৫৯ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২২ এপ্রিল, ২০২২ / ৮ বৈশাখ, ১৪২৯
তৃণমূলী মতলব ভেস্তে দিল দেউচা পাঁচামীর আদিবাসী জনগণ
তাড়া খেয়ে পালিয়েছে প্রশাসনিক আধিকারিক ও তৃণমূল বাহিনী
দেউচা পাঁচামীতে প্রতিরোধে সোচ্চার আদিবাসী মানুষের অবরোধের জেরে পিছু হটলো প্রশাসন।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের দু’দিন আগে মুখ্যমন্ত্রীর বাসনা ছিল শিল্প প্রতিনিধিদের দেখানো যে দেউচা পাঁচামী তাঁর হাতের মুঠোয়। সেই মতো জেলা প্রশাসন, বিশাল পুলিশ বাহিনী ও শাসকদলের তাবড় নেতৃত্বের উদ্যোগে গোটা ব্লক থেকে বাস ভরতি তৃণমূল কর্মীদের সেখানে জড়ো করা হয়েছিল। করা হয়েছিল জমিদাতাদের চেক ও চাকরির কাগজ বিলির বিশাল আয়োজন। কিন্তু গ্রামবাসীদের সমবেত প্রতিরোধে ভেস্তে গেছে সব আয়োজন। চেক বিলি তো দূরের কথা লাঠি-সোঁটা নিয়ে পাঁচামীর প্রতিবাদী আদিবাসীদের তাড়া খেয়ে কোনো মতে দৌড়ে পালালো তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে জেলা প্রশাসনের আধিকারিক ও পুলিশকর্মীদের।
দেউচা পাঁচামীতে এই প্রতিরোধের ঘটনা ঘটে গত ১৮ এপ্রিল। এদিন জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে কয়লাখনির জন্য জমিদাতাদের চেক ও চাকরির কাগজপত্র বিলির কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এই আয়োজন ছিল দেওয়ানগঞ্জের মাঠে। আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছিল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। এই উপলক্ষে দেউচা থেকে দেওয়ানগঞ্জ যাবার রাস্তায় খনির পক্ষে অসংখ্য পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ ছিল গোটা এলাকা। এই কর্মসূচিকে সফল করতে বাসের পর বাস ভরতি তৃণমূলীদের আনা হয়েছিল জেলার নানা প্রান্ত থেকে। ছিল ভুরিভোজেরও আয়োজন। কিন্তু পুলিশ পাহারায় প্রশাসন, তৃণমূল বাহিনী বারোমেসিয়ার ডাঙালে কয়লাখনি বিরোধী ধরনার কাছে পৌঁছাতেই চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়। লাঠি-সোঁটা, তীর-ধনুক নিয়ে গোটা এলাকার মানুষ বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। জায়গায় জায়গায় শুরু হয় অবরোধ। তৃণমূল জমায়েত করেছিল মথুরাপাহাড়ি ঢোকার মুখে। তীব্র রোদের মধ্যে রুক্ষ্ম শুষ্ক লাল মাটিতে বসে পড়েন অবরোধকারীরা। সময়ের সাথে সাথে ক্ষোভের তেজও বাড়তে থাকে। পুলিশ, মহকুমা শাসক একে একে কথা বলতে গেলে বাধা পায়। অবরোধকারীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, জমি জঙ্গল তাঁরা কিছুতেই ছাড়বেন না। এখানে কয়লাখনি হবে না। এরপর অতিরিক্ত জেলা শাসকও অবরোধকারীদের বোঝাতে ব্যর্থ হন। এই অবস্থায় জেলা শাসক ও পুলিশ সুপার এলাকায় গিয়েও গাড়ি থেকে নামেননি। এরমধ্যে তৃণমূলের জমায়েত কিছুটা এগোতেই অবরোধকারীরা প্রচণ্ড ক্ষোভে তেড়ে আসে। ধামসা মাদলের ধ্বনির সঙ্গে অবরোধকারীদের তুমুল চিৎকারের শব্দে ভীত-সন্ত্রস্ত তৃণমূলীদের শুরু হয় দৌড়। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তাপস সিনহার সঙ্গে শাসকদলের তাবড় নেতাদের দৌড় দেখে বাসে আসা তৃণমূলীরাও ছুটতে শুরু করে। এরপর একের পর এক বাসগুলিও মুখ ঘুরিয়ে চলতে শুরু করে। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরা। নিমেষে ফাঁকা হয়ে যায় এলাকা। বিক্ষোভ থেকে শিবলাল সরেন জানিয়ে দেন, আমরা তো বলেই দিয়েছি চাকরি চাই না, প্যাকেজ চাই না। এখানে খনি করতে দেব না। আজ কয়লার খোঁজ পেয়ে নজর পড়েছে আমাদের জমি-জঙ্গলের উপর। এতদিন কী করছিল সরকার? মুখ্যমন্ত্রী খুব ‘বহিরাগত, বহিরাগত’ বলে চেঁচাচ্ছিলেন। আজ বহিরাগতদের নিয়ে কারা এসেছিল তা নিজের চোখে দেখেছে সবাই।
১৮ এপ্রিল দেউচা পাঁচামীতে আদিবাসীরা যেভাবে শাসকদল তৃণমূলের দুর্বৃত্ত বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে পূর্ণ সমর্থন করেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এদিন বিকেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, পরিবেশ এবং জনজীবনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় আদিবাসী ভাইবোনদের লড়াইয়ের পাশে আমরা ছিলাম, আছি এবং থাকব। আজকের ঘটনার পরে পুলিশ যদি দেউচা পাঁচামীর আদিবাসীদের উপরে কোনো নির্যাতন নামিয়ে আনার চেষ্টা করে, কোনো ন্যক্কারজনক অত্যাচার নামিয়ে আনে তাহলে তার ফল ভালো হবে না। সিপিআই(এম) সর্বশক্তি দিয়ে আদিবাসীদের লড়াইয়ের পাশে থাকবে। আমরা রাজ্যের সব অংশের মানুষকেও তাঁদের পাশে থাকার আবেদন জানাচ্ছি।
প্রসঙ্গত, দেউচা পাঁচামীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে গরিব আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কয়লা খনি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে তৃণমূল সরকার। এই উদ্দেশ্যে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে এবং শাসকদলের বাহিনীকে নামিয়ে আদিবাসীদের নানাভাবে কবজা করে তাঁদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলে। কিন্তু স্থানীয় গরিব আদিবাসী মানুষেরা তাঁদের জমিজিরেত জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদের অপচেষ্টার বিরোধিতা করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাশাপাশি সিপিআই(এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দল ও গণসংগঠন। বিভিন্ন পরিবেশবিদ ও পরিবেশ সংগঠনও রাজ্য সরকারের এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে জানায়, এখানে কয়লাখনি হলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও সরকার কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে দেউচা পাঁচামীতে কয়লাখনি গড়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। শুধু তাই নয়, গরিব আদিবাসীদের যাতে নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বশীভূত করা যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও দলীয় বাহিনীকে নামানো হয়। সরকার ও দলের ইন্ধন পেয়ে শাসকদলের বাহিনী এর আগে গ্রামের মানুষ ও কলকাতা থেকে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পদযাত্রার উপর হামলা পর্যন্ত চালিয়েছে। এভাবেই যেকোনো মূল্যে ওখানে কয়লাখনি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে চলেছে তৃণমূল সরকার। তাদের কাছে দেউচা পাঁচামীর মানুষ, সেখানকার পরিবেশ কোনো কিছুরই মূল্য নেই। তাদের শুধুমাত্র লক্ষ্য কর্পোরেটদের স্বার্থে দেউচা পাঁচামীতে কয়লা খনি তৈরি করে দল ও দলের মাতব্বরদের কোটি কোটি টাকা কাটমানির ব্যবস্থা করা। তাই শুরু হয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলন। নানা হুমকি ও হামলাকে মোকাবিলা করেই ক্রমশ বিস্তৃত ও শক্তিশালী হচ্ছে দেউচা পাঁচামীর আদিবাসীদের প্রতিরোধ আন্দোলন।