E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯

কৃষ্ণদা

পবিত্র সরকার


একজন কবি ও লেখক, কিংবা গণমানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে মিছিলে-হাঁটা লোক - এই সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়গুলি কোনও ব্যক্তির পক্ষে যেমন, তাঁর গুণগ্রাহীদের পক্ষেও তেমন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাঁর প্রয়াণে সেগুলিই মূল আলোচ্য হওয়া দরকার। কারণ সেগুলিই তাঁর জীবনের প্রধান ভূমিকা, বলা যায় ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাঁর জীবনচরিত যদি লেখা হয় তাতে এই ভূমিকাগুলির কথাই সবিস্তারে বলা হবে। বিশেষ করে যাঁরা তাঁকে জানতেন না, সাংবাদিক বা অন্য প্রজন্ম, তাঁকে ওই সূত্রগুলির মধ্যেই সন্ধান করবেন।

কিন্তু কৃষ্ণদা বা কবি কৃষ্ণ ধরের সম্বন্ধে, নিশ্চয়ই আরও অনেকের সম্বন্ধে, কিছু লিখতে গেলে, বিশেষত যাঁরা তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা যদি লেখেন, তবে শুধু ওই প্রকাশ্য ইতিহাস-চিহ্নিত কথাগুলি বলে শেষ করা যাবে না। তাতে তাঁর পুরো পরিচয়ও ফুটে উঠবে না। আমাদের অনেকের কাছে ওই ঐতিহাসিক পরিচয়ের বাইরেও কৃষ্ণদার একটি ভিন্ন পরিচয় আছে। তা হলো একটি অত্যন্ত সুভদ্র সজ্জন এক মানুষ, যাঁর স্নেহের ভাণ্ডার ছিল অকৃপণ; আমরা তাঁর কাছ থেকে অনুজের প্রশ্রয় পেয়েছিলাম। অতিশয় মৃদুভাষী, বাধ্য না হলে সম্মুখের সারিতে এসে বসতে একান্ত অনিচ্ছুক, নিজেকে কখনই বিজ্ঞাপনে প্রক্ষেপ করতে চাইতেন না তিনি। তাঁর প্রয়াণে একটি অসামান্য মানুষের অনুপস্থিতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেটাই আমাদের কাছে বড়ো হয়ে বাজছে। সাংস্কৃতিক শূন্যতার বিষয়টা তো আছেই।

(দুই)

কৃষ্ণদা জন্মেছিলেন ১৯২৮-এ বর্তমান বাংলাদেশের প্রাক্তন ময়মনসিংহ জেলার এক গ্রামে, তবে দেশভাগের মুহূর্তেই কলকাতায় এসে অর্থনীতিতে অনার্স পড়েন স্কটিশ চার্চ কলেজে। বিস্ময়ের কথা, এম.এ.-তে পাঠ্যবিষয় বদলে যায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে, আর ১৯৪৯ সালে এম এ পাস করে দক্ষিণ কলকাতার দেশবন্ধু গার্লস কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। কিন্তু জীবিকারও বদল ঘটে অচিরেই এবং তখন কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী প্রকাশিত বাংলা দৈনিক পত্রিকা যুগান্তর-এ সাংবাদিকতার কাজ গ্রহণ করেন। দেশভাগের পরক্ষণে ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ ইত্যাদি স্মৃতিমেদুর রচনা প্রকাশ করে এ পত্রিকাটি বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যুগান্তর-এই কৃষ্ণদার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবন কাটে, নানা পদাধিকারে। তবে ১৯৯০-১৯৯২-এর পরিসরে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত দৈনিক বসুমতী-র সম্পাদনা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। এ ছাড়াও সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, ভারতীয় বিদ্যাভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে সাংবাদিকতার অধ্যাপনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, রবীন্দ্র সদন, পশ্চিমবঙ্গ মাস মিডিয়া সেন্টার ইত্যাদিতে তিনি নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সভাপতি ছিলেন। আজীবন বামপন্থী এই মানুষটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন, সংগ্রামী মানুষের পাশাপাশি থেকেছেন।

(তিন)

তবু কবি (সেই সঙ্গে কাব্যনাট্যকার) হিসেবেই তাঁর প্রধান পরিচয় আর স্বীকৃতি, এবং তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে কবিতার বইয়ের সংখ্যাই সর্বাধিক। সেগুলি হলো, অঙ্গীকার (১৯৪৮), যখন প্রথম ধরেছে কলি (১৯৫৫), এক রাত্রির জন্য (১৯৬০), এ জন্মের নায়ক (১৯৬২), আমার হাতে রক্ত (১৯৬৭), কালের নিসর্গ দৃশ্য (১৯৬৮), দুঃসময় কবিতার লেখকের কাছে (১৯৭২), কালের রাখাল তুমি ভিয়েতনাম (১৯৭৪), যে যেখানে আছো (১৯৭৬), শব্দহীন শোভাযাত্রা (১৯৮১), হে সময়, হে সন্ধিক্ষণ (১৯৮১), গাঙচিলের স্বপ্ন ও সাতরঙা রামধনু (২০০৫), প্রিয় বাক্, কথা রাখো (২০০৬), হাঁটবো, থামবো না (২০০৮)। এর পরে বেরিয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা আর কবিতা সংগ্রহ।

তাঁর কাব্যনাট্য সংগ্রহের মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো কালের নিসর্গ দৃশ্য (১৯৬৮), পদধ্বনি পলাতক (১৯৭৪), বনজ্যোৎস্না ও সমবেত করতালি (১৯৮৬), বিরুদ্ধ বাতাস (১৯৮৯), পায়ের শব্দ শোনা যায় (২০০০), নির্বাচিত কাব্যনাট্য আর কাব্যনাট্য সংগ্রহও বেরোয় এই শতকের প্রথম দশকের মধ্যে। তিনি এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যনাট্যকার। গদ্যরচনাও বেশ কিছু আছে, ভারী হৃদ্য ছিল তাঁর গদ্য। বিদুর, মল্লিনাথ, অন্যদর্শী ইত্যাদি ছদ্মনামেও লিখতেন। ভ্রমণকাহিনি মস্কো থেকে ফেরা (১৯৭৪), অন্য দেশ, অন্য নগর (১৯৮১), ঝাঁকি দর্শন (২০২১), জীবনস্মৃতিচারণ পুরানো আখরগুলি (২০১৩), আট দশক সাত কাহন (২০১৬) যেমন সুখপাঠ্য, তেমনই তাঁর নানা আলোচনাগ্রন্থ - আধুনিক কবিতার উৎস, সাহিত্যের সাজঘর এমনকী স্পষ্টবাদী সাংবাদিকতার দর্শনঃ আদর্শ ও বিচ্যুতি, সেইসঙ্গে সহজ ইতিহাসব্যাখ্যানও (মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে বাংলা, কলকাতা তিন শতক, দেশনায়ক সুভাষ,সংগ্রামী সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়) সমান চিত্তাকর্ষক।

বিশ শতকের দশ বা কুড়ির বছরগুলিতে জন্মেছিলেন যে সব কবি, তাঁদের অধিকাংশই চল্লিশের বছরগুলি থেকে কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এবং পরে আরও দু-তিন দশক ধরে তাঁদের কবিতাসৃষ্টি অব্যাহত থাকে। তাঁদের মধ্যে, এ ধরনের ভাগ কখনোই নিখুঁত হয় না, তবু মনে হয় দর্শনগত দুটি ভাগ ছিল। এক দল স্পষ্টতই বামপন্থী, এবং ভারতের মানুষদের দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর শোষণ নিয়ে মুখর হয়েছেন এবং বিপ্লবের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পোষণ করেছেন। অরুণ মিত্র, বিমলচন্দ্র ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দিনেশ দাস, মণীন্দ্র রায়, অল্পবিস্তর ভাবে সমর সেন, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু প্রমুখ তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহ নানা ভাবে গণনীয় ছিলেন, কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিশিষ্টতা তুলনায় অনেক বেশি প্রাবল্য লাভ করে, এবং সময় এ দুজনকে বামপন্থী কবিতা-উচ্চারণের মুখ্য প্রতিনিধি হিসেবে সম্মুখে স্থাপন করে। অন্যদিকে ছিলেন জীবন ও প্রকৃতির সৌন্দর্যমুগ্ধ ‘লিরিক’ কবিরা, যাঁদের কবিতা রাজনৈতিক বক্তব্যের অনুপস্থিতির দ্বারাই চিহ্নিত ছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন অশোকবিজয় রাহা, হরপ্রসাদ মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ প্রমুখ।

মতাদর্শের তফাত যাই হোক, এঁদের কবিতার ভাষা তিরিশের বছরগুলির কবিদের (প্রেমেন্দ্র মিত্র আর ‘কল্লোল’-এর কবিরা ব্যতিক্রম বলে ধরতে হবে) - যেমন বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দের - কাব্যভাষার ব্যক্তিত্বচিহ্নিত, কখনও দুর্বোধ্য বলে অভিযুক্ত শৈলী থেকে অনেকটা সরে আসে। আবার পরের কেউ কেউ বামপন্থার সঙ্গে ব্যক্তিগত মানবিক সুখদুঃখের লিরিক প্রবণতাকেও গ্রহণ করেন। আগের কবিরাও এই সমন্বয করার চেষ্টা যেমন করেছেন, পরের কৃষ্ণ ধর বা শঙ্খ ঘোষের কবিতাতেও এই অভিমুখ দেখা যাবে। বলা বাহুল্য, সকলের ক্ষেত্রে এই সমাজমুখিতা আর ব্যক্তিমুখিতার অনুপাত এক ছিল না, তা হওয়ার কথাও নয়। এঁদের অনেকের কবিতাই সময়বদ্ধ, সমাজ, প্রতিবেশ, সমসাময়িক রাজনীতি ইত্যাদির প্রতি মনোযোগী ছিল, যেমন কৃষ্ণদার বেশ কিছু কবিতার বইয়ের নামের মধ্যেই তার চিহ্ন আছে। তবু তারই মধ্যে কৃষ্ণদার কয়েকটি ছত্র আমরা দেখি -

এ শহরকে চেনো না তুমি মহারাজ
হাততালি দিলে ঘর থেকে পিলপিল করে
বেরিয়ে পড়ে অক্ষৌহিণী সেনা
এরা সব সংশপ্তক
হাজার বছর ধরে মার খেতে খেতে
এ মাটি এখন পাথর
এ বড় কঠিন শহর মহারাজ
দ্যাখো কী বেইজ্জত অশ্বমেধের ঘোড়া
ময়দানে গিয়ে মুখ দেয় অর্বাচীন ঘাসে।


কিংবা,

একটি শিশুর মুখে হাসি ফোটাবার জন্য
আমার সবচেয়ে প্রিয় বইটা তাকে দিয়ে দিতে পারি।
আমার লেখাপড়া আমার কাছে খুবই জরুরি
কিন্তু যে শিশুটি একা একা কাঁদছে
মা কখন বাড়ি ফিরবে এই আশায় আশায়
আদুল গায়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে ধুলোয়
তার জন্য আমি সব কাজ ফেলে রেখে চলে আসতে পারি।


যে কবি বলেন ‘ভালোবাসা সব কিছু পারে’ সে কবি, মনে হয়, ব্যক্তির আত্মগত উচ্চারণের মধ্যেই বামপন্থার নির্যাসটুকু তুলে নিয়েছেন।