তীকালে তাঁর কথাই উদ্ধৃত করেছেন - এমন হওয়াও সম্ভব।
জৈনদের প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ সূত্র-কৃতাঙ্গ-সূত্র ও আচারাঙ্গসূত্র-য় অনেক ধরনের গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কথা আছে যারা পঞ্চভূতের বাইরে আর কোনো সত্তায় বিশ্বাস করত না।
(দুই) কিন্তু তারপরেই একটা বিরাট ফাঁক পড়ে যায়। বস্তুবাদী দর্শনের প্রবক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে চেনা নাম হলো চার্বাক। শব্দটি কিন্তু সাধারণত বহুবচনেই ব্যবহার করা হয়। যেমন, ‘চার্বাকরা বলেছেন,’ ‘চার্বাকরা প্রতিপন্ন করেন,’ ইত্যাদি। নামটি এতই পরিচিত যে বস্তুবাদী বোঝাতে - যে সময়েরই হোক - চার্বাক নামটিই সচরাচর ব্যবহার করা হয়। মুশকিল হচ্ছে, চার্বাক একজন ব্যক্তির নাম, লোকায়ত বা বার্হস্পত্য বা নাস্তিক-এর প্রতিশব্দ হিসেবে নামটি পাওয়া যায়, কিন্তু চার্বাক-এর পরে মত বা দর্শন শব্দটি না দিলে এটি কোনো দার্শনিক সম্প্রদায়ের মূল নীতি বোঝায় না। ফলে বুদ্ধর সময়েও চার্বাকরা ছিলেন - কথাটি অর্থহীন। +আট শতকের আগে ভারতের কোনো ভাষায় চার্বাক বলতে কোনো দার্শনিক বা দর্শন সম্প্রদায়ের অনুগামী বোঝাত না। তার পর থেকেই +বারো শতক পর্যন্ত নানা নামে (দেহাত্মবাদী, ভূতচৈতন্যবাদী ইত্যাদি) বস্তুবাদের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকারঃ চার্বাকরা ভারতে এখনও পর্যন্ত আমাদের জানা শেষ বস্তুবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তার পর থেকেই তাঁদের বইপত্র কোনো অজানা কারণে কোথায় হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন হলোঃ তাহলে কি – ছয়/পাঁচ শতক আর +আট শতকের মধ্যে বস্তুবাদ বলে ভারতে আর কিছু ছিল না? সুখের বিষয় এর উত্তর প্রাচীন তামিল সাহিত্যে বহুকাল ধরেই মজুত ছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, তার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। তামিল মহাকাব্য মণিমেকলাই (+চার শতক থেকে +সাত শতকের মধ্যে কোনো সময়ে লেখা)-তে শুধু বস্তুবাদী দর্শনই নয়, ভারতের অনেক ক’টি দর্শনেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই মহাকাব্যর নায়িকার নাম মণিমেকলাই। দাক্ষিণাত্যের নানা অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন; বেশ কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রবক্তাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যেকের দার্শনিক মতের বিবরণ তিনি শুনছেন। সর্গ ২৭-এ এই কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের নাম আছেঃ লোকায়ত, বৌদ্ধ, সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক আর মীমাংসা। এই ক’টি সম্প্রদায়ের আচার্য হলেন যথাক্রমে বৃহস্পতি, জিন (বুদ্ধ), কপিল, অক্ষপাদ (গৌতম), কণাদ আর জৈমিনি। তামিলে অবশ্য নামগুলি একটু অন্যরকম। আচার্যদের নামের ক্ষেত্রেও তামিল রূপই দেওয়া হয়েছে (২৭।৭৮-৮২) এগুলি ছাড়াও অবশ্য শৈব, বৈষ্ণব, ইত্যাদি মতের কথাও আছে।
লক্ষ করার বিষয় হলোঃ সংস্কৃত নামের পাশাপাশি কোনো কোনো পারিভাষিক শব্দর নামও পাওয়া যায়। যেমন প্রমাণ, অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানের উপায়, বলে যে কটির নাম করা হয়েছে সেগুলির কয়েকটি সংস্কৃত, কয়েকটি তামিল। সে যা-ই হোক, প্রমাণগুলি হলোঃ প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ (আগম), উপমান, অর্থাপত্তি ও অভাব (২৭।৮৩-৮৫)।
এর থেকে বোঝা যায়ঃ বস্তুবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে লোকায়ত ও বৃহস্পতির নাম +আট শতকের আগেই জানা ছিল, যদিও ‘চার্বাক’ নামটি এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বদলে লোকায়ত ছাড়াও পূতবাদ (সংস্কৃতঃ ভূতবাদ) নামে অন্য একটি বস্তুবাদী মতের নাম জানা যাচ্ছে। এমন একজন ভূতবাদীর কাছে মণিমেকলাই তাঁর দার্শনিক মত জানতে চান। সেই ভূতবাদী শুধু নিজ মতের কথাই বলেন না, লোকায়তদের সঙ্গে কোথায় তাঁদের মেলে না, সেকথাও জানান (২৭।২৬৪-৭৩)। তিনি বলেনঃ
ফুল, গুড়, ইত্যাদি মেলালে যেমন মাদকশক্তি উৎপন্ন হয়, তেমনি ভূতগুলি মিলিত হলে উৎপন্ন হয় চেতনার। প্রমাণের মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষই স্বীকার করার যোগ্য, এমন কি অনুমানও বর্জনীয়। বর্তমানে যা আছে আর বর্তমান জীবনে আমরা যা ভোগ করি, সেগুলোরই অস্তিত্ব আছে। অন্য এক জীবন আছে, আমাদের কর্মফল সেখানে ভোগ করা যায় - এমন দুটি ধারণাই ভুল (২৭।২৬৪-৭৬। সংক্ষেপিত)
মণিমেকলাই প্রাচীন তামিলে লেখা একমাত্র বৌদ্ধ রচনা; শুধু তামিলে নয়, গোটা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে এই মহাকাব্যটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। সেতলাই সাতনার ও ইলাঙ্গ দুজনে এই মহাকাব্যটি রচনা করেছিলেন। বইটির একাধিক সংস্করণ ও অন্তত একটি টীকাগ্রন্থ পাওয়া যায়; ইংরেজিতে তিনটি অনুবাদ দেখার সুযোগ হয়েছে। তামিল সাহিত্যের ইতিহাস তথা তামিলনাড়ুতে ধর্ম ও দর্শনের অতীত কথা জানতে হলে মণিমেকলাই পড়তেই হয়। কিন্তু যে কারণেই হোক ভারতে বস্তুবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে যাঁরা অনুসন্ধান করেছেন, তাঁদের প্রায় কেউই বোধহয় এই মূল্যবান রচনাটির কথা জানতেন না। অথচ বস্তুবাদের ইতিহাসে চার্বাকপূর্ব ধারার দুটি সম্প্রদায়ের কথা এখানে পাওয়া যাচ্ছেঃ লোকায়ত ও ভূতবাদ। ভূতবাদ নামটি জৈন ঐতিহ্যে পাওয়া গেলেও (+নয় শতকে শীলাঙ্ক-র সূত্রকৃতাঙ্গসূত্রবৃত্তি, ১।১।৭-৮, পৃ.১০-১১) সেটি যে আদতে চার্বাক বা লোকায়তর প্রতিশব্দ নয়, বরং অন্য একটি বস্তুবাদী মতের নাম - মণিমেকলাই না-থাকলে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানা যেত না। আরও দেখবার এই যে, ইংরেজি মেটেরিয়ালিজম্ শব্দটি ভূতবাদ-এর একেবারে আক্ষরিক তর্জমা।
মণিমেকলাই আগাগোড়াই উদ্দেশ্যমূলক রচনা। অন্য সব ধর্মদর্শনের তুলনায় বৌদ্ধমতের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করাই ছিল তার রচয়িতাদের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তারই ফাঁকে ফাঁকে দক্ষিণ ভারতে ধর্ম ও দর্শন সম্প্রদায়গুলির বিষয়ে অনেক খবর এতে পাওয়া যায়। বিশেষকরে বস্তুবাদের ইতিহাস পুনর্গঠন করতে এই তামিল মহাকাব্যটি হারিয়ে–যাওয়া খেই ধরিয়ে দেয়। একদিকে, আদি-বস্তুবাদ আর পুরোপুরি দর্শনপ্রস্থান হিসেবে লোকায়ত আর ভূতবাদ - এদের মধ্যে মণিমেকলাই–এর বিবরণ এক যোগসূত্র। অন্যদিকে, চার্বাক-পূর্ববস্তুবাদ আর চার্বাক মত - এই দু-এর মধ্যেও ঐ বিবরণটি যোগসূত্রর কাজ করে। পালি সাহিত্যে অজিত কেশকম্বল ও পায়াসি (জৈন সাহিত্যে যাঁর নাম পএসি) এঁরা দুজন আদি নাস্তিক। পরলোক ও জন্মান্তরকে তাঁরা বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এ হলো শুধুই পরমতত্ত্ব (অন্টোলজি)। পুরোপুরি দর্শনপ্রস্থান হতে গেলে এর সঙ্গে জ্ঞানতত্ত্ব (এপিসটোমোলজি), অধিবিদ্যা (মেটাফিজিক্স), নীতিবিদ্যা (এথিক্স্) ইত্যাদিও থাকা চাই। মণিমেকলাই-তে দেখা যাচ্ছেঃ এমন অন্তত ছটি দর্শনপ্রস্থান (ভূতবাদকে ধরলে, সাতটি) আর সেগুলির পাশাপাশি কয়েকটি বৈদিক ও অবৈদিক ধর্মসম্প্রদায় +সাত শতকের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যে রীতিমত জায়গা করে নিয়েছিল।
দ্বিতীয় কথা, পালি ও সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘লোকায়ত’ শব্দটি অতীতে, এমনকী +প্রথম/দ্বিতীয় শতকেও, ব্যবহার হতো বিতণ্ডাসত্থ বা বিতণ্ডাশাস্ত্র বোঝাতে। কিন্তু মণিমেকলাই-তে দেখা যাচ্ছেঃ +চার ও +সাত শতকের মধ্যেই লোকায়ত বলতে একটি বস্তুবাদী দর্শন প্রস্থান বোঝায়। ওদিকে, +আট শতকেই দেখা যায়ঃ চার্বাক, নাস্তিক, বার্হস্পত্য আর লোকায়ত - এই চারটি নাম একে অপরের সমার্থক; লোকায়ত শব্দটির যে অর্থ আগে ছিল সেটি আর চালু নেই। কোন সময় থেকে ‘লোকায়ত’র দ্বিতীয় অর্থটি (=বস্তুবাদীদর্শন) প্রধান হতে শুরু করেছে - তার নিশানাও ঐ তামিল মহাকাব্যে পাওয়া যায়।
কোথায় কোথায় চার্বাক-পূর্ব মতগুলির সঙ্গে চার্বাকমত আলাদা? তফাৎ হয় মূলত চারটি জায়গায়ঃ
ক) চার্বাক-পূর্ববস্তুবাদীরা ছিলেন ভূতপঞ্চকবাদী; চার্বাকরা ছিলেন ভূতচতুষ্টয়বাদী। মাটি, জল, বাতাস আর তেজ (আগুন) ছাড়া আকাশ (বা ব্যোম বা শূন্য) বলে পঞ্চম কোনো ভূত চার্বাকরা মানতেন না।
খ) চার্বাক-পূর্ববস্তুবাদীরা (অন্তত ভূতবাদীরা) দু-ধরনের পদার্থে বিশ্বাস করতেনঃ নির্জীব আর সজীব। সজীব থেকে জীবন আসে, শরীর আসে নির্জীব থেকে। চার্বাকরা অমন দুটি সত্তায় বিশ্বাস করতেনঃ সজীব-নির্জীব সব বস্তুই চতুর্ভূত থেকে উৎপন্ন / অভিব্যক্ত হয়েছে। শরীর থাকলে তবেই চেতনার উদ্ভব হতে পারে।
গ) চার্বাক-পূর্ববস্তুবাদীরা (অন্তত তাঁদের কেউ কেউ) ছিলেন যদৃচ্ছাবাদী, কার্যকরণ সম্পর্কে আস্থাহীন; চার্বাকরা কার্যকারণ ভাব অর্থে স্বভাব-কে মানতেন।
ঘ) চার্বাক-পূর্ববস্তুবাদীরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলতেন; চার্বাকরা কিন্তু প্রত্যক্ষ ছাড়াও লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান বা উৎপন্ন-প্রতীতিকে প্রমাণ বলে স্বীকার করতেন। তার মানে, ঈশ্বর, পরলোক, সর্বজ্ঞপুরুষ, ইত্যাদি বাদে যেসব ব্যাপার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় (যেমন, ধোঁয়া থেকে আগুনের অনুমান) - সে জাতীয় অনুমানে তাঁদের আপত্তি ছিল না।
মণিমেকলাই–এর সঙ্গে তত্ত্বসংগ্রহ, ন্যায়মঞ্জরী, স্যাদ্বাদরত্নাকর ইত্যাদি মিলিয়ে পড়লে এটা সত্যিই বেরিয়ে আসে।
________________________________________
(এই প্রবন্ধে যেসব প্রাথমিক ও হাত ফেরতা উৎস থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে সেগুলির পুরো তালিকা দিতে অনেক জায়গা লাগবে।)
(সৌজন্যে ‘ঋতবাক’ পত্রিকা।)