৬০ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২১ অক্টোবর, ২০২২ / ৩ কার্ত্তিক, ১৪২৯
২০২২ সালের মেডিসিন ও ফিজিওলজি-তে নোবেল
প্রাগিতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পাতা খুললেন পাবো
তপন মিশ্র
মানব বিবর্তনের ইতিহাসকে আরও শক্ত ভূমির উপর দাঁড় করিয়ে দিলেন ভেন্তে পাবো (Svante Pääbo)। বিশ্বের সব ধরনের মৌলবাদীদের নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে ২০২২ সালের মেডিসিন এবং ফিজিওলজি বিভাগের নোবেল জয় করলেন ভেন্তে পাবো। জন্মসূত্রে সুইডেনের নাগরিক হলেও জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষক হলেন পাবো। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি ইয়োরোপীয়দের কোভিডে অত্যধিক মৃত্যুর হার এবং রোগের আক্রমণের তীব্রতার কারণ হিসাবে এক জিনগত ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত মোট ৩৫০ টি বিশ্বমানের গবেষণা প্রবন্ধের মধ্যে ৩৩৪ নম্বর প্রবন্ধতে তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘‘The major genetic risk factor for severe COVID-19 is inherited from Neanderthals’’। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে নেচার (Nature) পত্রিকায়। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আরেকটি হলো নিয়ানডারথালদের সম্পূর্ণ ডিএনএ সিকুয়েন্সিং (সজ্জারীতি) বা অবলুপ্ত এই প্রজাতির ডিএনএ-র সজ্জারীতির আবিষ্কার। ডিএনএ-র জটিল অণুর মধ্যে জৈব অণুগুলির পর পর অবস্থানের পদ্ধতি জানাই হলো সিকুয়েন্সিং। নির্দিষ্ট সজ্জারীতি একটি প্রজাতির লক্ষণ। এটা ঠিক যে, কেবল পাবোই সবটা করেছেন তা নয়। এই কাজে তিনি একজন জিন-পুরাতত্ত্ববিদ (paleo-genomics) হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। স্টকহোমের করোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল কমিটি এই কাজের স্বীকৃতি কেবল এককভাবে পাবো-কে দিয়েছে।
অভিব্যক্তি বা বির্বতন বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, আদিম এক মানব প্রজাতি নিয়ানডারথাল (Homo neanderthalensis) ইয়োরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হয়। নিয়ানডার উপত্যকা থেকে প্রথম এই প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়ার কারণে এভাবেই নামকরণ করা হয়। নিয়ানডারথালদের একটি দীর্ঘ বিবর্তনীয় ইতিহাস রয়েছে। উত্তর স্পেনের সিমা দে-লস-হুয়েসোস এবং কেন্টের-সোয়ান্সকম্বের জীবাশ্ম থেকে প্রমাণিত হয় যে, নিয়ানডারথালদের উপস্থিতি ৪০০,০০০ বছর আগে ইয়োরোপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই আদিমানব প্রজাতি প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে অবলুপ্ত হয়ে যায়। প্রজাতিটি ইয়োরেশিয়ায় বিস্তৃত ছিল - পশ্চিমে পর্তুগাল এবং ওয়েলস থেকে পূর্বে সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতমালা পর্যন্ত। আধুনিক মানুষের তুলনায় কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে (অর্থাৎ আধুনিক মানুষের মতো সম্পূর্ণভাবে ঋজু নয়) এরা চলাফেরা করত। এর কারণ ছিল এদের শিকারের রীতি। এরা ছিল সম্পূর্ণরূপে মাংসাশী।
আধুনিক মানুষ অর্থাৎ বর্তমানের মানব প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens), আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ইয়োরেশিয়া অঞ্চলে হোমো স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ানডারথাল মানুষের মধ্যে যেমন সংঘর্ষ হয় তেমনই যৌন জনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জিনের আদানপ্রদানও ঘটে। সাধারণভাবে দুটি ভিন্ন প্রজাতির মিলনের ফলে যে বংশধর জন্মায় তা বন্ধ্যা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। এর কারণ লুকিয়ে আছে এই দুই প্রজাতির জিনের গঠনের মধ্যে। পাবোর গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাথমিকভাবে ইয়োরোপ এবং এশিয়ার অধিবাসীদের মানব জিনোমের মধ্যে ১ থেকে ৪ শতাংশ নিয়ানডারথাল জিন রয়েছে।
কেন ভেন্তে পাবো?
নোবেল কমিটি ভেন্তে পাবোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে - ‘‘for his discoveries concerning the genomes of extinct hominins and human evolution’’ - এর অর্থ হলো মানব বিবর্তন এবং হোমিনিনদের বিবর্তনে জিনঘটিত প্রমাণ হাজির করার কারণে পাবোকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে। প্রশ্ন আসতে পারে হোমিনিন কারা।
এককালে মানুষের পুর্বপুরুষদের মধ্যে হোমিনিন এবং হোমিনিড এই দুই গোত্রকে সমার্থক মনে করা হতো। সংক্ষেপে বললে যা দাঁড়ায় হোমিনিন (Hominin বা Homininae) হলো উন্নত মানের প্রাইমেট (আদি মানব) শ্রেণির এক স্তন্যপায়ীর উপগোত্র। হোমিনিনের মধ্যে মানব প্রজাতি সহ সময়ের গর্ভে অবলুপ্ত কয়েকটি পূর্বসূরি (Homo গণের বিভিন্ন প্রজাতি, Australopithecus, Paranthropus এবং Ardipithecus) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সমস্ত হোমিনিনকে হোমিনিড বলা হয় কিন্তু সমস্ত হোমিনিড হোমিনিন নয়। ওরাং ওটাং (orangutan), গরিলা (gorilla), শিম্পাঞ্জী (chimpanzee) এবং হোমিনিনদের যুক্ত করলে তাদের একত্রে হোমিনিড বলা হয়। অতএব এককথায় বললে যা বোঝায় তা হলো, পাবোর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল হোমিনিন সংক্রান্ত যদিও তারা সবাই হোমিনিডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হোমিনিনদের মধ্যে চিন্তা জগতের জটিল গুণাবলি দেখা যায়। যেমন আয়নায় নিজেদের চেনার ক্ষমতা, কানাইন দাঁতের হ্রাস, মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি এবং দুটি পা ব্যবহার করে সোজা হয়ে হাঁটার ক্ষমতা (bipedalism) ইত্যাদি। আধুনিক মানুষের মধ্যে এই গুণাবলি আরও বিকশিত হয়।
১৯৯৭ সালে পাবো ১৮৫০-এর দশকে জার্মানির ডুসেলডর্ফের কাছে পাওয়া নিয়ানডারথাল কঙ্কালের অংশ বিশ্লেষণ করার উদ্যোগ নেন যদিও এই প্রজাতিটির ফসিল ১৯২৯ সালে বেলজিয়ামে প্রথম পাওয়া যায়। ডুসেলডর্ফের কঙ্কালটি ছিল প্রায় ৪০,০০০ বছরের পুরনো। এই নিয়ানডারথাল প্রজাতির হাড় থেকে তিনি জেনেটিক উপাদান আলাদা করতে সফল হন। তখন পাবো জার্মানির লাইপজিগ-এ সেই সময়কালে নতুন প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি আন্থ্রপোলজির নবনিযুক্ত পরিচালক হিসাবে যুক্ত হন। ২০১০ সালে পাবো অবশেষে এই কাজে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিয়ানডারথাল জিনোমের সিকুয়েন্সিং সম্পূর্ণ করে গবেষণালব্ধ বিষয়ের প্রথম সংস্করণ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের সামনে তা উপস্থিত করতে সক্ষম হন। ফলে সেই প্রথম বিশ্ব নিয়ানডারথাল জিনোমের একটি অংশ সম্পর্কে অবহিত হয়।
পাবো এবং তাঁর দলের গবেষণা আমাদের জানিয়ে দেয় যে, আধুনিক মানুষ এবং নিয়ানডারথালদের শেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ প্রায় বর্তমান সময়ের থেকে ৮০০,০০০ বছর আগের সময়ে পৃথিবীতে বিচরণ করত। পাবো এবং তাঁর দল ডেনিসোভা (Denisova)-র জিনোমের সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হন। ডেনিসোভানরা হলো একটি হোমিনিন গোত্রের অবলুপ্ত মানব প্রজাতি যার জীবাশ্ম ২০০৮ সালে সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতমালার ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরা এটাও প্রমাণ করে যে, ডেনিসোভা মানুষদের সাথে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষদের এক সময়ে ঘনিষ্ঠ সহাবস্থান ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলে বর্তমান মানব প্রজাতির জিনের ৬ শতাংশ পর্যন্ত বিলুপ্ত ডেনিসোভানদের জিনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই সমস্ত কারণে পাবো যথাযথভাবে প্যালিও জেনেটিক্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচিত হন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটির সভাপতি মার্টিন স্ট্রাটম্যান এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, ‘‘তাঁর কাজ আধুনিক মানুষের বিবর্তনীয় ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে।’’ লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়মের ক্রিস স্ট্রিংগারও তাঁর সম্পর্কে একই ধরনের প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেন।
বস্তুবাদী চিন্তার বিকশিত রূপ
বস্তুবাদের উপর ভর করে জীব জগতের দ্বান্দ্বিক বিকাশের প্রাকৃতিক পদ্ধতি জানার ইচ্ছা আমাদের সবসময় প্রকৃতি বিজ্ঞানের গবেষণার দিকে আকর্ষিত করেছে। এই প্রয়াসের অংশ হিসাবে বিজ্ঞানীরা সর্বদা মানব প্রজাতির অভিব্যক্তি এবং উৎপত্তির প্রশ্নে প্রতি মূহুর্তে গবেষণায় সচেষ্ট আছেন। এমনটা নয় যে, আজকে যা ভেন্তে পাবো সহ অন্য জিন-পুরাতত্ত্ববিদরা বলছেন তা মানব অভিব্যক্তির শেষ কথা। এখনও যে প্রশ্নগুলির আরও স্পষ্টীকরণ চাই তা হলো - প্রথমত, আধুনিক মানুষ, হোমো স্যাপিয়েন্স, কখন এবং কোথায় প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, কীভাবে আমরা হোমোগণের অন্যান্য সদস্যদের থেকে আলাদা যার ফলে জীব জগতের অন্যান্যদের তুলনায় অভূতপূর্ব সংস্কৃতি ও সমাজ বিকাশ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি ইত্যাদি। এরকম আরও অনেক মৌলিক প্রশ্ন আমাদের আজ ভাবায়। হাজার হাজার বছর ধরে তথাকথিত ধর্মগুরু, পণ্ডিত এবং দার্শনিকরা এই সমস্ত বিষয়ে আমাদের মস্তিষ্কে তালা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই তালা ভেঙে ফেলাই এখন মূল কাজ। পুরাজিনতত্ত্ববিদ ভান্তে পাবোর কাজের অংশ হিসেবে আমরা এই বড়ো প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি।
এমনটা মনে হতে পারে যে, মানব বিবর্তন এক জটিল এবং বিভ্রান্তিকর বিষয়। মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতি কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে এবং জৈব বিবর্তনে সীমাহীন দক্ষতা অর্জন করেছে। মানুষের পক্ষে বিগত ১০০-২০০ বছরে এই দক্ষতার সমস্তটা বোঝা সম্ভব নয়। পাবোর কাজ শুধু আমাদের অতীতে নতুন আলো ফেলেনি, বিবর্তন প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত সত্যে পৌঁছানোর জন্য অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। পাবোর কাজ ভবিষ্যতে আরও গবেষণাকে উৎসাহিত করবে সন্দেহ নেই। পাবো তাঁর পুরস্কার-পরবর্তী সাক্ষাৎকারে পৃথিবীর বর্তমান সামাজিক সমস্যার নিরিখে আর একটি কঠিন সত্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘কল্পনা করুন যদি নিয়ানডারথালরা আরও ৪০,০০০ বছর বেঁচে থাকত, তাহলে আমাদের মধ্যে নিয়ানডারথালদের প্রতি বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব থাকার মতো ঘটনা আরও বেশি করে ঘটত।’’
কবিগুরুর ভাষায় এ যেন -
‘‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো,
সেই তো তোমার আলো।
সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো।।’’
একই কবিতায় কবিগুরু লিখছেন -
‘‘মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ।
সেই তো তোমার প্রাণ।।’’
মানব বিবর্তনের ধাপগুলি ধীরে ধীরে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হওয়া এবং প্রকৃতির মধ্যেকার সমস্ত দ্বান্দ্বিক বিকাশের ধারা বুঝতে সক্ষম হওয়া আমাদের জন্য ‘ভালো’-র বার্তা বহন করে। মৃত্যু এবং প্রাণের বিরোধের মধ্যেই আমাদের জীবিত থাকা।ভান্তে পাবো-র গবেষণা যেমন সেই উৎসারিত আলোর কথা বলে তেমনই নিয়ানডারথাল বা ডেনিসোভানদের সঙ্গে বিরোধের মধ্যদিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সের বিকাশের ধারার উপর আলোকপাত করে। এই দ্বান্দ্বিক বিকাশের পদ্ধতি যত দ্রুত আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারব ততই আমদের মঙ্গল।