৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯
হিজাব বিতর্ক - সুপ্রিম কোর্টের খণ্ডিত রায় এবং কিছু কথা
সেখ সাইদুল হক
গত ১৩ অক্টোবর, ২০২২, হিজাব মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় খণ্ডিত আকারে এসেছে। দুই সদস্যের বেঞ্চের বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পড়ার বিরুদ্ধে মত দিলেন। অপরদিকে বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া হিজাব পড়ার বিষয়টিকে নিষেধাজ্ঞা না করে ব্যক্তি-পছন্দের ওপর ছেড়ে দিতে বললেন। দুই বিচারপতি পৃথকভাবে নিজেদের পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছেন। বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তের মতে সরকারি অর্থে পোষিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো একটি ধর্ম সম্প্রদায়কে তার ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করার অনুমতি দিলে, তা ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী কাজ হয়। তাই সরকার-পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের ধর্মনিরপেক্ষ পোশাক বিধি মেনে চলতে বলার এক্তিয়ার অবশই রাষ্ট্রের আছে।
অপরদিকে বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়ার মতে, হিজাব ধর্মাচরণের অঙ্গ হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। সবার ওপরে এটি ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকার মুখে কোনো ছাত্রীকে হিজাব খুলতে বলা মানে তার ব্যক্তিগত পরিসরের ওপর হস্তক্ষেপ করা। এটি ব্যক্তিগত মর্যাদা এবং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের উপর আঘাত। এতে সংবিধানের ১৯ (১ক), ২১ এবং ২৫(১) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হয়। বিচারপতি ধুলিয়া তাঁর পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, নারী শিক্ষার দিক থেকেও হিজাব নিয়ে জবরদস্তি করলে বা আইন করে বন্ধ করলে তা ক্ষতিকারক হতে পারে। তাঁর মতে বহু রক্ষণশীল সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নে হিজাব হলো অন্যতম ছাড়পত্র। ফলে হিজাব নিষিদ্ধ করলে সংখ্যালঘু সমাজের একটা বড়ো অংশের ছাত্রীদের পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
দুই বিচারপতির এই খণ্ডিত রায়ের ফলে মামলাটি এবার উচ্চতর বেঞ্চে যাবে। প্রধান বিচারপতি সেই বেঞ্চ গঠন করবেন। যতদিন না সেখানে মামলা নিষ্পত্তি হয়, ততদিন হিজাব নিষিদ্ধ করে কর্ণাটক সরকার যে নির্দেশনামা জারি করেছে, এবং কর্ণাটক হাইকোর্ট তাকে মান্যতা দিয়েছে, তা বজায় থাকবে। তাই হিজাব বিতর্ক এখন সুপ্রিম কোর্টে বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারাধীন।
বিচারাধীন এই বিষয়ে খণ্ডিত রায়ের প্রশ্নে কোনো মন্তব্য না করে আমি এই নিবন্ধে হিজাব বিতর্ক নিয়ে কিছু বলতে চাইছি আমার ব্যক্তিগত অভিমত হিসাবে।
বর্তমান পটভূমি
কর্ণাটকের উদুপি এবং চিকমাগালুরের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধকরণকে কেন্দ্র করে গত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়েছে বিতর্ক ও আন্দোলন। সংঘ পরিবার হিজাব নিষিদ্ধকরণের পক্ষে তার অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কর্মীদের গেরুয়া ওড়না পরিয়ে এবং জয় শ্রীরাম স্লোগান তুলে পথে নামিয়েছে। মাণ্ডিয়ার এক কলেজ ছাত্রী মুসকানের সাথে কী হয়েছে, তা আমরা জেনেছি, টিভিতে দেখেছি। ফলে বিষয়টি রাজনৈতিক বিতর্কে পৌঁছে যায় এবং আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ইতিমধ্যে গত ৫ ফেব্রুয়ারি কর্ণাটকের সরকার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করে সরকারি নির্দেশনামা জারি করে। সরাসরি হিজাব কথাটি না বলে কর্ণাটক শিক্ষা আইনের ১৯৮৩ সালের ১৩৩(২) ধারা প্রয়োগ করে শিক্ষা বিভাগের সরকারি নির্দেশনামায় বলা হয়, একই ধরনের পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের পছন্দমতো পোশাক ঠিক করবে। আর সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি কোনো ইউনিফর্ম বাছাই না করে থাকে, তাহলে সেইসব প্রতিষ্ঠানে সমযোগ্যতা, অখণ্ডতা ও সরকারি নির্দেশের ব্যাঘাত ঘটায়, এমন পোশাক পরা যাবে না। বলা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো মা সরস্বতীর মন্দির। এখানে তালিবানিকরণ বরদাস্ত করা হবে না। অথচ ওই শিক্ষা দপ্তরই আর এক নির্দেশনামায় বলেছে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের অঙ্গ হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘সূর্য নমস্কার’ কর্মসূচি পালন করতে হবে।
সংঘ পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি
মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার বিষয়ে সংঘ পরিবার এবং তার শাখা-প্রশাখাগুলির আপত্তি দীর্ঘদিনের। সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করতে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি উঠেপড়ে লেগেছে। অতীতে গুজরাট এ বিষয়ে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ, আসাম এবং হরিয়ানার বিজেপি সরকারগুলি এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। অপরদিকে কেন্দ্রের মোদি সরকার সংঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করতে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে, নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করেছে, গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে নানা ফরমান জারি করেছে, তিন তালাক বাতিল করার পরে একটি দেওয়ানি বিধিকে ফৌজদারি বিধিতে পরিণত করেছে। এখন মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নে উঠেপড়ে লেগেছে। এই পটভূমিতেই কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধকরণের নির্দেশনামাকে দেখতে হবে। উত্তর প্রদেশের ভোটের মুখে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণাকে আরও তীব্র করতেই কর্ণাটকের বিজেপি সরকার এই নিদের্শনামা জারি করেছে।
হিজাব প্রথা
ধর্মীয় আচার ও পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে চলেন এমন পরিবারের মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা বাড়ির বাইরে গেলে হিজাব পরিধান করে যায়। হিজাব প্রথা হলো ওড়নার মতো একখণ্ড কাপড় দিয়ে মাথা, চুল, ঘাড়, গলাকে ঢেকে রাখা। মুখ খুলে রাখা হয় অথবা নাক পর্যন্ত ঢেকে রাখা হয়। হিজাব বোরখা নয়। বোরখা মাথা সহ সারা শরীর ঢেকে পরা হয়। চোখের সামনে কিছু ছিদ্র থাকে দেখার জন্য। মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরতেই হবে, এমন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নেই। কোরান শরিফের ২৪ নম্বর সুরায় নারী ও পুরুষ উভয়কেই ভদ্র শালীনতা বজায় রাখা যায়, এমন পোশাক পরার কথা বলা আছে। বলা আছে মেয়েরা তাদের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলিকে ঢেকে রাখবে এবং নিজেদের সৌন্দর্য ও অলঙ্কারের প্রদর্শন করবে না। সুরা ৩৩-এ বলা হয়েছে, মেয়েরা বাড়ির বাইরে গেলে পোশাকের ওপর একটি বাড়তি পর্দা বা চাদর চড়িয়ে মাথা, চুল, গলা, মুখমণ্ডলের নিচের অংশ ঢেকে রাখবে। ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদরা হাদিস উল্লেখ করে বলেন, হজরত মহম্মদের সময়ে হিজাব বলতে বোঝাতো একটি পর্দা, যা দিয়ে বাড়ির মেয়েদের আড়ালে রাখা হতো, যাতে বাড়িতে অতিথি বা অন্য কোনো অপরিচিত পুরুষ এলে মেয়েদের দেখতে না পায়। মেয়েরা বাড়ির বাইরে গেলে হিজাব পরে যাবে, যাতে তাদের ক্রীতদাসী না ভাবে কিংবা লোলুপতার শিকার না হতে হয়। সেই সময় ক্রীতদাসী ও পতিতাদের হিজাব পরার অধিকার ছিল না। কেবল সম্ভ্রান্ত বা অভিজাত মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরতো। বর্তমান দুনিয়ায় মুসলিম দেশসমূহে এক এক দেশে এক একরকম নীতি চালু আছে। সৌদি আরবে এবং কাতারে হিজাবকে ড্রেস কোড হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন দ্বারা পরা বাধ্য করা হয়নি। অপরদিকে ইরান ও আফগানিস্তানে এবং ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি প্রদেশে হিজাব পরা আইনত বাধ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল আমল বা ব্রিটিশ আমলে একে আইনত বাধ্য করা হয়নি। স্বাধীন ভারতে কোনো রাষ্ট্রীয় বিধান লাগু করা হয়নি। এমনকী পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইসলামি রীতিকে মান্যতা দেওয়া হলেও আইন জারি করে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এটা মুসলিম মেয়েদের নিজস্ব রুচি ও বিচারবিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ইসলামি আদর্শ ও রীতিনীতির মান্যতার উপর ছেড়ে দিয়েছে।
হিজাব কি কেবল ইসলামি প্রথা
অনেকে মনে করেন হিজাব হলো পুরোপুরি একটি ইসলামি প্রথা। কিন্তু তা নয়। ইসলামি ব্যবস্থা আগমনের পূর্ব হতেই বহু দেশে, এমনকী আরবভূমিতে মেয়েদের ক্ষেত্রে হিজাব ব্যবহার প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, আসরিয়া, বাইজেনটাইন, পারস্য সাম্রাজ্যে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা কাপড়ে মাথা, চুল, গলা ও নাক পর্যন্ত ঢেকে বাড়ির বাইরে যেতেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজেও মেয়েরা মাথা-চুল ঢেকে রাখা পছন্দ করতেন। খ্রিস্টান সমাজেও মেয়েদের মাথা ঢাকার প্রচলন ছিল, এখনও আছে। ধর্মযাজিকা বা নানদের (Nun) মধ্যে এটা দেখা যায়। মাদার টেরিজা বা মিশনারির মেয়েদের দেখলে তা বোঝা যাবে। বাইবেলের করিনথিয়াসে উল্লেখিত যে, যে মেয়েরা প্রার্থনাস্থলে মাথা ঢাকে না, তারা মাথাকেই অসম্মান করে। সেন্ট অগাস্টাইন তাই খ্রিস্টান মেয়েদের মাথা ঢাকার কথা বলেছিলেন। আফগান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পশতুন মহিলারা ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই হিজাব পরতেন। ইসলামি ব্যবস্থাপনায় হিজাব পরা ইসলামি সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাবে হিজাব পরার প্রবণতা কমে যায়। সাতের দশকে ইরানে তথাকথিত ইসলামি বিপ্লবের পরে এবং বিশ্বজুড়ে প্যান-ইসলামিক ভাবনা আরও বিস্তৃত হওয়ার ফলে হিজাব পরা ইসলামী সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে পড়ে। আবার সেই ইরানেই হিজাব ঠিকমতো না পরায় মাহিসা আমিনির পুলিশি অত্যাচারে মৃত্যু হলে ইরানের মেয়েরা হিজাব বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এই আন্দোলন অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কেননা এটা মেয়েদের নিজস্ব স্বাধীনতার প্রশ্ন। অবশ্যই বহু দেশে এটা মেয়েদের নিজস্ব রুচির ওপর ছেড়ে রাখা হয়। কিন্তু বর্তমানে কর্ণাটকের বিজেপি সরকার এটিকে সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিষিদ্ধ করতে চায়। অথচ ভারতের বহু জায়গায় হিন্দু মেয়েরা, বিশেষত বিবাহিতরা মাথায় কাপড় ঢেকে রাখে। বাংলায় ‘ঘোমটা’ এবং উত্তর ভারতে একে ‘ঘুঙঘট’ বলে।
সংবিধান কী বলে
হিজাব বন্ধে কর্ণাটক সরকারের নির্দেশনামাকে ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৯, ২১ এবং ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে এবং শিক্ষার অধিকার আইনের নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। মৌলিক ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে (এসেনসিয়াল রিলিজিয়াস প্রাকটিস) সংবিধানের ২১ এবং ২৫ নম্বর ধারা অনুসারে ধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলিক অধিকার এবং ভারতীয়দের অবাধ ধর্মাচরণের অধিকার - সেই নিরিখে বিষয়টি বিচার করতে হবে। তার সাথে সাথে ধর্মীয় রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মধ্যে আদর্শ সীমারেখা কী হবে, তাও বিশ্লেষিত হওয়া দরকার। বিশ্লেষিত হওয়া দরকার কোন্টিকে মৌলিক ধর্মাচরণ বলা হবে আর কোন্টিকে বলা হবে না। তাই এই প্রশ্নে এবছর কর্ণাটকের হাইকোর্টের তিন বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন, তাতে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলা যায়, ওই রায়ের মধ্যে সংবিধানগত ফাঁক আছে। এর আগে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (নালসা) বনাম ভারত সরকারের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল মানুষের মৌলিক অধিকারে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করতে হলে রিজোনেবেল অ্যাকোমোডেশন রাখতে হবে। অর্থাৎ যেখানে নাগরিকদের অধিকারের প্রশ্নে দুটি ভিন্নমুখী দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়, সেখানে দেখতে হবে প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে কম বিচ্যুত হওয়ার পথটি কীভাবে সন্ধান করা যায়। হিজাব মামলায় কর্ণাটক উচ্চ আদালতের রায় সুপ্রিম কোর্টের নালসা রায়ের দার্শনিক অবস্থানটিকে অগ্রাহ্য করেছে। ব্যক্তি পরিসর এবং গণপরিসর - এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্যের ক্ষেত্রে দেখতে হবে ব্যক্তি নাগরিকের অধিকারে বিধিনিষেধ আরোপ যেন যুক্তিসঙ্গত অন্তর্ভুক্তি (Reasonable accommodation) মেনে করা হয়। এই প্রশ্নে ২০১৮ সালে কেরালা হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা ছিল সংখ্যালঘু খ্রিস্টান মিশনারি বালিকা বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে (ফতিমা আসলিম বনাম কেরল রাজ্য মামলা)। বর্তমানে কর্ণাটক সরকারের হিজাব নিষিদ্ধকরণ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য - যেখানে ছেলেমেয়ে উভয়ই পড়াশোনা করে। তাছাড়া অভিন্নতার কথা বলে হিজাব বাতিল করলে শিখদের পাগড়ি পরে আসাও বাতিলের প্রশ্ন উঠবে। বিবাহিত হিন্দু ছাত্রীদের শাঁখা-সিদুঁর পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার বিষয়েও প্রশ্ন উঠবে।
প্রশ্ন ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ নয়
হিজাবের প্রশ্নটিকে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ - এই আলোকে বিচার করলে আমরা ভুল করবো। হিজাব চলবে - কিংবা চলবে না - এমন নয়। প্রশ্নটা হলো নারীর অধিকারের। অর্থাৎ মেয়েরা হিজাব পরবে কী পরবে না, তা তারাই ঠিক করবে। হিজাব পরার যেমন অধিকার থাকবে, তেমনি না পরার অধিকার থাকবে। রাষ্ট্র বা সমাজ জোর করে হিজাব পরাতে পারে না কিংবা হিজাব খুলতে বাধ্য করতে পারে না।এটা নারীদের একান্তই ব্যক্তিস্বাধীনতা। বহু মুসলিম মেয়ে হিজাব পরে না। আবার বহু মেয়ে পরেন। যাঁরা পরেন, তাঁরা কেউ যেমন একে ধর্মীয় অনুশাসন হিসাবে দেখেন, তেমনি কেউ কেউ দেখেন আত্মরক্ষার বা ব্যক্তিসত্তার প্রকাশ হিসাবে। শুধু কর্ণাটক নয়, দেশের বহু রাজ্যে বহু বছর ধরে মুসলিম মেয়েরা স্কুল ইউনিফর্ম পরে, তারপর মাথায় হিজাব পরে বিদ্যালয়ে যায়। আবার অনেক মুসলিম মেয়ে হিজাব না পরেই বিদ্যালয়ে যায়। এতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভেঙে যায়নি। তাই হিজাব বিষয়টির এই সাম্প্রদায়িকীকরণ শুধু অনৈতিক নয় - এটি অসাংবিধানিক। আর বিপদটা এখানেই। কোনো একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিংবা সব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তা স্থান-কাল-পাত্রের ওপর নির্ভরশীল। নারী সমানাধিকারের কথা যারা বলছেন,তাদের জন্য হিজাব বাদে আরও নানা ক্ষেত্র আছে, যেখানে নারী সমানাধিকারের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এবং সে বিষয়ে আন্দোলন করা যেতে পারে। যেমন পার্লামেন্ট বা বিধানসভায় আসন সংরক্ষণ, মেয়েদের চাকরিতে সংরক্ষণ, জীবনসঙ্গী বাছার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি নানা বিষয়। হিজাব নিয়ে বিতর্ক করে এর রাজনীতিকরণ - বা বলা যায়, সাম্প্রদায়িকীকরণ না করাই ভালো, কেননা সেটা অনৈতিক ও অসাংবিধানিক। বরং তা মুসলিম মেয়েদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। মুসলিম মেয়েরাই ঠিক করুক তাঁরা স্বেচ্ছায় হিজাব ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন কিংবা তা গ্রহণ করবেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বলপূর্বক সেই ভূমিকা পালন না করাই ভালো।