E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২২ এপ্রিল, ২০২২ / ৮ বৈশাখ, ১৪২৯

চরম দুর্দশায় জেরবার কৃষকরা

রাজ্য কৃষক কাউন্সিলের সভায় সংগঠন ও সংগ্রামকে আরও মজবুত করার আহ্বান


বিশেষ প্রতিনিধিঃ ১৬ এপ্রিল’২২ (২ বৈশাখ, ১৪২৯) তারিখে হরেকৃষ্ণ কোঙার স্মৃতিভবন সভাকক্ষে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার রাজ্য কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কোচবিহার থেকে শুরু করে ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি জেলার রাজ্য কাউন্সিল সদস্যদের আলোচনায় রাজ্যের কৃষি ও কৃষকের চরম দুর্দশার কথা ফুটে ওঠে। কৃষি রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারের বিষয়, ফলে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বাস্তব কার্যধারার সাথে কৃষকদের রীতিমতো যোগাযোগ রাখতে হয়। অথচ সরকারি দপ্তরগুলিতে সরকার ঘোষিত অধিকার কার্যকর করতে কৃষকদের প্রতিকারহীন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কৃষকদের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে বড়ো দুর্নীতির ঘাঁটি হয়ে উঠেছে ভূমিরাজস্ব দপ্তরের বিএলআরও অফিসগুলি। ওই অফিসগুলিকে ঘিরে রয়েছে শাসক মদতপুষ্ট দালালবাহিনী। সরকারি পাট্টা হাতে থাকা সত্ত্বেও তা রেকর্ডভুক্ত করা হচ্ছে না।

এই অবস্থার মধ্যে কৃষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। যেমন দক্ষিণ বংশীহরি ব্লকে এমন ১০ জন পাট্টাচাষির রেকর্ড ১২ বছর পর হাতে হাতে আদায় হলো কৃষক সভার উদ্যোগে ৫০০-র বেশি কৃষক জমায়েত ও নাছোড়বান্দা চাপের মধ্য দিয়ে। ওই জেলার বালুরঘাট ব্লকে দুই হাজারের বেশি কৃষক এবং প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক রমণীর চাপের কাছে ন্যায্য দাবি কার্যকর করতে সম্মত হতে বাধ্য হলো সরকারি আধিকারিকগণ। বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লক একইভাবে ব্যাপক কৃষক জমায়েতের সংগ্রামী মেজাজের কাছে সরকারি আধিকারিকদের দাবি পূরণে সম্মতি দিতে বাধ্য করানো বর্তমান সময়ের স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের সাফল্য বলে সভায় উল্লিখিত হয়েছে। বীরভূমের অভিজ্ঞতাও একই ধরনের ইতিবাচক। পশ্চিম মেদিনীপুরে জমি মাফিয়াদের চক্রান্তে বিশাল আকারে জমিতে কৃষকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে জলাশয় তৈরির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ সংগঠিত হয়েছে। রাজ্যের যেখানে যেখানে গ্রাম পঞ্চায়েত বা ভূমি দপ্তর বা বিডিও’র দপ্তরে সংগঠিত আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করা গেছে, সেখানেই কিছু না কিছু দাবি আদায়ের ঘটনা এরাজ্যে কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি করে চলেছে।

সর্বভারতীয় কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয়, এরাজ্যের কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের বাড়তি ভরসা জুগিয়েছে - একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের কার্যকলাপে বিভাজনের রেখা গভীরতর হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে এরাজ্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি ও কৃষককে রক্ষা করার স্বার্থে কৃষক সংগঠনকে দ্রুত সুসংহত করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলন থেকে স্থানীয় আশু ও আদায়যোগ্য দাবির আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কৃষকসভার সদস্য সংগ্রহ অভিযান সংগঠিত করে গ্রাম ও অঞ্চল কমিটি পুনর্গঠনের জন্য যে প্রস্তাব নেওয়া হয়, রাজ্যের জেলায় জেলায় উদ্যোগ নেবার ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে তার ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

রাজ্য কাউন্সিল সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি বিপ্লব মজুমদার এবং সভায় আলোচনার সূত্রপাত ঘটান সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার। প্রত্যেক জেলা থেকেই রাজ্য কাউন্সিল সদস্যরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। জেলাগুলির রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, গতবছরের তুলনায় এবছর সাড়ে তিন লক্ষের বেশি সদস্য বেড়েছে। যে গ্রামে অন্তত ১০০ সদস্য সংগৃহীত হয়েছে, সেখানেই আগামী মে মাসের মধ্যে সদস্যদের নিয়ে গ্রাম কমিটি গঠনের সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যত্র পরবর্তী ধাপে সংগঠন বিস্তারের লক্ষ্যে কৃষক-কর্মীর টিম গঠন করা হবে। সাম্প্রতিককালে প্রয়াত গ্রামবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের পরিবারে শোকবার্তা পৌঁছে দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের মধ্যে সুদৃঢ় সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশে কৃষকসভার কর্মীদের এই ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত বলা যায় অভিনব।

আগামী দিনে সংগঠন আন্দোলনের বিস্তারে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ, তাই ৫০,০০০ গ্রামীণ বুথ থেকে আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে সংগ্রাম তহবিল থেকে ৫০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংগঠনের পত্রিকা তিনমাস পর পর নিয়মিত প্রকাশ করা এবং স্থায়ী গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। হাওড়া জেলার আমতা ২ নম্বর ব্লকের সারদা গ্রামের গরিব পরিবারের সন্তান, তরুণ আনিস খানের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে এবং সিবিআই তদন্তের জন্য তাঁর পরিবার অতুলনীয় দৃঢ়তার সাথে সব ধরনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে প্রাদেশিক কৃষক সভা পাঁচ লক্ষ টাকা এককালীন সাহায্য হিসাবে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আগামী ২৫ এপ্রিল রাজ্য কৃষক সভার নেতৃত্ব আনিস খানের পরিবারের হাতে এই অর্থ তুলে দেবে।

১৬ এপ্রিলের কাউন্সিল সভা থেকে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীভাঙন রোধের ইস্যুতে আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। গণ-কনভেনশন, পদযাত্রা সহ বহু সংখ্যক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির মহাজনি শোষণ ও জবরদস্তিমূলক সুদ চাপানোর বিরুদ্ধে ও কৃষি সমবায়গুলির গণতান্ত্রিক পরিচালনা নি‍শ্চিত করার লক্ষ্যে সমবায় বাঁচাও মঞ্চের সাথে যুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। আদিবাসী এলাকায় ‘ল্যাম্পস’ (LAMPS)গুলি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেউচা পাঁচামীতে জবরদস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রাজ্যব্যাপী ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ফসলের লাভজনক দাম, সার, কীটনাশক সহ কৃষি উপকরণের ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে ব্যাপক অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগামী মাসগুলিতে ব্যাপক আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় দাবি উঠেছে - একইসাথে নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণের।

এই সময়ে ২০,০০০-এর বেশি কৃষক সহ গ্রামীণ ও গঞ্জ এলাকার জনগণের কাছে তথ্য সংগ্রহ করেছেন কৃষক সভার কর্মীরা। অভিজ্ঞ পরিসংখ্যানবিদ এবং অর্থনীতিবিদগণ উপরোক্ত সমীক্ষাপত্র সমূহ যাচাই করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার তা সভায় পেশ করেন। সমীক্ষা রিপোর্টটি বেশ চমকপ্রদ ও বেদনাদায়ক। সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে যে, মাত্র ০.০৮ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন যে, বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। ৭.৬৯ শতাংশ মতামত দেননি। ৮২.২৩ শতাংশ মনে করেন যে, বর্তমান সরকারের আমলে কর্মসংস্থান কমেছে।

বর্তমানে রাজ্যে মাত্র ৬৬.২৯ শতাংশ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। তাঁদের ৬৫ শতাংশ মনে করেন বর্তমান কৃষিব্যবস্থা খুবই খারাপ অবস্থায়। মাত্র ৫ শতাংশ মনে করেন বর্তমানে কৃষিতে মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮৮ শতাংশের মতে কৃষি থেকে তাঁদের মুনাফা কমতে কমতে একেবারে শেষ পর্যায়ে। রাজ্য সরকার পরিচালিত নতুন কৃষক মান্ডি সম্পর্কে ১৬ শতাংশ একেবারে অজ্ঞ, যাঁরা জানেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩.৭৭ শতাংশ সরকারি মান্ডিতে ফসল বিক্রি করেন। বাকি ৮০ শতাংশ গ্রামীণ আড়তদার বা দালালদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। ভাগচাষির সংখ্যা কমতে কমতে মত্র ১২.৯৭ শতাংশে পৌঁছেছে। ভাগচাষিদের ৯২ শতাংশের মতে কৃষিকাজ থেকে পেটের ভাতটুকও পাওয়া যায় না। ৮৭ শতাংশ মনে করেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কৃষির অবনতির একমাত্র কারণ। মাত্র ৪৪.২৩ শতাংশ মানুষ ১০০ দিনের কাজের আওতায় এসেছেন।

ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পে কর্মরতদের জন্য বর্তমান রাজ্য সরকারের বিশ্ববাংলা প্রকল্পের সুযোগ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ০.৯১ শতাংশ। খবরই জানেন না প্রায় ২৭.৩৫ শতাংশ, আর ৭১.৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা এ থেকে কোনো সাহায্য পাননি। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে ৮০ শতাংশের বক্তব্য নেতিবাচক। রাজ্যের প্রায় ৪৯.৮৬ শতাংশ মানুষ কোনোপ্রকার সরকারি অনুদান পাননি। কৃষক সভা গ্রাম সমীক্ষার কাজ আরও গভীরভাবে পরিচালনা করা ও তার ভিত্তিতে অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।