E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯

মতাদর্শ চর্চা

মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (পাঁচ)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


স্থান ও সময় (Space and Time)

● স্থান ও সময় নিয়ে অনেক ধরনের ধারণা রয়েছে। স্থান সৃষ্টি করে চলেছে অতীন্দ্রিয় শক্তি - ভাববাদীদের বক্তব্য। ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছানুসারে স্থান (Space) - এটাও এক ধরনের ভাববাদীদের বক্তব্য। বস্তু এবং স্থান ও সময়-এর সম্পর্ক ভাববাদীরা সহ অন্যান্য বহু দর্শন সমর্থ হয়নি।

● স্থান ও সময় হলো গতিশীল বস্তুর বৈশিষ্ট্য। বস্তু যেমন সর্বদাই গতির মধ্যে রয়েছে, আবার গতিশীল বস্তুর ধর্ম হলো স্থান ও সময়। গতিশীল বস্তু যে জায়গা জুড়ে বিরাজ করে তাকেই তো স্থান বলে। অনাদিকাল ধরে স্থান রয়েছে এবং বস্তু তার ভিতর প্রবিষ্ট - এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। দেশ, মহাদেশ, সাগর, মহাসাগর, পর্বতমালা এই সমস্ত কিছু গতিশীল বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। গ্রহ, নক্ষত্র, নক্ষত্রমণ্ডলী, কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole) - এইগুলি সমস্ত অতিকায় স্থানের নাম। কৃষ্ণগহ্বরও স্থান। আসলে এরা সবই গতিশীল বস্তু। গতিশীল বস্তুর অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্থান। জৈব, অজৈব সমস্ত বস্তুই নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে।

● গতিশীল বস্তুর অস্তিত্বকাল হলো সময় (Time) । গতিশীল বস্তু ব্যতিরেকে যেমন স্থান সম্ভব নয়, ঠিক তেমনই সময়ও সম্ভব নয়। বস্তু জগৎ যেমন অসীম, সময় এবং স্থানও অসীম। আমরা সময়কে নির্দিষ্ট করার প্রয়াসে বছর, মাস, দিন, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড - সময় সংক্রান্ত এই সমস্ত ধারণা মানুষই তো তৈরি করেছে।

● সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে তাকেই তো বছর বলে। পৃথিবী অর্থাৎ আমাদের বাসস্থান এই সুন্দর গ্রহের নিজের অক্ষের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে তাকেই তো দিন বলে। দিনকে আমরা সমান ২৪টি ভাগে ভাগ করেছি। এক একটি ভাগকে ঘণ্টা বলে। এই ঘণ্টা (Hour)–কে সমান ৬০ ভাগে ভাগ করে, এক একটি ভাগকে মিনিট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, মিনিটকে সমান ৬০ ভাগে ভাগ করে এক একটি ভাগকে সেকেন্ড বলা হয়। সময় সম্পর্কিত সমগ্র ধারণাই কিন্তু গতিশীল বস্তুকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে।

● স্থান ও সময়কে গতিশীল বস্তু থেকে পৃথক করে দেখা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ভাববাদীরা কিন্তু স্থান ও সময়কে আলাদা সত্তা হিসাবে বিবেচনা করে। তাদের বক্তব্য অনুসারে সমস্ত কিছুর স্রষ্টা যে অতীন্দ্রিয় শক্তি অস্তিত্বের জন্য স্থান ও সময় দুই-ই আবশ্যিক। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠা করেছে যে, গতিশীল বস্তু ব্যতিরেকে স্থান ও সময় বলে কিছু নেই।

প্রাণ

● বস্তু সম্পর্কিত আলোচনায় ‘প্রাণ’ (অর্থাৎ জীবন, ইংরেজিতে Life) বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল ধরে (এখনও) মানবসমাজে যে ধারণা বিরাজ করেছে তা হলো ‘প্রাণ’ হলো অলৌকিক শক্তির বহিঃপ্রকাশের রূপ। প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিরন্তর অগ্রগতির সাহায্যে আমরা জেনেছি, এই পৃথিবীতে জড় পদার্থের (Inert Matter) বিকাশের ধারাতেই প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। প্রায় ৩৭০ কোটি বছর (স্বল্প তারতম্য হতে পারে) পূর্বে এই পৃথিবী গ্রহে প্রাণের উদ্ভব হয়। সেই সময়ের পৃথিবীতে যে পরিবেশ বিরাজ করছিল সেখানে জলের মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যৌগ ও জটিল পদার্থের নিরন্তর বিকাশের মধ্য দিয়েই অ্যামিনো অ্যাসিড ও অন্যান্য জৈব পদার্থের সংশ্লেষণ সম্ভব হলো। এই হলো প্রাণের উদ্ভব, এই আদিম প্রাণ ছিল এককোষী। কয়েক শত কোটি বছর ধরে প্রাণের বিবর্তন ঘটেছে, এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণ। অমেরুদণ্ডী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে। ক্রমান্বয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে। এইভাবেই প্রাণের ক্রমান্বয়ে বিবর্তনের ধারায়‌ মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। আধুনিক মানুষকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স’ (Homo Sapiens Sapiens) বলে অভিহিত করা হয়। গবেষকরা সমর্থ হয়েছেন প্রমাণ করতে, আজ থেকে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর পূর্বে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন বানর (Apes)-দের আবির্ভাব ঘটেছিল। ২৫ লক্ষ বছর পূর্বের অস্ট্রালোপিসেকাশদের (Austrolopithecus) তৈরি পাথরের হাতিয়ারের প্রমাণও পাওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রাণের বিবর্তন ধারায় সরল থেকে জটিল রূপের প্রাণের ক্রমান্বয়ে আবির্ভাব ঘটেছে। কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তনের ধারাতেই এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। মহান বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের ‘বিবর্তন তত্ত্ব’ এই পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে উপস্থিত করল।

● আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে আনুমানিক প্রায় আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে। প্রাণের বিবর্তন ধারায় প্রায় ৫০ কোটি বছর পূর্বে উদ্ভিদের আবির্ভাব। প্রায় সাড়ে ৩৬ কোটি বছর পূর্বে উভচর প্রাণী দেখা দেয়। প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি বছর পূ‍র্বে পক্ষীদের আবির্ভাব। স্তন্যপায়ীদের প্রথম আবির্ভাব ঘটে প্রায় ১৩ কোটি বছর পূর্বে। বস্তুর বহিঃপ্রকাশের একটি রূপ হলো প্রাণ। প্রাণের বিবর্তনের ধারাতে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। কোনো অলৌকিক বা অতীন্দ্রিয় শক্তির সৃষ্টি নয় মানুষ।

● এই প্রসঙ্গে ডি এন এ-র জোড়া হেলিক্স (Double Helix) প্রসঙ্গর অবতারণা করা হচ্ছে। ডি এন এ-(ডি অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড - Deoxyribonucleic Acid)।

জোড়া হেলিক্স সংক্রান্ত আবিষ্কারকে বিংশ শতাব্দীতে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে বর্ণনা করা হয়। ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেমস ওয়াটসন - দুই বিজ্ঞানী এই মহান আবিষ্কারটি করেন। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৩ সালে অন্যতম আবিষ্কারক জেমস ওয়াটসন লেখেন, ‘‘আমাদের এই আবিষ্কার মানব প্রজাতির উদ্ভবের সময় থেকে চলে আসা বিতর্কের অবসান ঘটাল। প্রাণের মূলে কী ঐন্দ্রজালিক, অধ্যাত্ম-রহস্যময় কোনো কিছু আছে - নাকী তা প্রকৃতি বিজ্ঞানের যে কোনো ক্লাসে যে সব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয়, সেই রকমেরই কিছু স্বাভাবিক পদার্থিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফসল? কোষের মর্মমূলে কী ঐশ্বরিক কোনো কিছু থাকে যা তাতে প্রাণ সঞ্চার করে? জোড়া হেলিক্স তত্ত্ব এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর দিয়েছে। জোড়া হেলিক্স তত্ত্ব বলেছে, না, প্রাণ সৃষ্টি ঐশ্বরিক কোনো কিছু নয়। স্বাভাবিক পদার্থিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া (Physical and Chemical change)-র ফসল হলো প্রাণ।’’

১৯৬৬ সালে অর্থাৎ জোড়া হেলিক্স তত্ত্বের আবিষ্কারের ১৩ বছর পর দুই বিজ্ঞানী যথাক্রমে হরগোবিন্দ খোরানা ও মার্শাল নিরেনরাগ-এর আবিষ্কার ক্রিক ও ওয়াটসন-এর জোড়া হেলিক্স-এর বক্তব্যকে আরও শক্তিশালী করল, জোরদার করল।

চেতনা

● মানুষের মস্তিষ্ককে আশ্রয় করে চেতনা গড়ে ওঠে। মানব মস্তিষ্ক হলো বস্তুর সর্বাপেক্ষা সংগঠিত ও সর্বোচ্চ রূপ। মস্তিষ্কের কার্যধারার ফল হলো চেতনা। বস্তুকে আশ্রয় করেই তো চেতনা গড়ে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা জেনেছি কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে মানব মস্তিষ্ক কাজ করে। অসংখ্য রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় প্রক্রিয়ার সাহায্যে মানব মস্তিষ্ক কাজ করে। চেতনা, চিন্তা এই প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি। স্মরণে রাখতে হবে, বহির্জগতের বাস্তবতা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। বহির্জগতের বাস্তবতা এবং মস্তিষ্কে তার প্রতিফলন - এই আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতেই মানব চেতনা গড়ে ওঠে। মানব মস্তিষ্ক ব্যতিরেকে কোনো ধারণা, চিন্তা, আদর্শ কোনো কিছুই গড়ে উঠতে পারে না। ভাববাদীরা বস্তুকে ভিত্তি করে যে চেতনা - তা স্বীকার করে না। চেতনা, চিন্তাকে ভাববাদীরা স্বাধীন সত্তা বলে স্বীকৃতি দেয়। একেই তারা বলে আত্মা। এই আত্মাই নাকি পবিত্র অতীন্দ্রিয় শক্তির সাথে যুক্ত। এভাবেই ভাববাদীরা চেতনাকে অবলম্বন করে যে জ্ঞান (Knowledge), তাকেই অস্বীকার করে, বাতিল করে।

(ক্রমশ)